মাটির দলা আঙুলের চাপে হয়ে ওঠে শিল্পকর্ম। শোনা যায়, গ্রামীণ জীবনে অবসর কাটানোর জন্য মানুষ প্রথমে খেলনার মতো ছোট ছোট মাটির পুতুল বানাতে শুরু করে। ধীরে ধীরে পূজা-পার্বণ ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে ওঠে এই পুতুল। মৃৎশিল্পী নরম মাটি দিয়ে প্রথমে মাথা, শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরি করেন, তারপর আঙুলে টিপে টিপে আকার দেন। শেষে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে আঁকা হয় সূক্ষ্ম নকশা। কখনো রোদে শুকিয়ে, কখনো চুলায় পুড়িয়ে পুতুলকে শক্ত করা হয়। যেহেতু দুই আঙুলের চাপে টিপে টিপে এই মাটির পুতুল তৈরি করা হয়। তাই একে বলা হয় টেপাপুতুল।
মা-সন্তান, নারী-পুরুষ, কুকুর-বিড়াল, মাছ-নৌকা, হাতি-ঘোড়া, ফুল-গাছ, বাউল, ঢাক বাজাচ্ছেন ঢাকি, খেতে কাজ করছেন কিষানি, হরিণ, বিড়ালের গলা থেকে কাঁটা বের করছে বক কিংবা রান্না করছেন মা—কত ধরনের পুতুলই না আছে। আগে রঙের ব্যবহারও ছিল প্রকৃতিনির্ভর। লাল, হলুদ, নীল, সবুজ ও সাদা ছিল প্রধান রং। তবে আজকাল বাজারে সহজলভ্য কৃত্রিম রং দিয়েও এগুলো সাজানো হচ্ছে।
একসময় টেপাপুতুল শুধু খেলনা হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। আর এখন ঘরের অন্দরসজ্জায় এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। ড্রয়িংরুমের টেবিলে আর শেলফে রাখা হচ্ছে ছোট আকারের পুতুল। আবার নারী, গরু, ঘোড়া কিংবা হাতির ভাস্কর্যের মতো বড় আকারের টেপাপুতুল ভাস্কর্য হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। কেউ আবার খালি অ্যাকুয়ারিয়াম নৌকা, পুতুল আর মাছ দিয়ে সাজাচ্ছেন, কেউ টবে গাছের পাশে রাখছেন টেপাপুতুল। চাইলে ঘরে ঢোকার দরজার পাশে টেবিলেও রাখতে পারেন টেপাপুতুল ও গাছ। দেয়ালেও ঝুলিয়ে রাখা যায় টেপা। ফ্যাশনেও টেপার ব্যবহার শুরু হয়েছে। অনেক ডিজাইনার তাঁদের পোশাকে টেপার মোটিফ ব্যবহার করছেন। গয়নার নকশায়ও চলে এসেছে টেপাপুতুল।
টেপাপুতুল আজ আর তাই শুধু গ্রামীণ মেলাতেই সীমাবদ্ধ নেই। বাংলাদেশে ভ্রমণে আসা বিদেশিরা এই টেপাপুতুল কিনে নিয়ে যান। আড়ং, যাত্রা, সোর্স, অরণ্য, অস্তিত্বসহ বিভিন্ন লাইফস্টাইলভিত্তিক দোকানে এটি পাওয়া যাচ্ছে। ৫ ইঞ্চি থেকে দেড় ফুট উচ্চতার টেপাপুতুল কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। আকার আর নকশা অনুযায়ী ১০০ টাকা শুরু করে ১০ হাজারের ওপরে দাম। বৈশাখী মেলা, পৌষ মেলা, জয়নুল মেলা কিংবা দোয়েল চত্বরের দোকানগুলোয়ও পাওয়া যায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল যেমন সোনারগাঁও, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুরে অনেক মৃৎশিল্পী টেপাপুতুল বানান। চাইলে সরাসরি তাদের কাছ থেকেও কেনা যায়।
তাই বলা যায়, টেপাপুতুল কেবল খেলনা নয়, এটি আমাদের শিকড়, আমাদের অস্তিত্ব ও শিল্পের পরিচয়।
লেখক: সাসটেইনেবল ডিজাইনার