২০৩০ নিয়ে চ্যাটজিপিটির কারিগর স্যাম অল্টম্যানের ভবিষ্যদ্বাণী, শুনলে নড়েচড়ে বসবেন

এআইয়ের হাত ধরে যে তছনছ করা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পৃথিবী যাচ্ছে, তার অন্যতম কান্ডারি স্যাম অল্টম্যান। চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের তিনি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। এআই প্রসঙ্গে স্যামের ভবিষ্যদ্বাণী কী? পড়ুন তাঁর লেখা ব্লগের নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।

চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই–এর সিইও স্যাম অল্টম্যান
ছবি: এএফপি

আমরা সেই সীমারেখা পেরিয়ে গেছি—যে সীমা পেরোলে আর ফেরা যায় না। যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। মানুষ এখন ‘ডিজিটাল সুপারইন্টেলিজেন্স’ তৈরির খুব কাছাকাছি। যদিও এখন পর্যন্ত ব্যাপারটা ততটা অদ্ভুত মনে হচ্ছে না, যতটা হওয়ার কথা ছিল।

এখনো রাস্তাঘাটে রোবট হাঁটতে শুরু করেনি। এখনো দিন-রাত আমরা এআইয়ের সঙ্গে কথা বলি না। এখনো মানুষ অসুখে ভুগে মারা যায়। এখনো চাইলেই আমরা মহাকাশে যেতে পারি না। এখনো এই মহাবিশ্বের অনেক কিছু আমাদের অজানা।

তবু এমন কিছু প্রযুক্তি আমরা তৈরি করেছি, যা অনেক দিক থেকে মানুষের চেয়েও বুদ্ধিমান। এগুলো ব্যবহারকারীদের সক্ষমতা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। সবচেয়ে অসম্ভব বলে মনে হওয়া কাজটুকু আমরা ইতিমধ্যেই করে ফেলেছি। জিপিটি-৪ ও ৩ তৈরি করতে আমাদের অনেক কষ্ট হয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যে জ্ঞান অর্জন করেছি, সেটাই আমাদের বহুদূর নিয়ে যাবে।

এআই নানাভাবে দুনিয়ায় অবদান রাখবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সুবিধা যেটা হবে—এখন থেকে বিজ্ঞান এগোবে অনেক দ্রুতগতিতে। ফলে মানুষের কাজের উৎপাদনশীলতা বাড়বে। এর মধ্য দিয়ে জীবনের মান ভালো হতে পারে, ভবিষ্যৎ হতে পারে অনেক সুন্দর। ভাবতেই ভালো লাগে, সামনে আমরা কত কিছু পেতে পারি।

কেমন হবে ২০৩০-এর দশক

এক অর্থে, চ্যাটজিপিটি ইতিমধ্যেই ইতিহাসের যেকোনো মানুষের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে গেছে। এখন প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ এটা ব্যবহার করে। দিন দিন এর গুরুত্ব আরও বাড়ছে। এআইয়ের একটা ছোট্ট নতুন সক্ষমতাও বিশাল ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আবার ছোট্ট কোনো ভুল দৃষ্টিভঙ্গি বা বিভ্রান্তি যদি কোটি মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে, তাহলে তা বড় নেতিবাচক ফলও আনতে পারে।

২০২৫ সালে আমরা এমন এআই এজেন্ট পেয়েছি, যা সত্যিকার অর্থেই চিন্তাশীল কাজ করতে পারে। বিশেষ করে কম্পিউটার কোড লেখা এখন আর আগের মতো থাকবে না। হয়তো ২০২৬ সালেই আমরা এমন এআই পাব, যা নতুন নতুন আবিষ্কার বা চিন্তা করতে পারবে। ২০২৭ সালেই হয়তো এমন রোবট আসবে, যারা শুধু অনলাইনের দুনিয়ায় নয়, বাস্তব পৃথিবীতেই মানুষের মতো কাজ করবে।

আরও অনেক মানুষ এখন সফটওয়্যার ও শিল্পকর্ম তৈরি করতে পারবে। বাড়বে এসবের চাহিদা। যাঁরা অভিজ্ঞ, তাঁরা সামনেও নতুনদের চেয়ে অনেক ভালো কাজ করবেন—যদি তাঁরা এই নতুন টুলগুলোকে গ্রহণ করতে পারেন। সোজা কথায়, ২০৩০ সালে একজন ব্যক্তি আগের চেয়ে অনেক বেশি কিছু করতে পারবেন—একাই। আর এই পরিবর্তন হবে চোখে পড়ার মতো। যাঁরা বিষয়টা বুঝবেন, তাঁরাই সুফল তুলতে পারবেন।

মোটাদাগে ২০৩০–এর দশক হয়তো খুব বেশি ভিন্ন মনে হবে না। তখনো মানুষ পরিবারকে ভালোবাসবে, সৃজনশীলতা প্রকাশ করবে, খেলবে, লেকে সাঁতার কাটবে।

তবে হ্যাঁ, কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ২০৩০-এর দশক হবে ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে আলাদা। আমরা জানি না, মানুষকে ছাড়িয়ে যাওয়া বুদ্ধিমত্তার পক্ষে কত দূর যাওয়া সম্ভব—কিন্তু আমরা সেটা জানতে চলেছি।

২০৩০-এর দশকে বুদ্ধিমত্তা ও শক্তি—অর্থাৎ আইডিয়া তৈরি ও সেই আইডিয়া বাস্তবে রূপ দেওয়ার সক্ষমতা (থাকাটা মানুষের জন্য) অপরিহার্য হয়ে উঠবে। এই দুটি জিনিস বহুদিন ধরে মানুষের অগ্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল। যদি আমাদের কাছে অফুরন্ত বুদ্ধিমত্তা ও শক্তি থাকে (সঙ্গে ভালো প্রশাসন), তাহলে তাত্ত্বিকভাবে আমরা যা চাই, তা-ই অর্জন করতে পারি।

এক বছরের গবেষণা এক মাসে

আমরা ইতিমধ্যেই অসাধারণ ডিজিটাল বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বসবাস করছি। প্রাথমিক কিছু চমকের পর বেশির ভাগ মানুষ এর সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। এখন আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি, এআই কি সুন্দর করে একটা অনুচ্ছেদ লিখে দিচ্ছে! ‘অনুচ্ছেদ’–এর জায়গায় ‘উপন্যাস’ বসতে খুব বেশি দেরি হবে না। ছোট্ট একটা প্রোগ্রাম তৈরির ক্ষমতা আজ আমাদের বিস্মিত করছে, সামনেই হয়তো দেখব—আস্ত কোম্পানিই তৈরি করছে এআই।

এটাই ‘সিঙ্গুলারিটি’র ধরন। আশ্চর্য ব্যাপারগুলো ধীরে ধীরে আমাদের চোখে স্বাভাবিক হয়ে যায়, আর পরে এগুলোই হয়ে পড়ে ‘ন্যূনতম প্রত্যাশা’।

স্যাম বলছেন, ২০৩০ এর দশকে ‘আইডিয়া’ হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ

ইতিমধ্যেই অনেক বিজ্ঞানী বলছেন—এআইয়ের কল্যাণে এখন তাঁদের কার্যক্ষমতা দুই থেকে তিন গুণ বেড়েছে। উন্নত এআই অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সবচেয়ে বড় দিক হলো—আমরা এআই ব্যবহার করেই এআই নিয়ে আরও গবেষণা করতে পারছি। যদি এক দশকের গবেষণা এক বছরে বা এক মাসে শেষ করতে পারি, তাহলে উন্নয়নের গতি যে পুরোপুরি বদলে যাবে, তা তো স্পষ্ট। অবশ্যই ব্যাপারটা এমন নয় যে—এআই এখন নিজের কোড নিজেই পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপডেট (হালনাগাদ) করছে। তবে একে আত্মোন্নয়ন প্রক্রিয়ার প্রাথমিক রূপ হিসেবে ধরা যেতেই পারে।

আইডিয়ার জয়জয়কার

ধরা যাক, পুরোনো পদ্ধতিতে প্রথমে ১০ লাখ হিউম্যানয়েড রোবট (মানুষের মতো দেখতে রোবট) বানানো হলো। এরপর এই রোবটরাই যদি সাপ্লাই চেইনটা পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে নেয়, অর্থাৎ খনি থেকে খনিজ পদার্থ তোলা থেকে শুরু করে ট্রাক চালানো, কারখানা চালানো—তাহলে সহজেই আরও রোবট, আরও চিপ তৈরির ফ্যাক্টরি, আরও ডেটা সেন্টার তৈরি করা যাবে। অগ্রগতির গতি যে একেবারে পাল্টে যাবে, তা বলা বাহুল্য।

প্রযুক্তির অগ্রগতি আরও দ্রুত হতে থাকবে। মানুষও মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আগে যেমন দেখিয়েছে, এবারও দেখাবে। হ্যাঁ, কিছু কঠিন ব্যাপার থাকবে—অনেক ধরনের চাকরি একেবারে হারিয়ে যাবে। কিন্তু একই সঙ্গে দুনিয়া এত দ্রুত এত ধনী হয়ে উঠবে যে আমরা একেবারে নতুন কিছু নীতি নিয়ে চিন্তা করতে পারব—যেগুলো আগের সমাজে কল্পনাও করা যেত না। হয়তো একসঙ্গে পুরো নতুন কোনো সামাজিক চুক্তি বাস্তবায়ন হবে না, কিন্তু কয়েক দশক পর পেছনে তাকিয়ে দেখলে বুঝব—ধাপে ধাপে এই বদলগুলো মিলিয়ে একটা বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে।

আমরা (পুরো এআই-শিল্পটাকেই বোঝাচ্ছি। শুধু ওপেনএআই নয়) পৃথিবীর জন্য একটা মস্তিষ্ক তৈরি করছি। এটা হবে ভীষণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক, ব্যবহার করা খুব সহজ। প্রয়োজন হবে শুধু একটি জিনিস—ভালো আইডিয়া। স্টার্টআপ-জগতে যাঁরা আইডিয়া নিয়ে ঘুরঘুর করছেন, টেকনিক্যাল লোকজন এত দিন তাঁদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করতেন। এখন মনে হচ্ছে, সেই ‘আইডিয়াবাজ’দেরই সময় এসে গেছে।

২০২০ সালে যদি আপনাকে বলতাম—আজ পৃথিবী এই পর্যায়ে থাকবে, শুনে আপনি হয়তো আমাকে পাগল ভাবতেন। ২০৩০-এর ভবিষ্যদ্বাণী হয়তো এখন আর অতটাও অবাস্তব মনে হয় না।

আশা করি, সুপারইন্টেলিজেন্সের পথে এই যাত্রায় আমরা নির্বিঘ্নে, দ্রুততার সঙ্গে, শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে যেতে পারব।

ইংরেজি থেকে অনূদিত