উচ্চতার দিক থেকে দশম হলেও পর্বতারোহীদের মৃত্যুর হার বিবেচনায় বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্বত অন্নপূর্ণা-১। এভারেস্ট ও লোৎসে জয়ের পর এবার তার চূড়ায়ও পা রেখেছেন বাবর আলী। রুদ্ধশ্বাস সেই অভিজ্ঞতাই ‘ছুটির দিনে’র পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিলেন বাংলাদেশের এই পর্বতারোহী।

৬ এপ্রিল বিকেল ৪টা ১০। নর্থ অন্নপূর্ণা হিমবাহের ৬ হাজার ৪০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থান করছি আমরা। অতি উচ্চতা এবং নিম্ন তাপমাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় ধড়াচূড়া গায়ে-পায়ে চাপিয়ে সামনের দেয়ালপানে আমাদের চলা শুরু হলো। ওই বরফের দেয়ালের মাথাই পৃথিবীর দশম উচ্চতম পর্বত অন্নপূর্ণা ১-এর চূড়া। সে চূড়ায় পৌঁছাতে আমাদের পাড়ি দিতে হবে আরও প্রায় ১ হাজার ৭০০ মিটার। পাহাড়ি পথের দূরত্ব কিংবা দুর্গমতা এভাবে বোঝানোটা বেশ মুশকিল। দুর্গম দুর্গের মতো পথ রুখে দাঁড়িয়ে থাকা অন্নপূর্ণা ম্যাসিফের (পাশাপাশি জড়াজড়ি পাহাড়ের সমষ্টি) মধ্য দিয়ে পথ করে এগোতে হবে। দড়িতে জুমার (আরোহণে সহায়ক সরঞ্জাম) লাগানোর সময়েই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছি, এই দড়ির শেষ দেখতে হবে। দড়ির শেষ মাথা তখনো চূড়া পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন অগ্রবর্তী দল। আগের বিকেলের ভারী তুষারপাত থামিয়ে দিয়েছিল তাঁদের গতি।
প্রথমেই পথ আগলে দাঁড়াল বিকট-দর্শন এক তুষারফাটল। সেফটি আর জুমারের সাহায্যে সেটি পেরিয়েই সামনে পড়ল বরফের দেয়াল। ব্লু আইসের (নীল রঙের অতীব শক্ত বরফ) ওপর ক্রাম্পনের খচরমচরকে সঙ্গী করে পথচলা। বুট আর ক্রাম্পনের ওপরেই প্রশ্নহীন আনুগত্য দেখাতে হবে আজ। একের পর এক বরফের ঢাল পেরিয়ে এগিয়ে চলছি। এর মধ্যেই দিনের আলো নিভে ঘনিয়ে এল সন্ধ্যার আঁধার। সূর্যের আলোর বদলে এবার হেডল্যাম্পের বৃত্তাকার আলোয় চলতে হবে। বৃত্তাকার ওই আলোতেই সীমাবদ্ধ দৃষ্টিসীমা। বিশাল এই পর্বতের গা বেয়ে ঘুরে-বেঁকে পথ চলছি। আমার সঙ্গী ফুর্বা অঙ্গেল শেরপা। পোশাকি পরিচয় ক্লাইম্বিং গাইড। আমার কিছুটা সামনেই আছেন পর্বতারোহণ জগতের কিংবদন্তি সানু শেরপা। ফুর্বার বড় ভাই। বিশ্বে ৮ হাজার মিটার কিংবা ততোধিক উচ্চতার শৃঙ্গ আছে ১৪টি। এসবে একবার করে আরোহণ করাটাই অতিমানবীয় এক কাজ। সেখানে সানু শেরপা করেছেন দুবার করে। এ কৃতিত্ব আর কোনো মানবসন্তানের নেই। এটি তাঁর তৃতীয় আবর্তন। এই আবর্তনে অন্নপূর্ণাও আছে। সমীহ ভরে তাঁর চলা দেখছি। ৮ হাজার মিটারের জগৎটাই আলাদা। এই পাতলা বাতাসের রাজ্যের হিসাব-নিকাশ একেবারেই অনন্য। সাবধানী পদক্ষেপে চলতে হয় পথ। চূড়ায় ওঠার পথে সব শক্তি নিঃশেষ করে ফেললেই সর্বনাশ। ঠিকঠাকভাবে নিচেও যে নামতে হবে। এ ধরনের উঁচু পর্বতে কোথায় থামতে হবে, এটা জানাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আরোহণের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। পর্বতের কাঁধ বেয়ে উঠতে উঠতে সানুর কাছ থেকে সেসবই শিখে নেওয়ার চেষ্টা করছি।
পরের ঢালটার মাথায় চড়ে আবিষ্কার করলাম এখানেই এক কোণে ৪ নম্বর ক্যাম্প। উচ্চতা ৬ হাজার ৯০০ মিটার। ক্যাম্পে ছড়ানো-ছিটানো আছে গোটা তিনেক তাঁবু। সঙ্গে কবরের নিস্তব্ধতা। তাঁবু ছাড়িয়ে আবার বরফের ঢাল। আগে ৭ হাজার ৪০০ মিটারে ৪ নম্বর ক্যাম্প ছিল। সেটাই শীর্ষারোহণ শিবির হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তবে পথের দুর্গমতা, তুষারধস আর পাথর খসার ঝুঁকির জন্য আজকাল কোনো পর্বতারোহীই ওই ক্যাম্পে সময় কাটাতে চান না। রাত কাটানো তো দূরের কথা, বিশ্রামের জন্যও না। কে খামোখা হাঁড়িকাঠে বলির পাঁঠা হিসেবে মাথা পেতে দিতে চায়? বদলে অপেক্ষাকৃত নিচু এই জায়গাটায় ক্যাম্প করেন কিছু কিছু পর্বতারোহী। যেসব পর্বতারোহী মনে করেন তাঁদের চলার গতি ধীর, তাঁরাই মূলত এই ক্যাম্পে রাত কাটান। তুষারধস আর ওপর থেকে পাথর খসে পড়ার মতো মূর্তিমান ঝুঁকি এখানেও আছে।
একের পর এক চড়াই, বিরাম নেই, অনন্ত। একটা যায় তো ভীমদর্শন আরেকটা সামনে আসে! আর এসব চড়াইয়ের মাঝে মাঝেই আছে নানা আকৃতির তুষারফাটল। কোনোটা পেরিয়ে, কোনোটা এড়িয়ে সামনের দিকে চলছি। মিনিট পেরিয়ে যায়, মিনিট ফুরিয়ে ঘণ্টা, পথ আর ফুরোয় না। এ পথের কি শেষ নেই? এই আঁধারের পর কোনো ভোর কি আর আসবে না? মাথায় ঘুরছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ‘পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি, সোজা পথের ধাঁধায় আমি অনেক ধেঁধেছি!’
কায়মনোবাক্যেই যদিও পথ হারাতে চাই না। আমাদের বেশ কিছুটা ওপরেই জ্বলছে দুই আরোহীর হেডল্যাম্প। প্রেতচক্ষুর মতো দেখতে ওই দুই হেডল্যাম্পকে আপাতলক্ষ্য মেনে এগোচ্ছি। টানা পথচলার ক্লান্তিতে মাপা নিশ্বাসে দৃঢ় পদক্ষেপ ক্ষণে ক্ষণে শিথিল হতে শুরু করেছে। মাঝে একবার জিরিয়ে নিয়ে বোতল গলায় উপুড় করে ধরতেই আবিষ্কার করলাম, থার্মোসের কঠিন আবরণী ভেদ করেও পানিকে শক্ত বরফ বানিয়ে ফেলেছে ঠান্ডা। গলায় ঢালার আর জো নেই। অগত্যা নিজের থুতুতেই মুখের ভেতরটা ভেজাতে হলো।
রাতভর চলার পরে সামনের পাহাড়টার ওপার থেকে ধীরে ধীরে উঁকি দিতে শুরু করল ভোরের সূর্য। কুয়াশার কারণে চূড়া দেখতে না পারার আশঙ্কা থেকে নিমেষেই মুক্তি দিল চরাচর উদ্ভাসিত করা রবির কিরণ। আমরা হিমজব্দ পর্বতারোহীরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেতে শুরু করলাম। একই সঙ্গে আবিষ্কার করলাম, চূড়া আর আমাদের মাঝখানের দূরত্বও এখন আর খুব বেশি না। দৃষ্টিসীমাতেই আছে লক্ষ্য। কিন্তু হায়! দৃষ্টি যত সহজে অভীষ্টে যেতে পারে, পা দুটো তো তত সহজে পারে না। এই অতি উচ্চতায় তো আরও না। শরীর আর কাঁধের ব্যাকপ্যাকের তাবৎ ওজন বহন করে তবেই তো তাকে এগোতে হয়। তখনো কে জানত দৃষ্টিসীমায় থাকা চূড়াকে কাছে পেতে সময় লাগবে আরও কয়েক ঘণ্টা। শরীরে-মনে তখন জেঁকে বসেছে রাতভর পথচলার শ্রান্তি। সব ইচ্ছাশক্তি একত্র করে দিতে হচ্ছে একেকটা পদক্ষেপ। অগ্রবর্তী দলের অগ্রগতিও অতি ধীর। সঙ্গী ফুর্বারও একই অবস্থা। নানান প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার ছুতায় নিজেরাই থামছি বারবার। অতি ধীরে গড়াচ্ছে সময়। আমরাও তুষারের নরম বলের মতো অতি আস্তে গড়িয়ে গড়িয়ে নামার বদলে উঠছি। চূড়ার শেষ দিকটায় আবার কয়েকটা পাথুরে সেকশন আছে। ক্রাম্পন পায়ে, শ্রান্ত ফুসফুসে সেসব পেরোনো আরেক প্রাণান্ত কসরত। এই অংশটুকু বেশ পরীক্ষায় ফেলল। অবশ্য পর্বতের কাজই পরীক্ষা নেওয়া! ঠিকঠাক সমর্পিত হতে জানলে তবেই তাকে ছোঁয়ার অনুমতি পাওয়া যায়।
শেষ ঢালে দাঁড়িয়ে চূড়াটা নিয়ে নানান কাব্যি মাথায় আসছিল। ব্লু আইস নামক পাষাণ বরফে ক্রাম্পন গেঁথে যখন সত্যি সত্যি চূড়ায় দাঁড়ালাম, তখন কাব্য উড়ে গেছে; চোখের সামনে শুধু ঘোর বাস্তবতা। ক্যাম্প ৩-এর আপাতনিরাপদ আশ্রয় তাঁবু থেকে বেরোনোর পর পেরিয়ে গেছে সাড়ে ১৭ ঘণ্টা। কিন্তু এ কী চূড়া! দুজন মানুষও ঠিকঠাক দাঁড়াতে পারে না! বিশ্বের দশম সর্বোচ্চ পর্বত অন্নপূর্ণা-১ নামক ৮ হাজার ৯১ মিটার উঁচু পর্বতটার চূড়া মূলত একটা গিরিশিরার উঁচু বিন্দু। দুটো অতীব খাড়া ঢাল চূড়ায় এসে মিশেছে। আর দুই দিকে বুক কাঁপিয়ে দেওয়া অতলান্ত খাদ। একটু এদিক-ওদিক হলেই সোজা কয়েক হাজার ফুটের পতন। ব্যাপারটা চোখে আঙুল দিয়ে একবার দেখিয়ে দিতে গিয়েই যেন ফুর্বার হাত ফসকে ওর ফোনটা হারিয়ে গেল অতলান্তে! পা ফসকালে মুহূর্তে অমন পরিণতি আমাদেরও হবে—এই ভাবনাটাই মেরুদণ্ড বেয়ে সরীসৃপ নেমে যাওয়ার অনুভূতি দিয়ে গেল।
পর্বতচূড়ায় আরোহণের পরের অনুভূতিটুকু হলো—এখান থেকে দ্রুত নামা দরকার। তারপরও অন্যান্য চূড়ায় উঠে কিছুটা সময় কাটিয়েছি। কিন্তু অন্নপূর্ণাচূড়ায় ৫ মিনিটের বেশি কাটানোর সাহসই হলো না। ওই সময়ে বুভুক্ষুর মতো চারপাশের ভূদৃশ্য চোখ দুটোতে বন্দী করতে শুরু করলাম। পরে চোখ দুটো মুদলেই যেন এই জায়গায় আসতে পারি—এই তো চাওয়া! এরপর ফোনের ক্যামেরার স্মৃতিতে কিছু ছবি জমা করেই ফিরতি পথ ধরলাম। সামনে গত রাতের পেরিয়ে আসা বিশাল পথ।