ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অ্যালামনাই মুহাম্মদ আতাউল গনি। বর্তমানে পড়ছেন যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকায়। লিখেছেন তাঁর পথচলার গল্প।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকায় স্থাপত্য বিভাগে স্নাতকোত্তর করছি। বিষয় ‘টেকনোলজি অ্যান্ড মিডিয়া ইন আর্কিটেকচার অ্যান্ড ইন্টেরিয়রস’। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের অ্যাডভাইজার ও পরীক্ষার প্রক্টর হিসেবেও কাজ করার সুযোগ হয়েছে।
অথচ আমার কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সুযোগই ছিল না। তাহলে স্থপতি কীভাবে হলাম?
মাধ্যমিক পর্যন্ত মাদ্রাসায় পড়েছি। দাখিল পরীক্ষার পর আয়েশ করে ছুটি উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ একদিন খালাতো ভাই শামীম মেহবুব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? কোন পথে ক্যারিয়ার গড়তে চাও?’ তিনিই আমাকে প্রকৌশলের নানা শাখা ও স্থাপত্যের ব্যাপারে বুঝিয়ে বললেন। সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল নিয়ে পড়ার সুযোগ না থাকায় তাঁর পরামর্শে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা ইন আর্কিটেকচারে ভর্তি হই। মানবিক বিভাগে পড়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি প্রকৌশলে পড়ার সুযোগ না থাকলেও ডিপ্লোমাই আমাকে সামনে এগোনোর পথ দেখায়।
২০১০-এ স্থাপত্যে ডিপ্লোমা শেষ করি। এরপর শুরু করি চাকরি। ইন্টেরিয়র ডিজাইনের বাজার তখন সবেমাত্র তৈরি হচ্ছে। আমারও এই সেক্টরে কাজ করতে মন্দ লাগত না।
কাজ করতে করতেই ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (এফআইইউ) স্থাপত্য বিভাগে ভর্তি হই ২০১৫ সালে। আমরাই ছিলাম বিভাগের প্রথম ব্যাচ। এ জন্যই বোধ হয় শিক্ষকদের মনোযোগ আমরা একটু বেশি পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও আমাদের প্রতিটি বিষয়ে খোলামনে আলোচনা করার সুযোগ দিয়েছেন। এফআইইউয়ের সাবেক ও বর্তমান কিছু শিক্ষককে তাই মন থেকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। এর মধ্যে ফারুক আহমেদ উল্ল্যাহ খান, রেদোয়ান বাশার, সাদিয়া মিজান, বখতিয়ার রানা, ফারজানা তমা ও সাহেদা রহমান উল্লেখযোগ্য। বিদেশ পড়তে আসার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলেন ডেপুটি রেজিস্ট্রার মামুন উল মতীন স্যার।
অভিজ্ঞতার ওপর ভরসা করে ২০১৮ সালে একটি স্থাপত্য ফার্ম দিই। নাম ‘এলিগেন্ট আর্কিটেক্টস’। এই ফার্ম থেকেই বড় বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য ইন্টেরিয়র ডিজাইন করেছি। ব্র্যাক, বিকাশ, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, এশিয়াটিক সেন্টারসহ স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে ইন্টেরিয়র ডিজাইন করার অভিজ্ঞতাও তখন হয়েছে। এর মধ্যেই বেশ কিছু দেশে ভ্রমণ করতে গিয়ে মনে হলো, বাইরের উচ্চশিক্ষা আমার ক্যারিয়ারে বাড়তি মাত্রা যোগ করবে। চেষ্টা শুরু করলাম। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকায় সুযোগ পেয়ে যাই। দেশছাড়ার আগে ২০২৩ সালে নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিই।
দেশের বাইরে এসে অনেকের মতো আমাকেও কিছু চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে। তবে শিক্ষক ও সহপাঠীদের সহযোগিতায় সেই বাধা উতরে গেছি। সম্প্রতি এখানে উদ্যাপন করা হয় ‘রিসার্চ ডে’। বছরজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেসব গবেষণা করেন, পোস্টার প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে এই বিশেষ দিনে সেগুলো উপস্থাপন করা হয়। এ বছর স্নাতকোত্তর পোস্টার প্রেজেন্টেশন ক্যাটাগরিতে আমি বিজয়ী হয়েছি। বিষয় ছিল ‘অ্যাড্রেসিং হোমলেসনেস’। থিসিসের বিষয়টা নিয়ে একটু বলি, গত বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে নিউইয়র্ক গিয়েছিলাম। যাত্রাপথেই মেট্রোস্টেশন। দেখি, আশপাশে অনেক মানুষ রাস্তায় ঘুমাচ্ছে। বেশ অবাক হই। যুক্তরাষ্ট্রেও যে এত মানুষ ঘরহীন থাকতে পারে, ধারণা ছিল না। খোঁজখবর করে জানতে পারি, এই সংখ্যা আরও বাড়বে। তখন তাদের নিয়ে কাজ করার চিন্তা মাথায় আসে।
নানান দিক বিশ্লেষণ করে একটি টেকসই মডেলের আশ্রয়কেন্দ্রের (শেল্টার) ডিজাইন করি। যেখানে বাসিন্দাদের গোপনীয়তা রক্ষা হবে, থাকবে সবার সুস্থতা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা। এ ছাড়া একটি কেন্দ্রীয় রান্নাঘর থেকেই সবাইকে দেওয়া হবে পুষ্টিসম্মত খাবার। ইনডোর, আউটডোর স্পোর্টসের সুবিধা থাকবে, পাওয়া যাবে চাকরিও। সঙ্গে মিলবে সচেতনতামূলক পরামর্শ। প্রকল্পটা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক কিছু শিখেছি।
এফআইইউয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশই ডিপ্লোমা থেকে আসে। তাঁদের প্রত্যেকের সংগ্রামের আলাদা আলাদা গল্প আছে। ডিপ্লোমা শেষ করার পর কেউ চাকরি, কেউ ব্যবসা করেন। পাশাপাশি স্নাতকের পড়াশোনাও চালিয়ে যান। অনেকের চেয়ে এসব তরুণকে নিতে হয় অতিরিক্ত চাপ। তবে যেহেতু ডিপ্লোমা করতে গিয়ে প্রকৌশলের কিছু বিষয় আগেই শেখা হয়ে যায়, অনেকের নানান সফটওয়্যারের কাজও জানা থাকে, তাই স্নাতকের বিষয়গুলো বুঝতে সুবিধা হয়। ডিপ্লোমা ও স্নাতক—দুটো ডিগ্রি নিতে গিয়ে জীবনের অনেকটা সময় চলে যায়। এই সাহসী শিক্ষার্থীদের জন্য আমার দোয়া থাকল।