আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে উঁচু পর্বত কিলিমানজারোতে গিয়েছিলেন ইফতেখারুল ইসলাম। পর্বত আরোহণ ছাড়াও তানজানিয়ায় জাতীয় উদ্যানে সাফারি করেছেন তিনি। এ সফরের গল্প নিয়েই আমাদের ধারাবাহিক আয়োজন। আজ পড়ুন পঞ্চম কিস্তি।
ট্রেকের দ্বিতীয় দিন, মানে ৩০ জুলাই আমাদের গন্তব্য ক্যাম্প শিরা-১। রাতে সময়মতো ঘুমিয়েছি বলে ভোরে এমনিতেই আমার ঘুম ভেঙে যায়। তারপরও আরেকটু ঘুমিয়ে নিতে ইচ্ছা করে। ঘুম না এলেও আরেকটু শুয়ে তো থাকা যায়। না, এখানে সে উপায় নেই। কেউ একজন তাঁবুর বাইরে থেকে আমাকে ডাকছে। আগের রাতেই আমাদের বলে রাখা হয়েছে পৌনে ছয়টায় ওঠার জন্য ডাকা হবে। ছয়টায় তাঁবুতেই সবার জন্য চা দিয়ে যাবে ওরা। তারপর সকালের সব কাজ সেরে ফ্রেশ হয়ে সাড়ে ছয়টায় ব্রেকফাস্ট করতে যেতে হবে মেস টেন্ট বা খাবারের তাঁবুতে। সাতটায় পথে নামতে হবে। ট্রেকিং শুরু করতে হবে পরের গন্তব্যের উদ্দেশে। আমাদের যাত্রা শুরুর পর তাঁবু, কিচেন, ডাইনিং, টয়লেট সব গুটিয়ে নিয়ে যাত্রা শুরু করবে পোর্টাররা।
প্রতি বেলায় এরা কিচেন টেন্টে খাবার রান্না করে সেগুলো গরম অবস্থায় পরিবেশন করে। ব্রেকফাস্টে পোরিজ দেওয়া হয়। তারপর এক বা দুই টুকরা পাউরুটি আর ডিমের অমলেট। ওটমিল বা পোরিজ আমার প্রিয় খাবার নয়। এত বছরের মধ্যে কোথাও এ জিনিস খাইনি। কিন্তু কিলিমানজারো ট্রেকে প্রতিদিন সকালে পোরিজ খেলাম। শুধু অনুরোধ করেছিলাম আমাকে যেন একটু কম, মানে আধা বাটি পোরিজ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে নিজের তৈরি এক মগ কালো কফি শেষ করে আমি পথে নামি।
আজ সকালে যে ট্রেইল ধরে ট্রেক করছি তা ধীরে ধীরে খাড়া হয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। সকালে রেইন ফরেস্টে থাকলেও কিছুক্ষণ পরেই আমরা জায়ান্ট হিদার মুরল্যান্ড অঞ্চলে প্রবেশ করি। বিশাল প্রান্তরজুড়ে অপরূপ পুষ্পময় ঘাসের বন। চারদিকে জায়ান্ট হিদার, জায়ান্ট গ্রাউন্ডসেল ও জায়ান্ট লোবেলিয়া। এই খোলা প্রান্তরে পৌঁছেই কিলিমানজারো পর্বত ও তার চারপাশের প্যানোরমিক দৃশ্য দেখতে পাই আমরা। শিরা রিজ ধরে উঁচুতে উঠে যাই।
এখানকার কাকগুলো আকারে বেশ বড়। গলার পেছনে সাদা রং। আমাদের কাছাকাছি ঘুরে বেড়ায়, মানুষ দেখলে একদমই তোয়াক্কা করে না। রেইন ফরেস্ট পেরিয়ে এসেছি, গাছের ধরন, আকৃতি, রং—সব বদলাতে শুরু করেছে। পথে মুরল্যান্ড পার হওয়ার সময় নানা রঙের ফুল দেখা হলো। ছয়-সাত রকমের এভারলাস্টিং ফ্লাওয়ার—সাদা, কুসুম রঙের, হালকা গোলাপি। আমাদের গাইড হাওয়া বলছিল, এই ফুলগুলো অনেক দিন টিকে থাকে, তাই এর নাম এভারলাস্টিং ফ্লাওয়ার। রেইন ফরেস্টে কে যেন আমাকে একটা মিন্টের মতো সুগন্ধিযুক্ত পাতা এনে দিল। একটু আঙুলে ঘষে দেখি সত্যিই তো পরিচিত গন্ধ। কিন্তু তা মিন্ট নয়। কর্পূর। ইস্ট আফ্রিকান ক্যামফর। আজকের বনপথে বেশ কয়েকটা ঝিরির দেখা পেয়েছি। আর কত রকমের যে ফুল, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
প্রথম দিনের ট্রেকে অরণ্যের ভেতর চলার সময় ধীরে ধীরে ওপরে উঠেছি। তেমন কোনো খাড়া চড়াই পার হতে হয়নি। দ্বিতীয় দিন কিছু চড়াই পার হতে হয়। পাহাড়ে উঠি, একটা করে চড়াই পেরোই। তারপর সামনে এগিয়ে দেখি আরেকটা পাহাড় সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এবারে তাকে ডিঙাতে হবে। সকাল থেকে বিকেল অবধি ক্রমাগত এটাই আমাদের কাজ। গুটি গুটি পায়ে হেঁটে এগোই। ফুল-পাতা-পাখি দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। গাইড তাড়া দিলে আবার এগোই।
কিছুক্ষণ পরপর গাইড আমাদের বিরতি দেয়। পথে কখনো অণু তারেককে দেখি কোনো গাছের পাশে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। কোথাও মাহবুব ভাই খুব আয়েশ করে শুয়ে-বসে পোর্টেবল স্পিকারে বা ফোনে গান শুনছেন মনের আনন্দে। অণু প্রতিদিন ভালো ভালো ছবি তুলে ফেসবুকে দেয়। মাহবুব ভাই সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের ছবি তুলতে ভালোবাসেন বেশি।
তরুণ ও দীর্ঘদেহী অণু স্বভাবতই স্বচ্ছন্দ গতিতে হেঁটে হেঁটে ওপরে উঠে যায়। মাহবুব ভাই বয়সে বড় হলেও তাঁর ফিটনেস দারুণ। তিনি দ্রুত হাঁটেন। মাঝেমধ্যেই থেমে ছবি তোলেন, বিশ্রাম নেন। আনিস ভাই আর শাহাব ভাই দুই বন্ধু হাঁটেন পাশাপাশি। ধীর কিন্তু দৃঢ় ও ক্লান্তিহীন তাঁদের পদক্ষেপ। আমিন ভাই বেশির ভাগ সময় আমার কাছাকাছি, সামনে বা পেছনে। মাহফুজা মিষ্টি, ওয়াসিক, জাকির, সাদমান, জুঁই, লিজা ও অন্য তরুণেরা ইচ্ছেমতো কখনো দ্রুত ও কখনো ধীরে হাঁটেন। অন্য আপারা হাঁটেন নিজ নিজ গতিতে। তাঁদের সঙ্গে আছে গাইড। আমাদের তরুণ ডাক্তার অপু ইচ্ছা অনুযায়ী গতি কমিয়ে বা বাড়িয়ে বড় আপুদের সঙ্গ দেন।
পাঁচ বছর ধরে এত ট্রেক করে, এত প্রস্তুতি নিয়েও হাই অলটিটিউডে ট্রেক করার সময় আমি অল্পতেই হাঁপিয়ে যাই। ক্লান্ত হয়ে পাথরে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিই, সঙ্গে আনা খেজুর, প্রোটিন বার বা অন্য কোনো খাবার খাই। সারাক্ষণ যার যার পানির বোতল থেকে পানি খাই আমরা। আমার ব্যাকপ্যাকে আছে হাইডরেশন প্যাক। সেখানে সকালে দুই লিটার পানি নিয়ে যাত্রা শুরু করি। পাইপটা মুখের কাছে থাকে পানি পান করার জন্য। সারা দিনে এ পানি শেষ করতেই হবে, তার সঙ্গে লাঞ্চ–ডিনারের পানি, চা ও অন্যান্য সবকিছু মিলে হয়তো তিন লিটার পূর্ণ হবে। ওই উচ্চতায় অক্সিজেন পেতে হলে এবং উচ্চতাজনিত অলটিটিউড সিকনেস (উচ্চতাজনিত অসুস্থতা) এড়াতে হলে দিনে তিন লিটার পানি খেতেই হবে।
বেশ কিছুটা ওপরে উঠে শিরা রিজ থেকে আবার কিছুটা নামতে হয়। তারপর একটা ছোট পাহাড়ি নদীর পাশে আমাদের আজকের ক্যাম্প। পাঁচ ঘণ্টা হেঁটে আট কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছাই সেই ক্যাম্পে। ক্যাম্প শিরা-১।
প্রতিদিন চোখের সামনে ভূ–প্রকৃতি বদলে যায়। রেইন ফরেস্ট, মুরল্যান্ড তৃণভূমি, আলপাইন মরুভূমি, এরপরে পাথুরে পথ আর সবশেষে হয়তো শুরু হবে বরফের রাজ্য। বেশ সমতল ঘাসের বনের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় আমাদের আজকের তাঁবুবাস। দূর থেকে কয়েকবার এই ক্যাম্প দেখেছি। পার্বত্য পথে চলার সময় একটু উঁচু থেকে তাঁবুগুলোকে খুব কাছে মনে হয়। উত্সাহ নিয়ে কিছুটা হেঁটে যাওয়ার পর দেখি সামনে নতুন প্রান্তর ও পাহাড়। তাঁবুগুলো আবার দূরে সরে যায়।
একপর্যায়ে দেখি ঘাসের বনের একদম মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি। অল্প দূরে আমাদের তাঁবু। ঘাসের বনের ভেতরে পথ খুঁজে নিতে নিতে ভাবি, এই কি সেই ‘পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস’। ঘাসে ছাওয়া পথের মাঝখান থেকে কিলিমানজারোকে চমৎকার দেখায়। আমি সোজা হেঁটে আমাদের তাঁবুতে পৌঁছে যাই। অণু জানাল, আসলে আরও খানিকটা ডান দিকে গিয়ে এই ক্যাম্পের ছোট্ট অফিস ঘরে খাতায় নাম ও পাসপোর্ট নম্বর লিখে আসতে হতো। সেটা একটু পরে করব। অণুকে বলি, এখানে এই ঘাসের বনে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। ভাবছিলাম এই কি সেই ‘পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস’। আমাকে অবাক করে দিয়ে অণু বলল, ‘...দুয়ার চেপে ধরে—অবনী বাড়ি আছো’।
এ জন্যই আমাদের এই দলটাকে ভালো লাগছে। কিলিমানজারোর প্রান্তরে দাঁড়িয়ে একটা কবিতার মাঝখান থেকে তুলে নেওয়া ওই তিনটি শব্দ শুনে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতাটার কথা মনে করতে পারবে, এ রকম মানুষ তো খুব বেশি নেই।
শেষ বিকেলে অস্তগামী সূর্যের আলোয় মায়াবী সাজে সেজে ওঠে কিলিমানজারো। পর্বতের রং বদলায়। ঘাসের প্রান্তরের ওপারে দেখি লাল কিলিমানজারো। সন্ধ্যার পর শীত তীব্র হয়। গাইডরা আমাদের কাছে এসে বলে যায় ডাউন জ্যাকেট পরে থাকতে। বেশির ভাগ তাঁবুতে দুজন করে থাকি আমরা। আর কোনো কোনো তাঁবুতে একজন। যাঁরা একা থাকবেন তাঁদের রাতের ঠান্ডার ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে যায় গাইড। কয়েক স্তর শীতের কাপড় পরেই শুতে হবে। ভালো করে বন্ধ রাখতে হবে স্লিপিং ব্যাগের জিপার। (চলবে)