
উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলাই ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। প্রাচীন নগরী, শত শত বছরের পুরোনো উপাসনালয়, আদি আমলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শাসকদের স্থাপনা—কী নেই এই অঞ্চলে।
‘আপা, এখনো জাদুঘরে?’
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের এক কর্মকর্তার প্রশ্নে সংবিৎ ফিরে পাই। তাই তো, সেই কখন ঢুকেছি! ঘড়িতে দেখি, প্রায় চার ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। অথচ এখনো অনেক কিছু দেখা বাকি!
২০২৪–এর ডিসেম্বরের শুরুতে গিয়েছিলাম রাজশাহী। জাদুঘরটি ঘুরে মনে হলো, বাংলাদেশের জাদুঘরটি শুধু প্রতিষ্ঠার দিক থেকেই প্রথম নয়, প্রত্নসম্পদ ও সমৃদ্ধিতেও সেরা। হবে নাই–বা কেন। রাজশাহীর ইতিহাস কি আজকের! রেশম চাষে রাজশাহীর খ্যাতি একসময় বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। রেশম চাষের জন্য আঠারো শতকের দিকে এই অঞ্চলে এসেছিল ওলন্দাজরা। রাজশাহী শহর ও শহর থেকে অদূরে সারদা পুলিশ একাডেমিতে ডাচ স্থাপত্যের অল্প কিছু নিদর্শন এখনো রয়ে গেছে। আছে ফরাসি নীলকুঠি, ইংরেজ নীলকুঠির কিছু ভবন। মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন বাঘা মসজিদ, পুঠিয়া রাজবাড়ি দেখে যেকোনো পর্যটকই আপ্লুত হবেন। তবে রাজশাহী নগরীর পুরোনো খ্রিষ্টান সমাধিভূমি দেখতে ভুলবেন না।
রাজশাহীর মতো উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলাই ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। আর আমার কাছে তো গোটা উত্তরবঙ্গই বাংলাদেশের ‘হেরিটেজ জোন’। কী নেই এই অঞ্চলে—প্রাচীন নগরী, শত শত বছরের পুরোনো উপাসনালয়, আদি আমলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শাসকদের স্থাপনা।
সর্ব–উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের কথাই ধরা যাক। গোলকধাম মন্দির চত্বরে গিয়ে ১০ মিনিট হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম। মনে হচ্ছিল, আগে চোখ ভরে দেখে নিই। আবার এই জেলারই আটোয়ারীতে অবস্থিত মির্জাপুর জামে মসজিদ দেশের মোগল স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন।
ঠাকুরগাঁওয়ের ঐতিহ্য ভ্রমণের কথা উঠলেই প্রথম মনে পড়ে রানীশংকৈলের গোরকুই গ্রামের বেলেপাথরের কূপের কথা। এই জেলায় আরও আছে ছোটবালিয়া জামে মসজিদ, শালবাড়ি মসজিদ ও ইমামবাড়া, জামালপুর জমিদারবাড়ি জামে মসজিদ, রানীশংকৈল জমিদারবাড়ি বা রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি, হরিপুর জমিদারবাড়ি বা হরিপুর রাজবাড়ি, হরিণমারী শিবমন্দিরসহ আরও কিছু প্রাচীন গড় ও দুর্গের ধ্বংসাবশেষ।
কান্তজিউর মন্দির ও রামসাগরখ্যাত দিনাজপুর হেরিটেজ ট্যুরিজম বিকাশের জন্য একটি আইকনিক শহর। হাজার বছরের প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ইতিহাস নিয়ে এই জেলার সেতাবগঞ্জের সতীমন ডাঙ্গীর কথা সাধারণ পর্যটকেরা জানেন না বললেই চলে। সেখানে একটি বিরল বুদ্ধমূর্তি রাখা আছে। বুদ্ধের স্থানীয় নাম সতীমন ডাঙ্গী। দিনাজপুরের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য হলো সীতাকোট বিহার। দেশে যে কটি বৌদ্ধবিহার আছে, সেগুলোর মধ্যে সীতাকোট বিহারকে সবচেয়ে প্রাচীন ধরা হয়। এর নির্মাণকাল ধরা হয় খ্রিষ্টীয় পাঁচ শতক।
রংপুরের ঐতিহ্য ভ্রমণে মাহিগঞ্জের তাজহাট জমিদারবাড়ি সবার তালিকাতেই থাকে। বাড়িটির নির্মাণশৈলীর সঙ্গে ঢাকার আহসান মঞ্জিলের মিল রয়েছে। তারপর রয়েছে মন্থনা জমিদারবাড়ি। স্থানীয়ভাবে যেটি পীরগাছা জমিদারবাড়ি নামে পরিচিত। মন্থনার জমিদার জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন। আরেক মহীয়সী নারী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মভূমি মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ গ্রাম। তাঁর বসতভিটার খণ্ড খণ্ড ভবন ও কিছু দেয়াল এখনো রয়ে গেছে। রংপুরে আছে শত বছরের পুরোনো কারমাইকেল কলেজ।
প্রচলিত ধারণা, নীলফামারী নামের সঙ্গে নীল চাষের সম্পর্ক আছে। হয়তো একদম অমূলকও নয়। নীলফামারীর ছয়টি উপজেলার মধ্যে সৈয়দপুরের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। আসাম-বেঙ্গল রেলওয়েকে কেন্দ্র করে ১৮৭০ সালে ইংরেজরা এখানে প্রতিষ্ঠা করে রেলওয়ে কারখানা, আজও যা বাংলাদেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা। ১৮৮২ সালে সৈয়দপুরে প্রতিষ্ঠিত দ্য ইউরোপিয়ান ক্লাব বর্তমানে মুর্তজা ইনস্টিটিউট।
‘ভাওয়াইয়া গানের ধাম, নদ-নদীময় কুড়িগ্রাম’, জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের স্লোগানটিতে বোঝা যায়, ভাওয়াইয়া গান আর নদীবিধৌত অঞ্চল হিসেবে কুড়িগ্রামের খ্যাতি রয়েছে। এই জেলা শহরের তিনটি জিনিস দারুণ অভিভূত করেছে—জাহাজবাড়ি, পরিত্যক্ত বিশ শতকের ভবন আর পুরোনো রেলস্টেশন।
কুড়িগ্রামের পাশের লালমনিরহাট রেলওয়ে স্টেশনের প্রায় ১১৭ বছরের পুরোনো কাঠের একটি সিঁড়ি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। একই রকমভাবে গাইবান্ধায় বৌদ্ধবিহার আছে শুনেই অবাক হয়েছিলাম। বোগদহ বৌদ্ধবিহারকে স্থানীয় মানুষেরা বলেন ঢিবি। গাইবান্ধার আরেকটি প্রাচীন স্থান হচ্ছে বিরাট নগর।
রাজা জয়পালের নাম থেকে হয়েছে জয়পুরহাট। খঞ্জরপুরে রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে পাঁচবিবি উপজেলার করিয়া গ্রামে লকমা জমিদারবাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।
নওগাঁর ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লুকিয়ে আছে ইতিহাস। ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট সোমপুর বা পাহাড়পুর মহাবিহার, জগদ্দল বিহার, হলুদ বিহার, গরুড় স্তম্ভ, মঙ্গলবাড়ি শিবমন্দির, মাহিসন্তোষ দুর্গ, কুসুম্বা মসজিদ পাল যুগ ও মুসলিম যুগ, তথা বাংলার সুপ্রাচীন ইতিহাস বহন করে। এই জেলায় প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলোর পাশাপাশি রয়েছে দুটি প্রাচীন দিঘি—একটির নাম আলতা দিঘি, অন্যটি দিবর দিঘি।
প্রাচীন বাংলার রাজধানী মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের স্মৃতিভূমি বগুড়া। দেশের প্রাচীনতম নগরগুলোর অন্যতম পুণ্ড্রনগর মহাস্থানগড়ের ভূগর্ভে ঘুমিয়ে আছে। শিবগঞ্জের ভাসু বিহারের অবস্থান মহাস্থানগড় থেকে চার কিলোমিটার দূরে। স্থানীয়ভাবে এটিকে বলে নরপতির ধাপ। ভাসু বিহার মূলত দ্বিতল, ত্রিতল অথবা চারতল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। সাত শতাধিক বৌদ্ধ পণ্ডিত এখানে শিক্ষা গ্রহণ করতেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ছোট সোনা মসজিদ, তাহখানা সুলতানি আমলের মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের মনকাড়া এক নিদর্শন। এ ছাড়া আল মসজিদ-উল-জামে, দারাস বাড়ি মাদ্রাসা, শাহ নেয়ামত উল্লাহর মাজার, তিন গম্বুজ মসজিদ, খানিয়া দিঘি মসজিদ, নওদার বিচিত্র সমাধিসৌধ, কানসাট জমিদারবাড়ি, নাচোলের আলপনা গ্রাম।
গঙ্গা–করতোয়ার মধ্যবর্তী বরেন্দ্র অঞ্চলের বিখ্যাত জেলা নাটোর। কাঁচাগোল্লা, উত্তরা গণভবন, রানি ভবানী আর জীবনানন্দের কিংবদন্তি বনলতা সেন নাটোরকে সবিশেষ খ্যাতি দিয়েছে। পাবনায় গেলে ঢুঁ মারতে হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আর চাটমোহরে অবস্থিত প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো জগন্নাথ হান্ডিয়াল মন্দিরে।
সিরাজগঞ্জকে বলা হয় উত্তরের প্রবেশদ্বার। সিরাজগঞ্জ ভ্রমণকালে সবার আগে যে নামটি আসে, সেটি হলো শাহজাদপুরের রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি। হাটিকুমরুলের নবরত্ন মন্দিরটি দেখলেই দিনাজপুরের কান্তজিউর মন্দিরের কথা মনে পড়ে।
এত সব প্রাচীন স্থাপত্য আর নিদর্শন রয়েছে উত্তর বাংলায়। যদি উত্তরবঙ্গকে বাংলাদেশের হেরিটেজ জোন ঘোষণা করা হয়, তবে খুব শিগগির বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে এর সমৃদ্ধি।