কিশোরদের মধ্যে আজকাল বেশ আলোচিত শব্দ পিয়ার প্রেশার। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সাধারণত বন্ধু বা সহপাঠীদের চাপে কিছু করাকে পিয়ার প্রেশার বোঝায়। একজন ব্যক্তি এখানে এমন কিছু করতে বাধ্য হয়, যেটা শুধু অন্যরা তার কাছে আশা করছে বলে সে করে। সাধারণত কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা এ ধরনের চাপে পড়ে দিশাহারা হয়ে যায়। অনেকে ভুল পথে পা বাড়ায়।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জোবায়ের মিয়া বলেন, ‘পিয়ার প্রেশার মূলত কিশোর বয়সের ছেলে–মেয়েদেরই বেশি প্রভাবিত করে। এটি এমন একটি অবস্থা, যেখানে তারা কখনো বন্ধুদের জোরাজুরিতে, কখনো প্রভাবিত হয়ে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করে ফেলে। এই “কিছু করা”র মধ্যে ভালো–মন্দ দুটোই ঘটে। তবে ভুল কিছু করে ফেলার প্রবণতাই পিয়ার প্রেশারের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দিক।’
ঢাকার একটি নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ফারহান (ছদ্মনাম) মনে করে, পিয়ার প্রেশারে যে সব সময় জোর করা হয়, তেমনটা না, কিন্তু প্রভাবিত করা হয়। যেটা মন থেকে করতে চাই না, একবার এমন একটি কাজ বন্ধুদের প্রভাবে করে ফেলেছিলাম। স্কুলে না গিয়ে সেদিন বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি, প্রথম ধূমপান করেছি। পরে বাবা–মা জানতে পেরে খুব মন খারাপ করেছিল। এরপর নিজেরও মনে হয়েছে, আমি কেন এটা করেছি!’
সাধারণত মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার বয়সে এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ে সন্তানেরা। তাই সেখানে ভুল করার প্রবণতা বেশি থাকে। এই বয়সে বন্ধুদের অনেক বেশি কাছের মনে হয়। কিন্তু যখন ভুল পথে পা বাড়ায়, দিন শেষে পরিবারই আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানদের মধ্যে সেই ভরসার জায়গাটা তৈরি করা অভিভাবকদের জন্য জরুরি বলে মনে করেন মনোবিদেরা।
একজন ব্যক্তির চলার পথে নানা রকম বন্ধু হতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ভুল–ঠিক বুঝতে শেখে। প্রথম জীবনে (কৈশোরে) যেহেতু ভুল করার প্রবণতা থাকে, তাই পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্ব খুব জরুরি। সন্তান যেন মা–বাবাকে সব বিষয়ে খুলে বলতে পারে, এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। নতুন বন্ধু তৈরি হওয়ার সময় কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব দেবে, সেসব বোধ শিশুর মধ্যে গড়ে দেওয়া ভালো।ডা. মো. জোবায়ের মিয়া, সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
অনেক সময় পিয়ার প্রেশারের বিপরীতে দাঁড়ানো কঠিন হতে পারে। কিন্তু তারপরও মনোবল রেখে বন্ধুদের সুন্দর করে না বলা শিখতে হবে।
এই পর্যায়ে পরিবারের দারুণ ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন মনের বন্ধুর মানসিক স্বাস্থ্য প্রোগ্রামের প্রধান ও লিড মনোবিজ্ঞানী কাজী রুমানা হক। এই মনোবিজ্ঞানী বলেন, ‘পিয়ার প্রেশার মোকাবিলায় পরিবারের ভূমিকাই প্রধান। পরিবার থেকেই শিশুকে কোনো বিষয়ে না বলতে পারায় অভ্যস্ত করতে হয়। নানা কারণে বাড়িতে সন্তান যখন না বলে, এটা বাবা–মাকে শুনতে হবে। না বলাও যে স্বাভাবিক আচরণ হতে পারে অনেক অভিভাবক সেটা মানতে পারেন না। অথচ শিশুর না বলার কারণটা যৌক্তিক হলে সেটা মেনে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুললে বাইরেও শিশু নিজের মতামত প্রকাশে উৎসাহ পায়।’
তবে না বলতে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করা যাবে না। এই পর্যায়টিকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘অ্যাসার্টিভ কমিউনিকেশন।’ অর্থাৎ কাউকে আঘাত না দিয়ে সুন্দরভাবে নিজের মতামত অন্যকে বোঝানো।
কাজী রুমানা হকের পরামর্শ হলো—সন্তান নিজে যে আচরণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সেটা অন্যদের বোঝাতে পারতে হবে। নিজের অবস্থানের পক্ষে যথাযথ কারণ ও দৃঢ়তা থাকতে হবে।
অনেক সময় বন্ধু হারানোর ভয়ে এই বয়সীরা না বলার চেয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেটা মেনে নেওয়াকে সহজ মনে করে। আর তাই সেখান থেকে ভুল পথে পা বাড়ানোর আশঙ্কা তৈরি হয়।
পিয়ার প্রেশারে পড়ে কিশোর বয়সে প্রেমের সম্পর্কে জাড়ায় নবম শ্রেণির এক ছাত্রী। যশোরের একটি বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াকালে তিনি প্রেমে জড়িয়েছিলেন বান্ধবীদের চাপে পড়ে। সেই ঘটনার চার বছর পর সম্প্রতি তিনি অধুনার ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে একটি চিঠি পাঠান। সেই সূত্র ধরেই কথা হলো তাঁর সঙ্গে।
বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমি ক্লাসে সেরা ছাত্রী ছিলাম। বান্ধবীরা সবাই তখন প্রেম করে। যে কারণে কোথাও গেলেই তারা প্রেমিকদের সঙ্গে আড্ডা দিত। শুরুর দিকে আমি তাদের সঙ্গে গেলেও পরে আর যেতে চাইতাম না। এরপর তারা আমাকে প্রেম করার জন্য জোর করতে থাকে। একসময় আমারও মনে হলো, বন্ধুদের সঙ্গে থাকতে চাইলে এটাই ভালো বুদ্ধি। এই প্রেমের কারণেই আমার এসএসসির ফল খারাপ হয়েছিল। আমি নানা রকম মানসিক চাপের মধ্যে পড়েছিলাম। এখন প্রেম থেকে বেরিয়ে বেশ ভালো আছি।’
ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘বান্ধবীদের হারানোর ভয়ে সেই সময় আমি যে ভুল পথে গিয়েছিলাম, সেটা বুঝেছি নিজের ক্ষতি হওয়ার পর। সেই বান্ধবীরাও মাধ্যমিকের পর আর একসঙ্গে নেই। কিন্তু পরিবার এখনো আমার সঙ্গে আছে। তাই পিয়ার প্রেশার সামলাতে নিজের বুদ্ধি ও পরিবারের সাহায্য জরুরি বলে আমার মনে হয়েছে।’
বিবিসির এক প্রতিবেদন বলছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুল বদলানো, বন্ধু বদলানো খুব স্বাভাবিক বিষয়। তাই বন্ধুদের আচরণ যদি বেশি ভুল মনে হয়, তাদের সঙ্গ ত্যাগ করাই ভালো।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জোবায়ের মিয়া বলেন, ‘একজন ব্যক্তির চলার পথে নানা রকম বন্ধু হতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ভুল–ঠিক বুঝতে শেখে। প্রথম জীবনে (কৈশোরে) যেহেতু ভুল করার প্রবণতা থাকে, তাই পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্ব খুব জরুরি। সন্তান যেন মা–বাবাকে সব বিষয়ে খুলে বলতে পারে, এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। নতুন বন্ধু তৈরি হওয়ার সময় কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব দেবে, সেসব বোধ শিশুর মধ্যে গড়ে দেওয়া ভালো।’
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ—যদি পিয়ার প্রেশারের চাপ সামলানো কঠিন হয়ে যায়, তবে নিজেকে বাঁচাতে যৌক্তিক অজুহাত খুঁজে নিতে পারো। তারা যদি তোমার সত্যিকার বন্ধু হয়, তাহলে তোমার দিকটাও বুঝবে। অনেক সময় তোমার পরিবার এটা জানলে রাগ করবে টাইপ অজুহাতে বন্ধুদের কাছে বরং হাসির পাত্র হতে পারো। তারা টিপ্পনী কেটে ‘ফ্যামিলি ম্যান’ বলে খেপাতে পারে। তাই তোমার নিজের অবস্থান নিজের মতো করেই তাদের সামনে তুলে ধরো।
অনেক সময় পড়াশোনার বাইরে সহশিক্ষা কার্যক্রম এ ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। এতে বন্ধুদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে হবে না, বরং তাদের সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকার মতো সময়ই তুমি পাবে না।
অনেক সময় বন্ধুদের না বলা কঠিন হয়ে যায়, বিশেষ করে যদি তাদের সঙ্গে ছোটবেলা থেকে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে অনেক বছর ধরে যারা বন্ধু সাধারণত তারা তোমার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কেও তত দিনে বুঝে যাওয়ার কথা।
তবে তুমি কিসে স্বচ্ছন্দ, সেটা বুঝলে বন্ধুরাও সেই সীমা অতিক্রমের আগে দুবার ভাববে। আবার টিনএজ বয়সে যেহেতু নানা রকম কৌতূহল জন্মে সেসবের সঠিক ব্যাখ্যা পরিবারের বড়দের কাছ থেকেই নিতে চেষ্টা করতে হবে। সঠিক বন্ধু বাছাই করলে সেটা তার সিদ্ধান্তের বিপরীতে গেলেও সে তোমাকে সম্মান করবে।
পিয়ার প্রেশারে পড়লে সেটা বড় কারও সঙ্গে আলোচনা করা জরুরি। বাবা-মা, অভিভাবক, শিক্ষক বা বিশ্বস্ত বড়দের কাউকে বলতে পারো। যদি চাপের মাত্রা বেড়ে যায় তাহলে অবশ্যই দ্রুত পরিবারে বলতে হবে। কারণ, এই বয়সে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা সামলাতে কষ্ট হয়। শহরের অনেক স্কুলে মানসিক সেবা নেওয়ার সুযোগ থাকে, সেখান যোগাযোগ করতে পারো। পরিবারের বড়দের বিষয়টি জানিয়ে তাদের সাহায্যে কাউন্সেলরের পরামর্শ নিতে পারো।