উত্তাল পদ্মায় কায়াক চালিয়েছেন ইনতিয়াজ মাহমুদ
উত্তাল পদ্মায় কায়াক চালিয়েছেন  ইনতিয়াজ মাহমুদ

পদ্মা নদীতে কায়াক চালিয়ে রাজশাহী থেকে চাঁদপুর গেছেন ইনতিয়াজ, পথে কোথায় থেকেছেন, কী খেয়েছেন

পদ্মা নদীতে কায়াক চালিয়ে রাজশাহী থেকে চাঁদপুর। ১০ দিনে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। পথে পথে কত অভিজ্ঞতা। তারই কিছু শোনালেন ইনতিয়াজ মাহমুদ

আমি পর্বতপ্রেমী মানুষ। জীবনের বড় একটা সময় পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে কাটিয়েছি। কিন্তু এ দেশে অত পর্বতই বা কই? ভারত-নেপাল এমনকি বান্দরবানের পাহাড়ের নাগাল পাওয়াও যখন দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে, তখনই মাথায় আসে নদী। নদীর দেশ, তো নদীতে যাই না কেন? ভাবনার পালে প্রথম হাওয়াটা লাগে ২০২৩ সালে, সুনামগঞ্জ গিয়ে। আমি আর বন্ধু মুনীম সেবার সুরমা নদীতে নৌকা চালিয়ে সুনামগঞ্জ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসি। এই অসাধারণ অভিজ্ঞতার পর কায়াকের পোকাটা মাথায় স্থায়ীভাবে ঢুকে পড়ে। অল্প অল্প করে কায়াকের কেরামতি রপ্ত করি। ঢাকার আশপাশের নদীগুলোয় ছোট ছোট কয়েকটা ট্রিপ, কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে অষ্টগ্রাম, কর্ণফুলী বেয়ে কাপ্তাই থেকে চট্টগ্রাম, বুড়িগঙ্গায় সদরঘাট থেকে চাঁদপুর, এভাবে দুই বছর কেটে গেলে পরে পদ্মা নদী নিয়ে স্বপ্ন দেখতে থাকি।

ঠিক করলাম পদ্মায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চাঁদপুর যাব। গুগল ম্যাপসে পুরো রুটটা প্লটিং করে দেখি ৩০০ কিলোমিটারের বেশি পথ। প্রথম ধাক্কাটা ছিল কায়াকের ব্যবস্থা করা। আরও প্রায় মাস দু-তিনেক নানা জোগাড়যন্ত্র করে, গত কোরবানির ঈদের ম্যারাথন ছুটিতে বেরিয়ে পড়ি শেষমেশ। বন্ধু মুনীম আর জিসানকে পটিয়েপাটিয়ে রাজশাহীর একটা লোকাল বাসে চড়ে বসি ১০ জুন। পরিকল্পনা হলো ওরা আমার সহায়তায় থাকবে। মোবাইলে লোকেশন শেয়ার করা থাকবে, আমার কাছাকাছি দূরত্বে থেকে সড়কপথে এগোবে ওরা, আর প্রতি রাতে ক্যাম্প সাইটে দেখা হবে।

পদ্মায় কায়াকিং

প্রথমে চাঁপাই থেকে যাত্রা শুরুর কথা থাকলেও ভারত সীমান্তের দুটি ক্রিটিক্যাল পয়েন্ট পড়ে বলে সে পরিকল্পনা বাদ দিতে হলো। রাজশাহীর আই-বাঁধ থেকে নেমে পড়ি। সামনে কপালে কী আছে, প্রথম দিনেই বুঝে গেলাম। গা ঝলসানো রোদে তেতে ফেটে ছারখার। যমুনার মোহনার আগে পর্যন্ত ওই রোদটাই ছিল মূল প্রতিকূলতা। দুই দিন ওই কাঠফাটা রোদে নাজেহাল হয়ে শিলাইদহ থেকে মুনীমরাও ফেরত যায়। তার পর থেকে শুরু হয় আমার পুরোপুরি একলা পথচলা। যেদিন যেখানে রাত হতো সেখানেই কাত, খাবারদাবার, থাকার ব্যবস্থা। প্রতিদিন কায়াক চালাতাম প্রায় ৮-১০ ঘণ্টা করে। প্রথম দিকে একটু নিরাপত্তা শঙ্কায় ভুগেছিলাম। তবে এক-দুই দিনেই তা উবে গেল।

জেটিতে তাঁবুবাস

পথে পথে জীবন

মানিকগঞ্জে এক দিন বৃষ্টিবিরতিতে এক নদী লাগোয়া বাড়ি থেকে ডাক পাই। উঠানে বসতেই থালাভর্তি খাবার নিয়ে হাজির এক নারী। সেই সকালে আমারও কিছু খাওয়া হয়নি। আগের রাতটা দৌলতদিয়ায় নদীর একদম কিনারে জীর্ণশীর্ণ একটা মসজিদে কাটিয়েছি। কাছে তেমন কোনো দোকানপাট, বাড়িঘর ছিল না। নদীভাঙনে বাড়ি হারানো স্কুল কর্মচারী সোবহান ভাইয়ের ওখানে পাত পড়েছিল। সকালে আর তাঁদের ঝামেলায় ফেলতে চাইনি, না খেয়েই তাই বেরিয়ে পড়েছিলাম। নদীর কিনারে সুবিধাজনক খাবারের দোকান পাওয়া দুষ্কর। একা বলে কায়াক ফেলে একটু দূরে কোথাও গিয়ে কিছু কিনে আনাও মুশকিল। এমন দিনগুলোয় ইনস্ট্যান্ট নুডলস, বাদাম আর চকলেটই ভরসা। তাই মমতাময়ী ওই নারীর আতিথেয়তায় আমি অবাক এবং বিব্রত। চকচকে চোখেমুখে থালাটা হাতে নিই। মুখ দেখেই উনি হয়তো আমার পেটের হাল বুঝেছিলেন।

চরে বিরতি

খাওয়ার পর তাঁদের গল্প শুনি। সামনে থাকা সবারই অন্তত একবার হলেও পদ্মায় বাড়ি ভেঙেছে। আমার এই চাচির ভেঙেছে চারবার। বাঁধের প্রকল্পও এদিকে তেমন জোরালো নয়। একেবারে পাড়াগ্রাম, কাছেপিঠে বড় স্থাপনাও কিছু নেই, ওদের হয়ে তাই বলারও কেউ নেই। বছর বছর দু-দশটা বালুর বস্তা ফেলেই তাই কর্তব্য শেষ করে কর্তৃপক্ষ। হারানো বাড়ি আর চাষের জমির কথা বলতে গিয়ে এক সময় কেঁদে ফেলেন চাচি। অন্যের জমিতে বাড়ি হারিয়ে আশ্রিতের মতো আছেন। এই বাড়িটাও এই মৌসুম টিকবে কি না, কে জানে। তাঁর ছেলে ইটভাটার শ্রমিক। খেয়ে না–খেয়ে পেলে–পুষে বড় করা একটা গরু মারা পড়ল এবার। কদিন আগে স্বামীও মারা গেছেন। এখন নিজের প্রহর গুনছেন। এই উদার অথচ হতদরিদ্র নারীর জীবনের গল্প শুনে নিজেকে অনেক ছোট মনে হতে লাগল। নিজের-নিজেদের কথা ভেবে কেমন জানি অপরাধবোধ হতে লাগল। জানি এতে কিছুই আসে যায় না, কিছু বদলাবেও না। তবু ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে আমার হাত চলছিল না। উজানভাটির মানুষের এই চাপাকান্না এত কাছ থেকে আগে কখনো শুনিনি। কায়াক থামিয়ে তাই পদ্মার কুলকুল জলরাশির দিকে চেয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ।

এ অভিযান আমার কাছে যতটা পদ্মা দেখা, ততটাই কাছ থেকে পদ্মার মানুষকে জানাবোঝা। কুষ্টিয়ায় নদীর ধারে গানের আসর, জেলেদের সঙ্গে মাছ ধরা নৌকায় সময় কাটানো, শিলাইদহে রাতে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে চিংড়ি ধরা, ড্রেজারে আতিথ্য, দিগন্তজোড়া সবুজ প্রান্তরে বটের ছায়ায় মধ্যাহ্নভোজ, কত কত চিত্রবিচিত্র অভিজ্ঞতা! প্রতিদিন বিকেল থেকে ম্যাপে দেখতাম, কোথায় কী আছে। যেতে যেতে নদীর কিনারে থাকার জায়গা খুঁজতাম। প্রতিদিনই কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যেত। সবচেয়ে সুন্দর রাতটা কাটিয়েছিলাম বোধ হয় পাবনার মালিফা গ্রামের পাশে একটা ড্রেজারে। কতগুলো নিপাট ভালো মানুষ আর নদীর মধ্যে একটা তীব্র মায়াময় চাঁদনী রাত।

পথে অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে

এ এক অবাধ দুনিয়া

আমার এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল পদ্মার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কায়াকিং করে আরও বড় একটা অভিযানের জন্য অভিজ্ঞতা অর্জন। পাশাপাশি পদ্মার রূপ-রঙে গা ভাসানো। রুট ছিল রাজশাহী, ভেড়ামারা, শিলাইদহ, পাবনা, দৌলতদিয়া, মৈনটঘাট, লৌহজং, সুরেশ্বর, চাঁদপুর। এ যাত্রায় পার হয়েছি পদ্মাচরের নানা গোলকধাঁধা, দীর্ঘ জনবিরল পথ আর যমুনা-পদ্মা ও পদ্মা-মেঘনার দুটি বড় মোহনা। প্রথমার্ধে আত্মা তাতানো রোদ পেরিয়ে গন্তব্যের কাছাকাছি এসে পেলাম পদ্মার ঝড়ে উন্মাদ উত্তাল রূপ, সকাল-সন্ধ্যা টানা বৃষ্টি। রাজশাহী থেকে চাঁদপুর আসতে আমার মোটমাট সময় লেগেছে ১০ দিন, ১০ থেকে ১৯ জুন। নয় দিন কায়াকে, এক দিন ফাঁকিবাজি। মাঝখানের আটটা রাত আটটা ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় কাটিয়েছি। কখনো কারও বাড়ি, তো কখনো মসজিদ-মাদ্রাসা, পাড়ার ক্লাবঘর, ড্রেজার, বাল্কহেড, বাঁধের কন্সট্রাকশন সাইট। কিন্তু এই সবকিছু ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত যেটা মনে দাগ কেটে রইল তা হলো, পদ্মাপাড়ের মানুষ আর তাঁদের নিঃস্বার্থ আতিথেয়তা, এখানে-ওখানে পাওয়া অকৃত্রিম ভালোবাসা, নদীপাড়ের কচি–কাঁচাদের উচ্ছ্বাস আর পদ্মার গাঢ় নীল রং। প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথে অন্তত তিন শ রকম মানুষের সঙ্গ পেয়েছি। টিভি–খবরের কাগজের হিংসা হানাহানিতে মত্ত দেশ না, যেন অন্য এক দুনিয়ায় চলে গিয়েছিলাম। না জানি কী হয়, মনের এই সদা ভয় আস্তে আস্তে কেটে গেছে। কবে-কোথায় কে ধরে, কে মারে, সব শঙ্কা উড়িয়ে নিল পদ্মার উত্তাল হাওয়া। বদলে মনের জমিতে জমা পড়ল অনেক অনেক রঙিন স্মৃতির পলি।