কখনো বরফ, কখনো ঝুম বৃষ্টি, কখনো মিষ্টি রোদ—দেখুন একই জায়গার ১২ মাসের ১২ রূপ

দেশ থেকে কানাডায় আসার পর খুব মন খারাপ থাকত সাখাওয়াত হোসেনের। ম্যানিটোবা অঙ্গরাজ্যের উইনিপেগে তাঁর বাসার পাশ ঘেঁষেই বয়ে গেছে সেইন নামের ছোট্ট এক নদী। মন খারাপ হলেই সেই নদীর ধারে গিয়ে বসতেন। এমনই একদিন একটা গাছের সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁর। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রকৃতি পরিবর্তনের সময়ই এই গাছের বদলে যাওয়া রূপ চোখে পড়ল সাফাত নামে পরিচিত এই তরুণ আলোকচিত্রীর। হুট করে মনে হলো, বছরচক্রে এই গাছের সঙ্গে প্রকৃতির নানা রূপের বদলে যাওয়া ছবি তুলে রাখলে কেমন হয়? সেই ভাবনা থেকেই শুরু করলেন গাছের বছরচক্রের ছবি তোলার। ১২ মাসের ১২ ছবিতে দেখুন সেই গল্পই।

এপ্রিল

প্রথম ছবিটা তোলা এপ্রিল মাসে। উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটির একপর্যায়ে দেখলাম, বরফ সব গলে গেছে, কানাডা গুজ বা কানাডা রাজহংসী ফিরে এসে নদীতে মনের আনন্দে সাঁতার কাটছে। হুট করেই দৃশ্যটা ভালো লাগে, কিন্তু পরেরবার হাঁটতে গিয়ে কী আবিষ্কার করব, সেটা তখনো আমার ভাবনায় আসেনি
ছবি: সাখাওয়াত হোসেন

মে

খুব সম্ভবত মে মাসের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহে তোলা ছবি এটা। ধূসর-মরা গাছ ভেদ করে সবুজ ঘাস নিজেদের রাজত্ব করে নিচ্ছে সদর্পে, গাছটাও সবুজে ভরে উঠেছে, সামনে নদীর জল ছুঁইছুঁই গাছেও দেখা দিয়েছে সবুজ পাতা। হঠাৎ করে দেখলে সত্যিই বোঝার উপায় থাকে না যে প্রকৃতির রূপের পরিবর্তন সবকিছু এত বদলে দিতে পারে। এই সময়ই জায়গাটার বছরচক্র শুরু করার ভূত মাথায় চাপে

জুন

জুন, বছরের সবচেয়ে বড় দিন। উইনিপেগে এই সময় সূর্যাস্ত হয় প্রায় রাত ১০টায়। সূর্যালোক বেশিক্ষণ পেয়েই কি চারদিকে এত প্রাণের সঞ্চার হয়? নদীর ধার ঘেঁষে জংলা বাড়তে থাকে, গাছগুলোও তরতরিয়ে বড় হতে থাকে। এই সময়টায় সত্যিই বিশ্বাস করা কঠিন যে এই জায়গাটাই একসময় বরফের সাদা চাদরে ঢাকা ছিল

জুলাই

বৃষ্টি এখানে ঠিক বাংলাদেশের মতো ঝমঝমিয়ে আসে না। কেন যেন এখানে বৃষ্টি এলেই আমার স্ত্রী শিখা আর আমি খুঁজতে বসি যে আজকের বৃষ্টিটা বাংলাদেশের মতো। তেমনই এক ঝুম বৃষ্টির দিন ছাতা মাথায় চলে গেলাম ছবি তুলতে। জুলাই মাস আবার বাংলাদেশের শ্রাবণ মাসের শুরু। মিল খুঁজছিলাম বলেই কি না জানি না, জুলাইয়ের জন্য প্রিয় বৃষ্টির ছবিটাই পেয়ে গেলাম

আগস্ট

আগস্ট। সামারের শেষ কটা দিন, যতটা প্রাণভরে সবুজ দেখা যায়, যতটা সময়টা উপভোগ করা যায়—সেই বার্তাটাই মনে আসে তখন বারবার। সবুজের শেষ কটা দিনের একদিনই তুলে রাখলাম আমার বছরচক্রের ডায়েরিতে

সেপ্টেম্বর

সামনের পাতা ঝরে যাওয়া গাছটা দেখেই সেপ্টেম্বরের ছবি তুলতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। পেছনের গাছটাও হলুদ হতে শুরু করেছে একটু একটু করে। মে মাসে যেমন সবুজ পাতা নিজেদের রাজত্ব গড়ে নিচ্ছিল, এবার যেন সেই রাজত্ব আবার ধূসর ঘাসের হাতে তুলে দেওয়ার পালা

অক্টোবর

প্রকৃতি পরিবর্তনের ধাক্কাটা ঠিক মে মাসের মতো অক্টোবরে এসেও খুব ভালোভাবে লাগল। গত মাসের সবুজ-হলুদ গাছটা পুরোটাই হলুদে রূপ নিয়েছে তখন। সবুজ ঘাসের সংখ্যাও যেন হাতে গোনার মতো। শীত আসি আসি করছে...

নভেম্বর

তুষারপাত শুরু হয়ে গেল নভেম্বরে। এখানে যে একটি নদী কিংবা পানির অস্তিত্ব আছে, সেটা ভুলিয়ে দিতেই পুরো নদীই যেন শুভ্র-সাদা চাদরে ঢাকা পরছে। ছবিতে ঠিক বোঝা যাচ্ছে কি না জানি না, কিন্তু যখন এই ছবি তুলছিলাম, তখন একটু একটু করে ঘাসগুলো বরফে ঢেকে পরেছে, দেখতে কেমন যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিল

ডিসেম্বর

ডিসেম্বরের তীব্র ঠান্ডায় যেন গাছটাও কাবু হয়ে গেছে। বরফ জমা হতে হতে ধূসর ঘাসও ঢাকা পরে যাচ্ছে। গাছের ডালপালা, পাতায় সাদা বরফ জায়গা করে নিয়েছে

জানুয়ারি

বরফের যেন আর শেষ নেই। সবকিছু বরফের চাদরে মুড়িয়ে দিয়ে আগামী কয়েক মাস শুভ্রসাদা বরফই হবে সবকিছুর রাজা, জানুয়ারির ছবি আর তাপমাত্রা দুটোই এই কথাই বলে

ফেব্রুয়ারি

বরফের স্তূপ জমা হতে হতে এতটাই শক্ত হয়ে গেছে যে হেঁটে নদী পার হওয়া কোনো ব্যাপারই না। ফেব্রুয়ারির ছবি তুলতে গিয়ে জুতার ছাপগুলো যেন সেই কথাই বারবার মনে করিয়ে দেয়। এই সময়টার মজার একটা স্মৃতি হলো, গাড়ি কেনার পর প্রথম গাড়ি নিয়ে গেলাম নদীর ধারে। কিন্তু সেই খুশি খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; কারণ, সেখান থেকে আসার পরপরই ঠান্ডায় গাড়ির ব্যাটারি বসে গিয়েছিল

মার্চ

মার্চ মাস, তাপমাত্রা একটু একটু করে বাড়তে থাকা আর বরফ একটু একটু করে গলার সময়। দুটোই চলতে থাকে সমানতালে। পাখিরাও ফিরে আসছে বসন্তের আগমনী ঘ্রাণ পেয়ে