
এক সন্ধ্যায় লালমনিরহাটের বন্ধু নাসিরুল আলম মন্ডলকে ফোনে ধরলাম, ‘আর কত দিন মাস্টারি করবেন, ভাই? শুধু খাওয়া, ঘুম আর চাকরি করার জন্য তো আমাদের জন্ম হয় নাই, চলেন বের হই।’
কোনো প্রশ্ন নয়, কোনো অজুহাত নয়, স্কুলশিক্ষক বন্ধু একবাক্যে রাজি, ‘ভাই, কখন রওনা দেব?’
মন্ডল ভাইকে রওনা দিতে হবে না। আমিই বরং ঢাকা থেকে তাঁর কাছাকাছি কুড়িগ্রামে চলে যাব। তারপর সেখান থেকে ভারত সীমান্ত ধরে চলতে থাকব। পরিকল্পনা শুনে মন্ডল আনন্দিত চিত্তে বাইক রেডি করতে লেগে গেলেন।
৩০ নভেম্বর কুড়িগ্রামে পৌঁছালাম। সাতসকালে ট্রেন থেকে নেমেই দেখি, মন্ডল ভাই মোটরসাইকেল নিয়ে হাজির। শুরু হলো আমাদের যাত্রা।
চিলমারী নদীবন্দরে পৌঁছে সকাল ৯টায় রৌমারীর নৌকায় উঠে পড়লাম। রৌমারী ঘাটে পৌঁছাতে লাগল দুই ঘণ্টা। এই পুরো সময় চোখের সামনে ব্রহ্মপুত্রের যৌবন দেখেছি। যমুনা সেতুর কাছে যে ব্রহ্মপুত্র শীর্ণ, শুষ্ক, সেই ব্রহ্মপুত্রই এখানে বিশাল, বিস্তৃত। তার বুকে জমেছে অনেক চর। পানিও একেবারে টলটল করছে। এমন দিক-দিশাহীন ভরভরন্ত ব্রহ্মপুত্রের দেখা পাব, চিন্তাও করিনি।
রৌমারীর যে এলাকায় প্রথম ভারত সীমান্ত সড়ক স্পর্শ করলাম, তার নাম ‘দাঁতভাঙা’! এই এলাকার ছেলেমেয়েরা পরীক্ষার হলে প্রশ্নের যে জবাব দিত, সেটাই সম্ভবত ‘দাঁতভাঙা জবাব’! পরীক্ষার কথা আসতেই কয়েক কিলোমিটার সামনে দেখলাম ‘ডিগ্রির চর’। এই গ্রামের সবাই কি ডিগ্রি পাস! পরে শুনলাম, এই পথে নাকি ঝগড়ার চর এবং মানুষ মারার চরও আছে। কাজেই এলাকার নামের চিন্তাকে আর বাড়তে না দিয়ে জাদুর চরের পাশ দিয়ে হুস করে জাদুমন্ত্রের মতো আমরা চলে গেলাম ধানুয়া–কামালপুর সীমান্তে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই এলাকায় রয়েছে সমাধিসৌধ। সীমান্তবর্তী ধানুয়ায় আছে লাউচাপড়া পর্যটনকেন্দ্র। তবে সেই পর্যটনকেন্দ্র আমাদের বেশি টানেনি, যতটা টেনেছে এখানকার সুন্দর রাবারবাগান আর রাস্তার দুই পাশের সারি সারি মৌচাকের বাক্স! এখানে বেশ কিছু ব্যাপ্টিস্ট চার্চ আছে। সবই সীমান্তঘেঁষা। মন্ডল ভাইয়ের প্রস্তাব, ‘চলেন সব চার্চ দেখব।’
ছায়াটে কুয়াশা ভেঙে সূর্যের আলোর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে একে একে দেখে নিলাম সেন্ট আন্দ্রে ব্যাসেট ক্যাথলিক মিশন, হাড়িয়াকোনা ব্যাপ্টিস্ট চার্চ, দিঘলাকুনা চার্চ, সেন্ট মাইকেল ক্যাথলিক চার্চ, বারোমারি মিশন, তারানি ক্যাথলিক চার্চ, জোকোমকুড়া এডভেন্টিস্ট চার্চ, গারামপাড়া ব্যাপ্টিস্ট চার্চ। আরও কয়েকটায় যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সীমান্তের কাছাকাছি সেসব চার্চে যাওয়ার রাস্তা বেহাল। প্রথম রাতটা আমরা থাকলাম ধানুয়া–কামালপুরে উপজেলা পরিষদের ডাকবাংলোয়।
বিজয়ের মাসের প্রথম দিনে জামালপুরের লাউচাপড়া থেকে শেরপুরের সীমান্তে ঢুকতেই সবুজ শীতল আঁচল বাড়িয়ে আমাদের বুকের মধ্যে টেনে নিল গজনী অবকাশকেন্দ্র। সবুজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার সেই শুরু! একে একে পার হয়ে গেলাম মধুটিলা ইকোপার্ক, কর্ণঝোড়া রাবারবাগান, তাওয়াকুচা শালবন, বালিয়াজুড়ির নিশ্চুপ জঙ্গল, রাংটিয়ার অচেনা বাগান আর লেঙ্গুরার সীমান্তঘেঁষা গাছের সারি। আর সীমান্তের ওপাশ থেকে বয়ে আসা টলটলে নীলাভ সবুজ পানির নদী! ঝকঝকে বালুর চিলাখালী নদী, বুনো ফুলের বিশাল আসর বিছানো মালিঝি নদীর পাড় কিংবা ভোগাই নদের স্বচ্ছ পানিতে ঘুরে বেড়ানো মাছের কথা ভুলে গেলেও কোনোভাবেই নিতাই নদের কথা ভোলা সম্ভব নয়। এত সুন্দর রাস্তায় কোনো বাস বা অন্য গাড়ি না চলার কারণও এই নদে এসে পাওয়া গেল। ইট–সিমেন্টের কোনো সেতুই এখানে নেই। বদলে রয়েছে বাঁশের চাটাইয়ের প্রায় ২০০ মিটার লম্বা একটা অস্থায়ী সেতু, যে সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল আর অটোরিকশা ছাড়া আর কোনো বাহন পারাপার সম্ভব নয়। তারও আবার টোল আছে!
ধুকপুক বুকে চাটাই ব্রিজ পেরিয়ে সৌন্দর্যের অন্য এক দুনিয়ায় এসে পড়া গেল! ঘোষগাঁও থেকে সোমেশ্বরী নদীর আগপর্যন্ত সীমান্ত সড়কটা স্বর্গীয় অনুভূতি দিল। বাঁ পাশে উঁকি মারছে মেঘালয়ের পাহাড়, তার কোল ঘেঁষে মাঠের পর মাঠে উত্তাল বাতাসে দুলছে হলুদ ধান। কোনো খেতে ধান কাটছেন কৃষক। খালি জমিতে চরে বেড়াচ্ছে মহিষ, গরু, ছাগল। এ এক অন্য ভুবন। আমার চেনা পরিবেশের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই!
একটা কালভার্টের ওপর মোটরসাইকেল রেখে দুই বন্ধু হাঁ করে ধানখেত আর পাহাড় গিলছি! অনেকক্ষণ পার হওয়ার পর মনে হলো, আমাদের যাত্রা এখানেই শেষ করা উচিত। কিন্তু মন সায় দিল না। মনে হলো, সোমেশ্বরী আর জাদুকাটা না দেখে ঘরে ফিরব?
সেদিন রাতে থাকার ব্যবস্থা হলো কলমাকান্দায়।
পরদিন ছুট লাগালাম স্বচ্ছ পানির নদী সোমেশ্বরী দেখার জন্য। তার পাশে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে বিজয়পুরের চিনামাটির পাহাড় আর পশ্চিমে গণেশ্বরী নদীর সীমানায় সাত শহীদের সমাধিস্থল। ১৯৭১ সালে নেত্রকোনার কলমাকান্দায় ৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে। তাঁদের একেবারে সীমান্তে এনে সমাহিত করা হয়। সেই থেকেই জায়গাটা সাত শহীদের সমাধিস্থল বলে পরিচিত।
শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সোমেশ্বরী নদীতে গেলাম। ধবধবে সাদা বালুর বুকে পাথরের বহর নিয়ে বয়ে চলা এই নদী মেঘালয়ের সবটুকু স্নিগ্ধতা ধুয়ে এনে ফেলেছে বাংলার কোলে।
নদী পার হওয়ার জন্য কোনো সেতু নেই। মোটরসাইকেলসহ নৌকায় করে পার হতে হয়। জনপ্রতি ভাড়া পড়ে ১০ টাকা। এরপর লেঙ্গুরা হয়ে মহিষখলা বাজার পর্যন্ত রাস্তাটা দারুণ। এই বাজার থেকে হাওরের গন্ধ পাওয়া গেল। এখানে আর ইটের রাস্তা নেই, মাখনের মতো কর্দমাক্ত রাস্তাও নেই; সত্যি বলতে কোনো রাস্তাই নেই! মাটির পথের বিশাল বিশাল গর্ত আর ঝিরি পথের মাঝখান দিয়ে চলতে চলতে আবিষ্কার করলাম, শরীরের বয়স হয়েছে। উথালপাতাল ঝাঁকিতে দুজনের মাথায় ঠোকাঠুকি অবস্থা, হেলমেট ছিল বলে মাথায় ‘আলু’র চাষ হয়নি! গুগল বলেছিল, আমাদের জন্য এখানে মোলায়েম রাস্তা অপেক্ষা করছে। আমরা ব্যাকুল চোখে মিনিটের পর মিনিট খুঁজলাম সেই স্বপ্নসড়ক। পেলাম ঘোড়ার আস্তাবল, গরুর গোয়াল আর ছাগল চলাচলের গ্রাম্য রাস্তা! পরে গ্রামবাসী জানালেন, এটাই সেই ‘গুগল–ভূগোল’ রাস্তা, প্রতি বর্ষায় যা এমন তালগোল পাকিয়ে যায়। বিশাল গাছঘেরা এই মেঠো পথে হুট করে মোটরসাইকেল থামিয়ে মন্ডল ভাই ঘোষণা দিলেন, জগতের সব শান্তি এখানে, তিনি এখানে ৩০ মিনিট ঘুমাবেন!
আমি গিয়েছিলাম পানির খোঁজে। এসে দেখি, সত্যি সত্যি লাল টুকটুকে একটা হ্যামক দুই গাছে ঝুলিয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন মন্ডল ভাই। তাঁর নাক ডাকার শব্দে পাশের না কাটা সোনালি ধানের শিষগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে! বার তিনেক ডেকে রণে ভঙ্গ দিলাম, পাহাড় ভেঙে সমান করা সম্ভব, মন্ডলের ঘুম নয়!
এরপর সূর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা ছুটেছি সুনামগঞ্জের টেকেরঘাট বারিক্কা টিলা, শহীদ সিরাজ লেক, জাদুকাটা নদী আর শিমুলবাগানের সীমান্তে। জাদুকাটা নদীতে গোসল করে যে শান্তি পাওয়া যায়, দুনিয়ার কোনো বাথটাবে সেটা সম্ভব নয়! জাদুকাটার রূপের বর্ণনা দেওয়াও সম্ভব নয়, বারিক্কা টিলা থেকে দিগন্তে উঁকি দেয় যখন জাদুকাটা, তখন প্রত্যেক মানুষের হৃৎপিণ্ডের একটা স্পন্দন থমকে যায়! এ কোন অপরূপা! মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জির হাজার ঝরনার সব পানি এই পথে এসে ঢুকেছে বাংলাদেশে। বর্ষায় এখানকার পাহাড়েই জন্ম নেয় শত ঝরনা। আর শীতের জাদুকাটা? সে কাব্য করার বিষয়!
রাতটা শহীদ সিরাজ লেকের পাড়ে কাটিয়ে পরদিন ফিরতি পথ ধরলাম।