Thank you for trying Sticky AMP!!

পাথরের অরণ্যে

স্বাগত জানাল পাথুরে অরণ্য
স্টোন ফরেস্ট বা পাথুরে বন। প্রায় ২৭ কোটি বছর পুরোনো ক্ষয়িষ্ণু চুনাপাথরের বনটি ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। চীনের দর্শনীয় অনেক স্থানের মতো দেশ-বিদেশের পর্যটকের আগ্রহের জায়গা এখন এই পাথুরে এলাকাটিও। এই স্টোন ফরেস্ট নিয়েই আছে বিয়োগান্ত এক কিংবদন্তি।

জ্ঞান আহরণের জন্য নাকি সুদূর চীনে যেতে হয়। জ্ঞান আহরণ হোক না হোক, সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম চীনের মহাপ্রাচীর দেখার জন্য ছোটবেলা থেকেই ভ্রমণ তালিকায় ছিল দেশটি। অফিস থেকে যখন সুযোগ এল সপ্তাহখানেকের জন্য চীনে যাওয়ার, ভাবলাম এবার শখটা বুঝি পূরণ হলো। কিন্তু সফরসূচি থেকে বেইজিং বাদ পড়ে গেল; ফলে এ দফায় মহাপ্রাচীর দেখার শখের সঙ্গে আপস করতে হলো। তালিকায় যেহেতু কুনমিং নগরী ছিল, সুতরাং পাখির চোখ করলাম স্টোন ফরেস্টকে। চীনে ভ্রমণপিপাসুদের তালিকায় থাকা অসাধারণ এই প্রাকৃতিক নৈসর্গকে ২০০৭ সালে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অনেক গল্প শোনা হয়েছে, এবার চোখ জুড়িয়ে দেখার পালা।

কুনমিং পরিচিত সদাবসন্তের নগরী হিসেবে, অথচ বিমানবন্দর থেকে আমাদের স্বাগত জানাল ঝিরিঝিরি বর্ষণ আর হিম আবহাওয়া। হোটেলে প্রবেশ করেই কয়েকজন মিলে একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে ছুটলাম স্টোন ফরেস্টের পথে। যেতে হবে কুনমিং নগর থেকে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে ইউনান প্রদেশে।

ইন্টারনেট ঘেঁটে জেনেছি, প্রায় ২৭ কোটি বছর পুরোনো ক্ষয়িষ্ণু চুনাপাথরের বনটি ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। চীনের দর্শনীয় অনেক স্থানের মতো দেশ-বিদেশের পর্যটকের আগ্রহের জায়গা এখন এই পাথুরে এলাকাটি। কালের পরিক্রমায় ক্ষয় হতে হতে ছোট ছোট পাথুরে টিলাগুলো এখন দেখতে অদ্ভুত আকার নিয়েছে। যেন শত শত প্রস্তরস্তম্ভের এক গহিন বনটি কোনো জাদুকরের ছোঁয়ায় হঠাৎ পাথরে পরিণত হয়েছে।

ঐতিহ্যবাহী পোশাকে এক চীনা নারী

নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই আমরা পৌঁছালাম। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতেই মনে হলো যেন শত শত প্রস্তরস্তম্ভের এক গহিন বন জাদুর ছোঁয়ায় হঠাৎ পাথরে পরিণত হয়েছে। যত দূর চোখ যায়, তার পুরোটাজুড়েই একই রকম দৃশ্য। প্রস্তরাবৃত বনের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অদ্ভুত সব পাথুরে টিলা চোখে পড়ল। কোনোটা টুপি মাথায় কৃষক, কোনোটা শিশু কোলে দাঁড়িয়ে থাকা নারী, আবার কোনোটা অদ্ভুত কোনো প্রাণীর মূর্তি, কোনোটা মাথার ওপর আক্ষরিক অর্থেই খড়্গের মতো ঝুলে থাকা বিকট প্রস্তরখণ্ড, কোনোটা ভেঙে আরেকটার গায়ে হেলান দিয়ে আছে, যেন টোকা লাগলেই পড়ে যাবে, কোনোটা আবার যেন সুবিশাল কোনো ক্যানভাস। বিশালকায় পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠে দেখলাম সেখানে পর্যটকদের জন্য রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে দিগন্তবিস্তৃত এই প্রস্তর অরণ্যের অনেকটাই দেখা যাচ্ছিল।

নিচে নেমে জর্ডান থেকে আসা এক পর্যটকের সঙ্গে কথা হলো। ভদ্রমহিলা তাঁর ছোট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে এসেছেন; নিজে এর আগে ঘুরে গেলেও এবার এসেছেন মেয়েকে স্টোন ফরেস্ট দেখাবেন বলে। ভেতরে পর্যটকদের জন্য রয়েছে বাহারি আয়োজন। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় দেখলাম স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী গানের তালে নেচে চলেছে একদল ছেলেমেয়ে; পাশেই কয়েকজন উৎসাহী পর্যটক ছবি তুলতে ব্যস্ত। আরেক জায়গায় দেখলাম স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী পোশাক গায়ে দিয়ে ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে; আমার দলের একজন ১০ আরএনবি (চীনা মুদ্রা) দিয়ে রাজকীয় এক পোশাক গায়ে দিয়ে তলোয়ার হাতে ছবি তুলে ফেললেন। পাহাড়ের আনাচকানাচে দেখলাম বেশ কিছু ছোট্ট উপহারের দোকান, যেখানে সুন্দর করে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন রকমের পাথরের তৈরি মূর্তি, অলংকারসহ আরও চমৎকার সব জিনিস! দরদাম করতে গিয়ে টের পেলাম এখানে যা দাম চাওয়া হচ্ছে, তার অর্ধেকের কমে কিনে ফেলা সম্ভব। স্থানীয়দের সবার ইংরেজিতে পারদর্শিতা সমান নয়, সে ক্ষেত্রে সংখ্যা দিয়েই দর-কষাকষি করে চমৎকার কিছু পাথরের তৈরি স্মারক উপহার কিনে ফেললাম!

পাথুরে অরণ্য

এই স্টোন ফরেস্ট নিয়েই বিয়োগান্ত একটা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। সেখানে উঠে ভ্রমণসঙ্গী একজন শোনালেন সে কিংবদন্তি। প্রচলিত গল্পটা অনেকটা এমন, স্থানীয় উই সম্প্রদায়ের এক মেয়ের নাম ছিল আসিমা। সে এককজনকে ভালোবাসত। কিন্তু তার সম্প্রদায়ের কাছে নিজের প্রেমের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। পরে তাকে অন্য আরেকজন ধরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে পালিয়ে আসার পথে এখানেই আসিমা বন্যার পানিতে ডুবে মারা যায় এবং পাথরে পরিণত হয়।

অদ্ভুত ব্যাপার হলো এখানে একটা পাহাড় আছে, যেটাকে আসিমার প্রস্তরমূর্তি বলে মনে করে স্থানীয় লোকজন, দেখলে মনে হয় ঠিক যেন একটা পাহাড় মেয়ে কাঁধে ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আসিমার স্মরণে এখনো স্থানীয় লোকজন প্রতিবছর মশাল উৎসব পালন করে। আর আসিমাকে বলা হয় নিজের পছন্দে বিয়ের অধিকার ও সুখের প্রতীক।

আসিমার কিংবদন্তি শুনে সে পাহাড় দেখার কাজটিও সেরে নিয়েছিলাম।