
১৮৩৭ সালে, মলদোভায়, ইয়ন ক্রিয়াঙ্গার যখন জন্ম হয়, ইউরোপের দেশটি তখন অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ। পরে রোমানীয় সাহিত্যের প্রধান এক লেখক হয়ে ওঠেন ক্রিয়াঙ্গা। বিশেষ করে তাঁর শিশুতোষ গল্পগুলো আজও রোমানিয়া–মলদোভাসহ পূর্ব ইউরোপে তুমুল জনপ্রিয়।
• অনুবাদ: নিজাম বিশ্বাস
একসময় পাশাপাশি বাড়িতে থাকত এক বুড়ো আর এক বুড়ি। বুড়ির ছিল একটা পোষা মুরগি। আর বুড়োর একটা মোরগ। রোজ দুটি করে ডিম দিত বুড়ির মুরগি। সেই ডিম খুব মজা করে খেত বুড়ি, খেতে দেওয়া দূরের কথা, প্রতিবেশী বুড়োকে একটা দিন সাধতও না। একদিন বুড়ো আর না পেরে বুড়িকে বলে বসল, ‘আমাকে দুটো ডিম দাও না!’
বুড়ি বলল, ‘না না, ডিম দিতে পারব না। তোমার যদি এতই খেতে ইচ্ছে করে, তাহলে তোমার মোরগকে আচ্ছামতো পেটাও।
দেখছ না, আমার মুরগিকে পিটুনি দিই বলেই না সে এত ডিম দেয়!’
কথা শুনে বুড়ো আর দেরি করল না। মোরগটাকে ধরে দিল বেদম পিটুনি! রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ‘হয় আমাকে ডিম দে, নইলে আমার বাড়ি থেকে এক্ষুনি বের হ।’
পিটুনি খেয়ে মোরগটা ছুটে পালাল। বাড়ির পাশের উঁচু রাস্তা ধরে দিল এক দৌড়। কিছুদূর যেতে না যেতেই দেখে রাস্তায় একটা টাকার থলে পড়ে আছে। থলের ভেতর দুটি পয়সা। থলেটাকে ঠোঁটে নিয়ে আবার দৌড়াতে শুরু করল। এ সময় ওই পথ দিয়ে গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছিল এক ধনী লোক। সে দেখল, ঠোঁটে কিছু একটা নিয়ে দৌড়াচ্ছে একটা মোরগ। অমনি সে তার চালককে বলল, ‘দেখো তো, ব্যাটা মোরগের ঠোঁটে ওটা কী!’
চালক দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে মোরগের কাছ থেকে টাকার থলেটা কেড়ে নিল। মোরগটা গেল ভীষণ রেগে। সে গাড়ির পেছন–পেছন ছুটতে ছুটতে চিৎকার করতে থাকল, ‘কক কক কক কেকি! আমার থলে দাও দেখি!’
মোরগের চিৎকারে ধনী লোকটা গেল খেপে। রাস্তার ঠিক পাশেই ছিল একটা কুয়া। লোকটা তার চালককে বলল, ‘যাও, মোরগটাকে ধরে ওই কুয়ার মধ্যে ফেলে দিয়ে আসো।’
পিটুনি খেয়ে মোরগটা ছুটে পালাল। বাড়ির পাশের উঁচু রাস্তা ধরে দিল এক দৌড়। কিছুদূর যেতে না যেতেই দেখে রাস্তায় একটা টাকার থলে পড়ে আছে। থলের ভেতর দুটি পয়সা। থলেটাকে ঠোঁটে নিয়ে আবার দৌড়াতে শুরু করল।
চালক অমনি গাড়ি থেকে নেমে মোরগটাকে কুয়ার মধ্যে ছুড়ে মারল। মোরগটা বুঝতে পারল, সে বড় বিপদে পড়েছে। উপায় না দেখে সে কুয়ার পানি টানতে শুরু করল। একসময় কুয়ার সব পানি খেয়ে হয়ে উঠল ইয়া বড় এক দানব! তারপর কুয়া থেকে ওপরে উঠে আবারও সেই গাড়ির পেছনে ছুটতে ছুটতে বলতে লাগল, ‘কক কক কক কেকি! আমার থলে দাও দেখি!’
ধনী লোকটা বিশাল মোরগকে দেখে বলল, ‘এ নির্ঘাত একটা শয়তান! একে ধরে আমার বাড়িতে নিয়ে চলো। আজ ব্যাটার ঘাড় মটকাব।’
বাড়ি পৌঁছে লোকটা তার বাবুর্চিকে বলল, ‘এক্ষুনি এই মোরগটাকে আগুনে ঝলসে আনো।’
বাবুর্চি অনেক কাঠ জড়ো করে আগুন জ্বালাল। তারপর মোরগটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল আগুনের মধ্যে। মনে আছে তো, মোরগটা কুয়ার সব পানি খেয়ে পেট ফুলিয়েছিল। বুদ্ধি করে সেই পানিই সে আগুনের মধ্যে ফেলতে শুরু করল। পেটের পানিতে আগুন নিভে গেল। পানিতে ভেসে গেল রান্নাঘরের মেঝে। সব দেখেশুনে বাবুর্চি অজ্ঞান। তারপর মোরগটা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ধনী লোকটার ঘরের জানালার কাছে গেল। আবারও চিৎকার করে বলল, ‘কক কক কক কেকি! আমার থলে দাও দেখি!’
লোকটা এবার তার গৃহকর্মীকে ডেকে বলল, ‘এই বদ মোরগকে গরু–মহিষের পালে ছেড়ে দিয়ে আসো। শিংয়ের গুঁতা খেলে ওর শিক্ষা হবে।’
ধনী লোকটা বিশাল মোরগকে দেখে বলল, ‘এ নির্ঘাত একটা শয়তান! একে ধরে আমার বাড়িতে নিয়ে চলো। আজ ব্যাটার ঘাড় মটকাব।’ বাড়ি পৌঁছে লোকটা তার বাবুর্চিকে বলল, ‘এক্ষুনি এই মোরগটাকে আগুনে ঝলসে আনো।’
মোরগটাকে অমনি গরু–মহিষের পালের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে এল গৃহকর্মী। সঙ্গে সঙ্গে মোরগটাকে গুঁতা দিতে ছুটে এল একটা গরু। মোরগও কম যায় না, গরুটাকে সে গিলে ফেলল কপাৎ করে। এভাবে সব গরু আর মহিষকে গিলে মোরগটা হয়ে উঠল পাহাড়ের মতো বিশাল এক দৈত্য! তারপর আবার সে লোকটার বাড়িতে গেল। বড় বড় ডানা মেলে লোকটার ঘর অন্ধকার করে ফেলল। আবারও বলতে শুরু করল, ‘কক কক কক কেকি! আমার থলে দাও দেখি!’
ধনী লোকটা দৈত্যাকার মোরগকে দেখে রাগে ফেটে পড়ল। মোরগটার হাত থেকে কীভাবে রেহাই পাবে, বুঝতে পারছিল না। অনেক ভেবেটেবে ঠিক করল, মোরগটাকে সিন্দুকে বন্দী করে রাখবে। তাহলে ক্ষুধায় মোরগটা সিন্দুকে থাকা স্বর্ণমুদ্রাগুলো গিলতে যাবে। আর ওসব তার গলায় আটকালেই কেল্লা ফতে, দমবন্ধ হয়ে মরবে পাজি মোরগ।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। দ্রুতই মোরগটাকে সিন্দুকে আটকে ফেলল ধনী লোক। আর ঠিকই মোরগটা সিন্দুকের সব স্বর্ণমুদ্রা গিলে ফেলল এক এক করে! তবে সেখান থেকেও বের হয়ে এল মোরগ। তারপর আবার সে চলে গেল লোকটার ঘরের জানালার কাছে। আর বলতে লাগল, ‘কক কক কক কেকি! আমার থলে দাও দেখি!’
ধনী লোকটা দেখল, কোনোভাবেই মোরগটাকে শায়েস্তা করা যাবে না। সে বাধ্য হয়ে টাকার থলেটা ফিরিয়ে দিল। মোরগটা যখন ধনী লোকটার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, তখন তার পিছু পিছু সব হাঁস–মুরগি আর পাখিও ছুটে চলল! কাণ্ড দেখে লোকটা বিড়বিড় করে বলল, ‘এটা নিশ্চয়ই কোনো জাদুর মোরগ!’
অবশেষে মোরগটা তার মনিব বুড়োর বাড়িতে এসে ডাক দিল, ‘কক কক কক...!’
মোরগের গলা শুনে বাড়ি থেকে পড়িমরি বেরিয়ে এল বুড়ো। একি কাণ্ড! তার মোরগ কী বিশাল হয়ে গেছে! মোরগের পাশে একটা হাতিকেও মনে হচ্ছে মাছি! আর মোরগের পেছনে রংবেরঙের অসংখ্য পাখপাখালি। বাড়ির দরজা খুলে দিল বুড়ো। তারপর উঠানে বিছিয়ে দিল বিশাল একটা চাদর। মোরগটা সেই চাদরের ওপরে এসে দাঁড়াল। পেট থেকে বের করে দিল রাশি রাশি স্বর্ণমুদ্রা। রোদের আলোয় মুদ্রাগুলো চকচক করছিল। বুড়ো আনন্দে তার পোষা মোরগটাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল।
এমন সময় সেখানে হাজির পাশের বাড়ির সেই কিপটে বুড়ি। বুড়োর কাছে কয়েকটা স্বর্ণমুদ্রা চাইল। বুড়ো তখন বলল, ‘না না, তা হবে না। মনে নেই, তোমার কাছে একটা ডিম চেয়েছিলাম। দাওনি। যাও এখান থেকে। আর যদি স্বর্ণমুদ্রা পেতেই চাও, তাহলে তোমার মুরগিটাকে আচ্ছামতো পেটাও, দেখছ না পিটুনি খাওয়ার পর কীভাবে স্বর্ণমুদ্রা দিল আমার মোরগ!’
বুড়ি সঙ্গে সঙ্গে তার মুরগিকে ধরে দিল বেজায় পিটুনি। মুরগিটা বুড়ির হাত থেকে পালিয়ে বাঁচল। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একটা কাচের পুঁতি কুড়িয়ে পেল। ওটা নিয়ে বাড়ি ফিরে এল।
মুরগিকে দেখে বুড়ি তো বেজায় খুশি। কিন্তু স্বর্ণমুদ্রার বদলে কাচের পুঁতি দেখে সে রেগে অগ্নিশর্মা। তারপর মুরগিটিকে এমন পিটুনি দিল যে বেচারি মরেই গেল! বুড়ির আর স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া হলো না!
বুড়ো কিন্তু তখন অনেক সম্পদের মালিক। সুন্দর ঘরবাড়ি। সামনে বাগান। বুড়িকে তার খামারে কাজ দিল।
পোষা মোরগটাকে সব সময় সঙ্গে সঙ্গেই রাখত বুড়ো। মোরগটার গায়ে থাকত সোনালি রঙের জামা। পায়ে হলুদ বুটজুতা। মোরগটাকে দেখে মনে হতো, সাক্ষাৎ কোনো রাজা!