আগামীকাল বাবা দিবস। দিনটি উপলক্ষে বাবাকে শ্রদ্ধা জানাতে পাঠকের কাছে লেখা চেয়েছিল ‘ছুটির দিনে’। আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে লেখা পাঠিয়েছেন বিপুল পাঠক। নির্বাচিত একটি লেখা পড়ুন এখানে।

‘সবার বাবা বাপ, আমার বাবা বাপরে বাপ।’ বরেণ্য লেখক শচীন ভৌমিকের সঙ্গে আমারও বাবাগত মিল আছে। শুধু কি তা–ই, আমার শৈশবে বাবা ছিলেন ঠিক দঙ্গল সিনেমার সেই গানের মতো, ‘বাপু সেহেদ কে লিয়ে তু তো হানিকারক হ্যায় (বাবা স্বাস্থ্যের জন্য তুই ক্ষতিকারক)।’ কী অপূর্ব সংযোগ ভাবা যায়!
আমার বাবা, যিনি রূপকথার দৈত্য হয়ে আমার হেসেখেলে ছুটে চলা, উড়ে চলা, পঙ্খিরাজ শৈশবকে নিমেষেই ঘাসখেকো গাধাতে পরিণত করতে পারতেন তাঁর আগুনদৃষ্টি দিয়ে। রবি ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়, অমন চোখ যার আছে, তার আর কথা বলার দরকার কী?
বাবা কথা কম বলেন। শুধু কথা কেন, মুখের আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কর্যক্রম হাসি, আমার বাপরে বাপের সেটাও সবিশেষ। তিনি ‘সাইলেন্সার’। তাঁর অট্টহাসিতেও কেবল তাঁর শরীর দোলে আর মৃদু সুঁই সুঁই শব্দ। ব্যস।
তাঁর পরিমিত আয়ের মতোই তাঁর পরিমার্জিত স্বভাব। বাহুল্যবর্জিত তিনি সামাজিকতায় এবং আচরণেও। কিন্তু চাঁদের কলঙ্কের মতো তাঁর ছিল অতলান্তিক তেজ। তাঁকে ভয় পায় না, পরিচিত মহলে এমনটা বিরল। ছোটবেলায় আমি ও দিদি তাঁকে ‘হুতাশন’ ছদ্মনামে ডাকতাম।
তিনি কেবল রাগী নন, অনুরাগীও। বাবা শিক্ষক। বিদ্যানুরাগী। তাঁর এই অন্তঃপ্রাণ বিদ্যানুরাগে আমাদের জীবন ওষ্ঠাগতপ্রাণ হয়ে যেত প্রায়ই।
তিনি আমাদের সব সময় বলতেন, লেখাপড়া না করলে মানুষ হতে পারবে না। তাঁর কাছে লেখাপড়া হলো সেই পরশপাথর, যার স্পর্শে মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে। তাই আমাদের পড়ালেখার প্রতি আগ্রহী করতে তিনি নির্মম পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন। তিনি উদ্ধৃতি দিয়ে বকা দিতেন। তাঁর কিছু উদ্ধৃতি একেবারেই আনকমন ছিল। যেমন তিনি বলতেন, আমি এমন বাবা, প্রয়োজনে ‘তপ্ত খাওয়াব, রক্ত হাগাব’। এরূপ অনেক কঠিন কথার ঝাঁজে মাখামাখি ছিল আমাদের শৈশব।
আমাদের লেখাপড়ায় সামান্য অনীহায় তিনি চোখে ভূত দেখতেন। রেগে বলতেন, অন্যের সন্তানকে আমি মানুষ করছি, আমার সন্তান অমানুষ হবে? তা হতে দেব না। দরকার পড়লে তুলসীগঙ্গা নদীতে কেটে ভাসিয়ে দেব।
আমি বরাবর কল্পচারী। কল্পনায় দেখতে পেতাম, বাবা একটি ধারালো ছুরি দিয়ে আমার গলা কাটছে আর পাশে আমার মেধাবী বড় বোন দাঁড়িয়ে কাঁদছে এবং বলছে বোনকে মেরো না, ছেড়ে দাও। আমি মেধাবী ছিলাম না কখনোই। তাই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগে থেকেই আধমরা হয়ে থাকতাম বাবা আমাকে মেরে ফেলবে সেই ভয়ে।
খেলার সাথিদের বাবারা যখন তাদের নিয়ে টিভি দেখতে বসতেন, তখন আমার বাবা কোন বিষয়ে হায়েস্ট নম্বর থেকে কত কম পেয়েছি, তার হিসাব করতেন। তাঁর চোখের আগুনে ভিজেছে আমার শিশুচোখ আর ঝাপসা হয়েছে আলিফ লায়লা, সিন্দবাদ, রবিনহুডরা।
কী দুঃসহ ছিল সে সময়! তীব্র ক্ষোভ হতো আমার মহাতেজস্বী বাবার ওপর। তখন ভেবেছি ভালো করে পড়ালেখা করে চলে যাব বাড়ি ছেড়ে। প্রাণপণে বড় হতে চেয়েছি বাবার শাসন থেকে মুক্তির জন্য। এখন আমি বড় হয়েছি—উচ্চতায়, বয়সে, জীবনের শিক্ষায়। বাবার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য বড় হতে গিয়ে উপলব্ধি করেছি বাবার শাসন ছাড়া সন্তানের সুষম বিকাশ অসম্ভব। বাবা হলো সূর্যের মতো তীব্র, দীপ্যমাণ; প্রাণশক্তি। সামনে থেকে বিকশিত করবে, দূরে থেকে ভরসা দেবে।
তাঁর থেকে দূরে সরে গেছি একটু একটু করে জীবনের গতিতে আর তাঁকেও দেখেছি চরম মার্তণ্ড থেকে সুশীতল চন্দ্রমায় রূপান্তরিত হতে। বড় হয়েছি যত তত তাঁকে বুঝতে পেরেছি। সময়ের আবর্তে তাঁর কটুকথা মহৌষধ হয়ে ক্ষত সারিয়েছে বারবার। কঠিন সময়ে তিনি সমারসেট মমের সেই বিখ্যাত উক্তি বলেন, ‘লাইফ ইজ নট আ ফ্যাবল, নট আ ফর্মুলা, ইট ইজ ফুল অব প্যারাডক্সেস।’
জালাল উদ্দিন রুমি বলেছেন, আলো দিতে হলে আগে নিজেকেই পুড়তে হয়। এমনই একজন মানুষ যিনি নামে আলো-কর্মে আলো, যা তিনি জীবন পুড়িয়ে অর্জন করেছেন। তাঁকে বলতে চাই এই মহিমান্বিত পৃথিবীতে আমার এই তুচ্ছ জীবনে পরমার্থ হলো তোমার থেকে পাওয়া জীবনবোধ। আমি এক সূর্যকন্যা কারণ আমার বাবা আলোর উৎস, রবি; রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল। ধন্যবাদ বাপী, তুমি তুলসীগঙ্গা নদীতে কেটে ভাসাতে চেয়েছিলে বলেই জীবন আমাকে ডোবাতে পারেনি।
কত ঝঞ্ঝা, কত খরা, রৌদ্রজ্বালা জীবনের বাঁকে আছড়ে পড়ে মুষড়ে দিয়ে গেছে কিন্তু টলাতে পারেনি কারণ তুমি আছ জীবনীশক্তি হয়ে। আরও অনেক পথ বাকি...