জিয়া হায়দার রহমান

আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো লিরিক্যাল

উৎসব উপলক্ষে ঢাকা এসেছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেখক জিয়া হায়দার রহমান। সে সময় কথা হয় লেখকের সাড়া জাগানো উপন্যাস ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো নিয়ে। 
কথা বলেছেন মাসরুর আরেফিন

জিয়া হায়দার রহমান
জিয়া হায়দার রহমান

মাসরুর আরেফিন: এই প্রথম কারও সাক্ষাৎকার নিচ্ছি আমি। বলুন কীভাবে, কোথা থেকে শুরু করতে পারি?
জিয়া হায়দার রহমান: একটা কথা বলি। অধিকাংশ লোকই কিন্তু আমার ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো বইটা এখনো পড়েনি। অতএব মানুষ আগ্রহী শুধু বেসিক সব জিনিস—লেখালেখি কীভাবে শুরু করলাম, এসব নিয়ে। ফলে আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার কাজটা এমনিতেই সহজ।
মাসরুর: না, ও রকম না। আমি উপন্যাসের গভীরে যেতে চাইছিলাম।
জিয়া: আমি জানতাম, প্রথম আলো তেমনটাই চাইবে।
মাসরুর: আসুন, শুরু করা যাক এর নাম নিয়ে। ‘ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো’ খুবই চমৎকার একটা নাম। উপন্যাসের বড় থিমের সবটুকু ধরা পড়েছে এতে: আমরা যা জানি বলে ভাবি, তা সত্যিকারের জানার ক্ষেত্রে আমাদের অক্ষমতা। তা ছাড়া নামটা খুব লিরিক্যাল, কবিতার মতো। তো, জিওপলিটিকস, শ্রেণিভেদ, যুদ্ধ-ব্যবসা—এসব সিরিয়াস, নন-লিরিক্যাল বিষয় নিয়ে লেখা উপন্যাসের এমন লিরিক্যাল নাম কেন?
জিয়া: চমকপ্রদ প্রশ্ন! আপনি কবিতার কথা বললেন। এ বইয়ের আলোচকেরাও বলেছেন, বইটিতে অনেক সুন্দর লিরিক্যাল অংশ আছে। দেখুন, আমি বিশ্বাস করি, উপন্যাস মানুষের অভিজ্ঞতার বয়ান করবে। আর আমার ধারণা, আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো লিরিক্যাল, প্রবন্ধের মতো কাঠামোভিত্তিক নয়। আমি যা কিছু খুঁজি, সবটার মধ্যেই মানুষের অভিজ্ঞতাকে খুঁজি। সেগুলো বলার ভাষাটা কিন্তু লিরিক্যালই। কবিতা যেভাবে কাউকে আবেগের এক নির্দিষ্ট বিন্দুতে নিয়ে যেতে পারে, স্রেফ তথ্য তা পারে না। এখন কয়েকটি ভাষায় এ বইয়ের অনুবাদ চলছে। আমি দেখার অপেক্ষায় আছি, কোন ভাষা কী করে এই কাব্যিক নামটাকে নিয়ে।
মাসরুর: কোনটা আগে এসেছিল আপনার মাথায়? উপন্যাসের নাম, না এর আইডিয়া?
জিয়া: আইডিয়া।
মাসরুর: আমি যখন বলি, আমি যা বলছি, তা আমি যা জানি, তার আলোকে বলছি, তখন আমি আসলে স্বীকার করে নিচ্ছি যে আমার জানাটা অসম্পূর্ণ। যেমন, আমরা যখন ইংরেজিতে কোনো কথার আগে বলি, ‘সো ফার আই নো’—এটা তো আমার আংশিক অজ্ঞতারই স্বীকারোক্তি।
জিয়া: মানছি। কিন্তু মজার বিষয় হলো, আপনি যখন বইয়ের প্রচ্ছদে এ রকম একটা নাম ব্যবহার করবেন, তখন তার মধ্যে একটা ‘আশা’র ব্যাপারও থাকবে। সেই ‘আশা’ জাগে এর নামের মধ্যে ‘লাইট’ শব্দটার কারণে। আলোর কথা উপন্যাসটিতে নানাভাবে আছে। কিন্তু আলো ও সত্যের মাঝখানের যে জায়গাটা, সেটা কী বা কেমন, তাতেই আমার আগ্রহ বেশি। কোনো একটা জিনিসকে আলোকোজ্জ্বল করে তুললেই যে আমরা সত্য জানার কাছাকাছি চলে গেলাম, এমন নয়।
মাসরুর: আপনার কি কখনো মনে হয় যে উপন্যাসটা আকারে একটু ছোট হতে পারত?
জিয়া: কখনোই না। আমি যে গল্পটা এখানে বলেছি, তা অনেক বড় একটা গল্প।
মাসরুর: কিন্তু আমার মনে হয়েছে, লেখক এখানে পাঠকের জন্য কল্পনার কোনো জায়গা রাখেননি, পাঠকের সবটুকু নিঃশেষ করে নিয়েছেন। ডব্লু জি সেবাল্ডের সঙ্গে আপনার নিয়মিত তুলনা আসছে দেখছি। কিন্তু সেবাল্ড তো না-বলা অনেক কিছু রেখে দেন পাঠকের অনুমান করে নেওয়ার জন্য।
জিয়া: জয়েস ক্যারল ঔটস্ সম্প্রতি আমার বই নিয়ে তাঁর রিভিউতে টমাস মানের একটা কথার উল্লেখ করেছেন, ‘শুধু যা নিঃশেষ করে নেয়, কেবল তা-ই সত্যিকারের ইন্টারেস্টিং’। এখন কথা হচ্ছে, এই পুরো বইটা অনেক উসকানিতে ভরা, তর্কে ভরা। উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র জাফর প্রচণ্ড রাগী এক মানুষ, বারবার তার এই ক্রোধের দেখা পাই আমরা। পৃথিবীর ওপর তার এই ক্রোধ, যেভাবে সবকিছু চলছে—শ্রেণিভেদ, মানবাধিকারকর্মীদের কাজ-কারবার, যুদ্ধ-বাণিজ্য—এসব নিয়ে তার ক্রোধ। উপন্যাসটিতে জ্ঞানতত্ত্ব-সম্পর্কিত একটা বিরাট জিজ্ঞাসা আছে, পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের কোনো কিছু নিয়ে কি আমরা নিশ্চিতির মধ্যে থাকতে পারি? উপন্যাসের সব অস্বাচ্ছন্দ্যবোধের শুরু এখান থেকেই। জাফরের কথা ও কাজের মধ্য দিয়ে আমরা বুঝি, সে নিজেকেই জানে না, বোঝে না। এই আবেগগত টেনশনের প্রেক্ষাপটে এটা খুব কঠিন যে, প্রথম পুরুষের কথক তৃতীয় পুরুষ জাফরের গল্প থেকে নিজে সেবাল্ডের মতো অনেক দূরে থাকবে, দূর থেকে জাফরকে দেখবে। যদিও এখানে অনেক সেবাল্ডিয়ান ঘোরের অভিঘাত আছে, তার মতো শীতলতা আছে, তবু এটা সেবাল্ড নয়।
মাসরুর: অনেক কৌতুককর জায়গাও তো আছে বইটিতে। ওই যখন আপনি বলেন, ব্রিটিশ সমাজে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের গোড়াতে জ্ঞান নয়, বরং আছে জ্ঞানের প্রলেপ; কিংবা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের সমগ্র মানবতার জন্য কত অকৃপণ ভালোবাসা, কিন্তু মানুষের জন্য তাদের আগ্রহ শূন্য।
জিয়া: এর পেছনে ঘটনা আছে। ২০০৭ সালে মানবাধিকার আইনজীবীর চাকরি ছেড়ে আমি এশিয়া ও ইউরোপে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। সিরিয়ায় এসে জানলাম, আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মা মৃত্যুশয্যয়। পরের বিমানে ফেরত গেলাম লন্ডন। বন্ধুর মা মারা গেলেন কয়েক সপ্তাহের মধ্যে। তখন আমার আমেরিকার আরেক বন্ধু বলল, তাদের বাচ্চা হবে, আমি বাচ্চার জন্য একটা দোলনা বানিয়ে দিতে পারব কি না। কাঠমিস্ত্রির কাজ আমি জানি। তো, আমারই কাঠের ডেস্কটাকে উল্টো করে নিয়ে দোলনার অংশগুলো বানিয়ে ফেললাম, ওগুলো জোড়া দিলাম নিউইয়র্কে নিয়ে, তিন সপ্তাহ থেকে ফেরত এলাম লন্ডনে। ফিরে এসেই ফোন পেলাম, বাচ্চাটা হাসপাতালে। আবার ফিরে গেলাম আমেরিকা। এর তিন দিন পরে বারাক ওবামা প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হলেন, আর সেদিনই মারা গেল বাচ্চাটা। নিউইয়র্কে থেকে গেলাম আমি। আমার চারপাশে এসব মৃত্যুর মাঝখানে বসেই লেখা শুরু করলাম উপন্যাসটি।
মাসরুর: তার মানে, এ লেখার আপনার একটা ব্যক্তিগত পশ্চাৎপট আছে।
জিয়া: হ্যাঁ, আছে। মানুষ আমাকে জিজ্ঞাসা করে কেন লিখলাম? আমি বলি, আমি লিখতাম বহু আগে থেকেই; পার্থক্য হলো এবারই প্রকাশ করলাম। সত্যিকারের প্রশ্ন হচ্ছে, কেন প্রকাশ করলাম? সব দুর্ঘটনা, সবই দুর্ঘটনা।
মাসরুর: উপন্যাসটি পড়ে মনে হয়, এটা যত না বিরাট পরিকল্পনা করে লেখা, তার চেয়ে বেশি লেখকের জীবনব্যাপী ডায়েরির টোকাটুকি। আর জীবনব্যাপী বলেই এটা এনসাইক্লোপেডিক।
জিয়া: এনসাইক্লোপেডিক হতেই হতো এটাকে! এর প্রধান বিষয়ই হচ্ছে জ্ঞানতাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা, আইডিয়া। আপনি আইডিয়ার জগতে ঢুকলেই দেখবেন সব আইডিয়া পরস্পর সংযুক্ত। এত আইডিয়াভরা জটিল পৃথিবীকে একটা উপন্যাসের এভাবেই দেখা সংগত।
মাসরুর: সিলেট নামের আইডিয়া বা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ—এগুলো তো পশ্চিমা পাঠকের জন্য নতুন। কীভাবে তাদের উদ্দেশ্যে এসবের বয়ান করা যায় অন্য সংস্কৃতিকে চেনানোর টুরিস্ট গাইড ধরনের মাধ্যম হওয়া ছাড়া?
জিয়া: আগে দক্ষিণ এশিয়ার কিছু লেখক ছিলেন, যাঁদের আমি বলতাম ‘ইন্ট্রোডিউসার’। তাঁরা এখানকার সংস্কৃতিকে পশ্চিমের কাছে পরিচয় করাতেন, চেনাতেন। একসময় এর দরকার ছিল। এখন আর নেই। পৃথিবী এখন অনেক এগিয়ে গেছে। পশ্চিমের যেসব লোক পুব বিষয়ে এখনো অজ্ঞ, তাঁদের আমি আর ক্ষমা করতে রাজি নই।
মাসরুর: অসম্পূর্ণতা যে উপন্যাসের মূল কথা—আমাদের জ্ঞানের অসম্পূর্ণতা—সেটিই দারুণভাবে সম্পূর্ণ একটি উপন্যাস। শেষ পৃষ্ঠায় যখন এর শেষ হয়, তা এক পরিপূর্ণ শেষ। ব্যাপারটা মজার।
জিয়া: আমি আসলে শুরু ও শেষের মধ্যে একটা বৃত্ত বানাতে চেয়েছিলাম। অনেক উপন্যাসই সম্পূর্ণ, কিন্তু বৃত্তাকার ঘুরে আসা নেই সেগুলোয়। আমি শুরু ও শেষের সিচুয়েশনাল ফ্রেম একই রাখতে চেয়েছি। তাই বোধ হয় আপনার কাছে এতটা পরিপূর্ণ বলে মনে হয়েছে এটাকে। যদিও কাবুলের ওই বোমা বিস্ফোরণ নিয়ে আমি উপসংহারে আসিনি কোনো।
মাসরুর: কথক তো এখানে কালো চামড়ার হয়েও ব্রিটিশ সমাজে কেমন মিশে গেছে, এমনকি নাইন-ইলেভেনের পরেও। আর জাফর তো দেখি কত অস্বস্তিতে রয়েছে ওই একই সমাজে। কেন?
জিয়া: মানুষ গায়ের রং নিয়ে অনেক কথা বলে। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের সবচেয়ে বড় ব্যবধান রঙের নয়; তা শ্রেণির। উপন্যাসের কথকের জাতিভেদ ইত্যাদি বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই, কারণ সে ব্রিটিশ উচ্চবর্গের সঙ্গে মিশে গেছে তার শ্রেণির কারণে। আর একই নৃতাত্ত্বিক পরিচয় সত্ত্বেও জাফর তা পারেনি; সে তার গায়ের রঙের কারণে নয়, বরং শ্রেণি-পরিচয়ের কারণেই থেকে গেছে বেঢপ-বেমানান। আমিও এখানে বেমানান, এই যে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে। আমি সিলেটের সন্তান। এখানে সোনারগাঁও হোটেলে বসে কী করছি আমি?
মাসরুর: বেপরোয়া এক অবস্থার মধ্যে অধার্মিক জাফরের দুবাইতে ফজরের নামাজ পড়তে বসাটাতে অনেক মজা পেয়েছিলাম আমি।
জিয়া: হ্যাঁ, সে তখন বেপরোয়া ছিল। মানুষ সান্ত্বনা পেতেই ধর্মের কাছে যায়। আসলে জীবন অনেক কঠিন। অনেক মানুষের জন্য জীবন কঠিন, কিন্তু সবার জন্যই জীবন অনেক কঠিন, কারণ শেষে মৃত্যু আছে।
মাসরুর: সিলেটের কথা মনে আছে?
জিয়া: হ্যাঁ। সিলেটে গ্রামে থাকতাম আমি। নয় বছর বয়সে ওখানে যাই। বছরখানেক থাকি। ওখানে দারুণ সব স্মৃতি আছে আমার।
মাসরুর: শেষ প্রশ্ন। আপনার উপন্যাসে অনেক আইডিয়া, অনেক হুইস্কি-খাওয়া পাকিস্তানি, আফগানিস্তানে মানুষ মারার অনেক নারকীয় যজ্ঞ, অনেক কৌতুক ও শ্লেষ। কিন্তু সবকিছুর পরেও এটা একটা ‘দুঃখী’ লেখা।
জিয়া: সাহিত্যের কাজ কী? আমার মতে, আইডিয়ার প্রিজমের ভেতর দিয়ে জীবনের কঠিন অধ্যায়গুলো খতিয়ে দেখাই এর অন্যতম কাজ, যেসব অধ্যায়ে এসে প্রশ্ন ওঠে, এই জীবনযাপনের আদৌ কোনো মানে হয় কি না। কেন বাঁচব? এ-ই তো মূল প্রশ্ন, নাকি? এটা কোনো সুখকর প্রশ্ন নয়।