নর্থ সাউথে ফার্মেসি নিয়ে পড়েছেন, এখন কেমব্রিজের গবেষক

প্রি–ক্লিনিক্যাল ড্রাগ-ডিসকভারি সায়েন্টিস্ট এবং ইউনিভার্সিটি অব লেস্টারের প্রভাষক—দুই পরিচয়েই পথ পাড়ি দিচ্ছেন রাসিখ ওয়াদুদ। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক। পড়ুন তাঁর পথচলার গল্প।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রাসিখ ওয়াদুদ
ছবি: রাসিখ ওয়াদুদের সৌজন্যে

২০০৯ সালে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগে ভর্তি হই। দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই মেধার ভিত্তিতে ২৫ শতাংশ বৃত্তি পেতে থাকি। চতুর্থ বর্ষে এই বৃত্তি ৭৫ শতাংশে পৌঁছায়। পড়ালেখার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি ক্লাবের সহসভাপতি হিসেবেও নেতৃত্ব দিয়েছি। সহপাঠীদের নিয়ে বিভিন্ন একাডেমিক ও সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনার অভিজ্ঞতা আমার শিক্ষাজীবনটাকে উপভোগ্য করেছিল।

ব্যাচেলর শেষে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসসিতে ভর্তি হই। ইঁদুর-মডেলে ক্রিসপার প্রযুক্তি ছিল আমার গবেষণার বিষয়।

ইচ্ছা ছিল পিএইচডিটাও যুক্তরাজ্যে করব। কিন্তু সে সময় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের বৃত্তির অঙ্কটা খুব বেশি ছিল না। মোট ব্যয়ের মাত্র ১০-১৫ শতাংশ মাত্র বৃত্তি থেকে আসত। উচ্চ টিউশন ফি, জীবনযাত্রার খরচ—সব মিলিয়ে সামলে ওঠা বেশ কঠিন হয়ে যেত। অগত্যা আংশিক অর্থায়নের সঙ্গে আপস না করে দেশে ফিরে আসি। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতেই প্রভাষক হিসেবে যোগ দিই। নর্থ সাউথের আধুনিক ল্যাব সুবিধা ও সিনিয়র সহকর্মীদের সহায়তায় গবেষণাপত্র প্রকাশ করি, ফলে আমার একাডেমিক প্রোফাইল আরও একটু পোক্ত হয়।

সেই পোর্টফোলিওই আমাকে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল সায়েন্স বিভাগে পিএইচডির সুযোগ করে দেয়। এবার আর আংশিক নয়, পূর্ণ বৃত্তি। গত সাত বছরে শিক্ষা ও শিল্প—দুই খাতেই সমানতালে কাজ করেছি। প্রি–ক্লিনিক্যাল ড্রাগ-ডিসকভারি সায়েন্টিস্ট এবং ইউনিভার্সিটি অব লেস্টারের প্রভাষক—দুই পরিচয়েই পথ পাড়ি দিয়েছি। বর্তমানে কেমব্রিজে একই বিভাগে প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর হিসেবে গবেষণা করছি। পথটা সরল নয়, প্রতিটি ধাপই আমাকে নতুন জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়েছে।

ইউনিভার্সিটি অব লেস্টারের স্কুল অব হেলথ কেয়ার ও ফার্মেসি বিভাগে প্রভাষক ও সায়েন্স লিড হিসেবে কাজ করতে গিয়ে আমাদের দেশের সঙ্গে এখানকার শিক্ষাব্যবস্থার পার্থক্যটা কাছ থেকে দেখেছি। যুক্তরাজ্যে এম-ফার্ম কোর্সের মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের হাসপাতাল, কমিউনিটি কিংবা জিপি (জেনারেল প্র্যাকটিস) ফার্মাসিস্ট হিসেবে নিবন্ধনের জন্য তৈরি করা। অর্থাৎ ‘ক্লিনিক্যাল’ দিকটিই এখানে গুরুত্ব পায় বেশি। রোগীকে পরামর্শ দেওয়া কিংবা বিভিন্ন দলের সঙ্গে কাজ করার শিক্ষা নেন শিক্ষার্থীরা।

অন্যদিকে আমাদের দেশে ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ হয় মূলত ওষুধশিল্পে। তাই পাঠক্রমে সেই বিষয়গুলোই গুরুত্ব পায় বেশি। ফার্মাকোলজি, ফার্মাসিউটিকস, ফিজিওলজি, ড্রাগ-ইন্টারেকশন—এই মৌলিক বৈজ্ঞানিক মডিউলগুলো দুই দেশেই এক। দেশে ফার্মাসিস্ট লাইসেন্সিং-ব্যবস্থা চালু হওয়াটা একটা ইতিবাচক অগ্রগতি। তবে বড় কয়েকটি হাসপাতাল ছাড়া ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্টের পদ হাতে গোনা; ওয়ার্ডে বা কমিউনিটি ফার্মেসিতে তাঁদের দেখা যায় খুব কম। এসব পদ বাড়লে এবং রোগীকেন্দ্রিক শিক্ষায় জোর দিলে আমাদের স্নাতকেরা আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে পারবে।

বইয়ের মজবুত জ্ঞান নিয়ে যুক্তরাজ্যে আসেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। অনেকে ইতিমধ্যেই গবেষণাপত্রে সহলেখক হয়েছেন। তবু চাকরি বা গবেষণার মাঠে দরকার ‘সফট স্কিল’। এ জায়গাটাতে আমাদের অনেকেরই ঘাটতি আছে। ভালো নম্বর আর কারিগরি দক্ষতা সুযোগের দরজা খুলে দেয়। কিন্তু সেই দরজা খোলা রাখে স্পষ্ট কথা বলা, দলভিত্তিক কাজ আর নেতৃত্বের গুণ। আমি ছাত্রছাত্রীদের বলি—বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠনে যোগ দিন, বিভাগের কাজে হাত লাগান, ছোট ছোট দায়িত্ব নিন। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন, তখন হয়তো এগুলো অগুরুত্বপূর্ণ মনে হবে। কিন্তু কীভাবে একটা তথ্য সহজে তুলে ধরা যায়, কীভাবে একসঙ্গে কাজ করতে হয়, কীভাবে জুনিয়রদের আস্থা অর্জন করতে হয়—এসব আপনি ক্লাসের বাইরেই শিখবেন। কখনো কখনো এগুলো আপনার গবেষণার দক্ষতা কিংবা সাইটেশন সংখ্যার চেয়েও মূল্যবান।