সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতিতে অন্যতম আলোচিত দুটি পরিভাষার সঙ্গে বদরুদ্দীন উমরের (২০ ডিসেম্বর, ১৯৩১-৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫) সম্পর্ক গভীর। এর একটি ‘গণঅভ্যুত্থান’, আরেকটি ‘ফ্যাসিবাদ’। সময় নিয়ে আরও বিস্তারিত ও প্রামাণ্য নথিপত্রসহকারে এ দুটি প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমরের অবদান ও সমকালীন বিষয়ে দীর্ঘ ও প্রামাণ্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করা প্রয়োজন। কিন্তু আপাতত, প্রধানত স্মৃতি থেকে প্রসঙ্গ দুটি আলোচনা করা যাক।
প্রথমেই গণঅভ্যুত্থান। জনগণের সক্রিয় উত্থানকে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের পথ হিসেবে বদরুদ্দীন উমর ব্যবহার করেছিলেন ১৯৭০-এর দশকে। তবে এই ব্যবহারের একটা ঐতিহাসিক পটভূমি ছিল, যা সংগত কারণেই অধিকাংশ মানুষ আর স্মরণে রাখেনি।
১৯৬০–এর দশকের শেষে সূচনা হলেও গোটা সত্তরের দশক ছিল এই অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদী গোপন রাজনীতির স্বর্ণযুগ। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের চারু মজুমদার ও নকশালবাড়ি বিদ্রোহের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (ইপিসিপিএমএল) একটা বড় অংশ প্রকাশ্য রাজনীতি পরিত্যাগ করে গোপন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে শাসক শ্রেণির উৎখাতকে বিপ্লবের রণনীতি হিসেবে নির্ধারণ করে, মুক্তিযুদ্ধেরও ঠিক আগেকার সময়টিতে। এরই অংশ ছিল শ্রেণিশত্রু খতম করা, থানা আক্রমণ করে অস্ত্র লুট, মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলা ইত্যাদি। সেই আমলের সাহিত্য, স্মৃতিকথা ইত্যাদি পড়লে বোঝা যাবে, গ্রামের তরুণ কৃষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অসংখ্য তরুণ এই রাজনীতির প্রতি মোহাবিষ্ট ছিলেন। ২০ বছর অত্যন্ত সক্রিয় থেকে তাঁদের এই ঢল খুব ধীরে কমে আসে নব্বইয়ের দশকের পরে। তবে কখনোই তা একেবারে বন্ধ হয়নি; বরং কখনো কখনো তা এখানে-সেখানে স্থানীয় আলোড়নও তৈরি করেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে গোপন রাজনীতির পটভূমিতে রচিত অন্যতম আলোচিত উপন্যাস শাহরিয়ার কবিরের ‘ওদের জানিয়ে দাও’-এর অন্যতম চরিত্রটি বদরুদ্দীন উমরকেই চিত্রিত করেছে। উপন্যাসের বিষয় মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী আওয়ামী দুঃশাসন।
সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি এবং এই খতমপন্থা কেন ভুল, সেটা প্রথমবারের মতো ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছিলেন বদরুদ্দীন উমর। সেই দীর্ঘ বিতর্কের বিস্তার এখনকার অনেক পাঠকের কাছে অবিশ্বাস্য জটিল একটি খেই হারানো গোলকধাঁধা হিসেবেই ঠেকবে এবং নিশ্চিতভাবেই বহু ক্ষেত্রে হয়তো আদৌ কোনো অর্থ তৈরি করবে না। কারণ, সেই সময়ে নকশালপন্থীদের ব্যবহৃত বহু শব্দ ও পরিভাষাই এখন অচেনা হয়ে গেছে।
১৯৯০-এর অভ্যুত্থানকে বদরুদ্দীন উমর ‘নাগরিক বুর্জোয়া গণঅভ্যুত্থান’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছিলেন, যেখানে কৃষক-শ্রমিকের স্বার্থ নয়, শহরের ধনিক শ্রেণির রাজনৈতিক দলগুলোই মূল চালিকা শক্তি ছিল। ২০২৪-এর অভ্যুত্থানকে তিনি উপমহাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
কিন্তু ডালপালা সরিয়ে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির মূল প্রবণতাগুলো নির্ধারণ এবং কেন তা বাংলাদেশের বিশেষ বাস্তবতায় বিপ্লবের কোনো পথ নয়, তা গুরুত্ব দিয়ে তত্ত্বায়ন করায় বদরুদ্দীন উমর বিশাল একটা ভূমিকা রেখেছেন। এই রাজনীতির অন্যতম প্রধান আকর্ষণীয় দিকটি—মাও সে–তুংয়ের ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও’—কেন বাংলাদেশে কার্যকর নয়, তা তিনি দেখিয়েছেন।
নকশালপন্থার বিপরীতে বদরুদ্দীন উমরের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল ক্ষমতার যে গ্রন্থিগুলো নগরে তৈরি হয়েছে, সংগঠিত জনতাকে সঙ্গে নিয়ে সেগুলো দখল করা, অকার্যকর করা এবং শাসকদের পরাজিত করাই বাংলাদেশে বিপ্লবের একমাত্র রাস্তা। এর জন্য প্রয়োজন ছাত্র-শ্রমিক ও জনগণের নানা অংশের মধ্যে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলা, উল্টো দিকে চারু মজুমদার এই গণসংগঠনগুলোকে পরিত্যাগ করে কেবল বিপ্লবী রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র সংগ্রামকেই একমাত্র করণীয় হিসেবে দেখিয়েছিলেন। তাঁর এই বুদ্ধিবৃত্তিক অবদানগুলোর বড় অংশ আশির দশকের আগেই সম্পন্ন হয়েছিল। সন্ত্রাসবাদী গোপন রাজনীতি প্রায় অবলুপ্ত হয়েছে এ দেশে, কিন্তু এই রাজনীতিতে যুক্ত বহু তরুণকে তাঁর সেই সময়কার লেখালেখি রাজনৈতিক একটা বিভ্রান্তিতে জড়িয়ে নিষ্ফল সাধনে নিজেদের জীবন বিপন্ন করার হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করেছে। অন্যদিকে পরিবর্তনের পথ হিসেবে অভ্যুত্থানের প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে এই রাজনৈতিক প্রচার তাঁর এবং তাঁর রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে অব্যাহত থেকেছে সর্বদাই।
১৯৭০-এর দশক থেকেই ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও’–এর বিপরীতে দাঁড়ানো বদরুদ্দীন উমরের ‘গণঅভ্যুত্থান’-এর রাজনৈতিক তত্ত্বটি দেশের ভেতরে প্রধানত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়েছে আবদুল হকের নেতৃত্বাধীন তখনকার গোপন রাজনীতির অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) এবং সর্বহারা দলের নানা উপদলের কাছ থেকে। কিন্তু এটা বিস্ময়কর ছিল যে বদরুদ্দীন উমর চীন ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমদানি করা এই রাজনৈতিক তত্ত্বের প্রতি সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেও তাদের অধিকাংশ মানুষকে দেখতাম বদরুদ্দীন উমরের প্রতি সর্বদাই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সশস্ত্র দলগুলোর পরস্পরের সঙ্গে এবং নিজেদের ভেতর উপদলীয় কোন্দলে অসংখ্য মানুষ মারা যাওয়ার একটা যুগে এটা কঠিন ছিল। সম্ভবত ব্যক্তিগত নিষ্ঠা ও সততা ছাড়াও এটা ছিল বাংলাদেশে সাধারণভাবে মার্ক্সের দর্শন প্রচার করায় বদরুদ্দীন উমরের একাগ্রতার একটা স্বীকৃতি। আরেকটা কারণ খুব সম্ভবত তাদের মতোই শ্রমিকের পাশাপাশি কৃষকের স্বার্থকেও রাজনীতির সংগ্রামে সব সময় গুরুত্ব দিয়ে দেখা। বদরুদ্দীন উমর সব সময় মনে করতেন, দেশের রূপান্তর শুরু হবে কৃষি থেকে। তাঁর ভাবনার এ দিকটিরও একটি বিস্তারিত পর্যালোচনা প্রয়োজন।
যাহোক, নব্বইয়ের দশকের শেষে পেরুতে দর্শনের শিক্ষক আবিম্যাল গুজম্যানের নেতৃত্বে শাইনিং পাথের দাপট বা পুষ্প কমল দাহাল প্রচন্ডের নেতৃত্বে নেপালের সশস্ত্র আন্দোলনের বিজয় বদরুদ্দীন উমরের গণঅভ্যুত্থানের রণকৌশলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু বদরুদ্দীন উমর তাঁর এই গণঅভ্যুত্থানের কার্যকারিতা–বিষয়ক অবস্থানে সব সময় অটল ছিলেন। বিশেষ করে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ তৈরিতে একটা দীর্ঘমেয়াদি ভূমিকা রেখেছিল। বদরুদ্দীন উমরের রাজনৈতিক চিন্তার অনুরাগী এবং প্রণম্য ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের মধ্যে যেন উমরের গণঅভ্যুত্থান ভাবনার একটা ছাপ মিলবে।
১৯৯০ ও ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ঠিক এভাবেই সংঘটিত হয়েছে, শহরগুলোতে ক্ষমতার গ্রন্থিগুলো আক্রান্ত হয়েছে জনতার হাতে। রক্তক্ষয় সত্ত্বেও বিপুল জনপ্রতিরোধের মুখে অকেজো হয়ে পড়া রাষ্ট্রযন্ত্র তার শাসকদের বলি দিয়ে হলেও পুরোনো ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। ১৯৯০-এর অভ্যুত্থানকে বদরুদ্দীন উমর ‘নাগরিক বুর্জোয়া গণঅভ্যুত্থান’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছিলেন, যেখানে কৃষক-শ্রমিকের স্বার্থ নয়, শহরের ধনিক শ্রেণির রাজনৈতিক দলগুলোই মূল চালিকা শক্তি ছিল। ২০২৪-এর অভ্যুত্থানকে তিনি উপমহাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের বহু সমালোচনা তিনি করেছেন, বিশেষ করে অভ্যুত্থানের পর ধর্মীয় ডানপন্থার উত্থান নিয়েও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জীবনের শেষ দিনগুলোতে। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর একটা বিশেষ প্রবণতা দেখা যাবে ক্ষুদ্রঋণের কার্যকারিতা বিষয়ে বিপুল রাজনৈতিক বিরোধ সত্ত্বেও অধ্যাপক ইউনূসের সরকারেক তিনি দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিয়েছেন টলোমলো সেই দিনগুলোতে, অন্যদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকর সমালোচনাও হাজির করেছেন।
বদরুদ্দীন উমরের বিবেচনায়, গণঅভ্যুত্থান বিপ্লবের পথ, কিন্তু গণঅভ্যুত্থান মানেই বিপ্লব নয়। বদরুদ্দীন উমর তাঁর রাজনৈতিক তত্ত্বে সব সময়ই জনগণের ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ অংশগ্রহণের পাশাপাশি গুরুত্ব দিয়েছেন কর্মসূচি বিষয়ে ‘সচেতন’ একটি রাজনৈতিক দলের ভূমিকা বিষয়ে। উমরের চোখে ২৪ তাই একটি গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান, কিন্তু কোনো বিপ্লব নয়। কারণ, কোনো স্পষ্ট সমাজ-রূপান্তরের কর্মসূচি নিয়ে তা সংঘটিত হয়নি। এই সচেতন অংশগ্রহণ ও সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া যে সরকারের পতন হলেও রূপান্তর সম্ভব হয় না, তা আমরা অচিরেই দেখতে পেলাম এত বিশাল একটি গণঅভ্যুত্থানের চোরাবালিতে হারানোর দৃষ্টান্ত থেকে।
একটা বিষয় স্মরণে রাখতে হবে। গণঅভ্যুত্থানকে উমর রণনীতি হিসেবে সঠিক মনে করলেও এবং সন্ত্রাসবাদকে ভুল সাব্যস্ত করলেও চারু মজুমদার, আবদুল হক ও সিরাজ সিকদারের প্রতি তিনি সব সময় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁর বিবেচনায়, তাঁদের ভুল পথ বিপ্লবী রাজনীতির বিপুল ক্ষতি করলেও সমাজ রূপান্তরে বলপ্রয়োগের ভূমিকা বিষয়ে তাঁদের অবস্থান যথাযথ ছিল। পার্থক্য ছিল বলপ্রয়োগ কোন প্রক্রিয়ায় হবে, তা নিয়ে। এ কথাটা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন এই কারণে যে ওই সময়টাতে সমাজ বদলে বলপ্রয়োগের আদৌ প্রয়োজন ছিল কি না, সে বিষয়টিও আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত একটি প্রশ্ন ছিল।
ফ্যাসিবাদ শব্দটার বাংলাদেশীয় প্রয়োগ বিষয়েও বদরুদ্দীন উমরের একটি বিশিষ্ট অবস্থান রয়েছে। বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের উত্থানের সম্ভাবনাটা প্রথম উত্থাপিত হয় ১৯৭২ সালে, আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসা নতুন রাজনৈতিক দল জাসদের তরফে। ২১ অক্টোবর, ১৯৭২ সালের গণকণ্ঠে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী সংবিধানে জাতীয়তাবাদের অবস্থান প্রসঙ্গে তাঁরা বলেন, ‘অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞাহীনতার ফলে অন্য জাতীয়তাবাদ বা ফ্যাসিবাদী বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে প্রচুর। এটা যেকোনো জাতির জন্য মারাত্মক।’
জাতীয়তাবোধের বিপক্ষে বদরুদ্দীন উমর কখনোই ছিলেন না, বরং জাতীয় বিকাশ কোন মাত্রায় তাঁর লক্ষ্য, সেটা বোঝা যাবে এ থেকে যে কৃষি-শিল্প-সামগ্রিক অর্থনীতির মতোই ভাষার প্রশ্নেও বদরুদ্দীন উমর জাতীয় মুক্তির কথা বলতেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, তাঁর একটা সিদ্ধান্ত ছিল, চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়ার মতো দেশগুলো এত দ্রুত উন্নতি করতে পেরেছে মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রচলন করতে পারার কারণে। বাংলাদেশের জাতীয় বিকাশে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার গুরুত্ব তাঁর কাছে তাই রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামেরও অন্যতম প্রধান প্রসঙ্গ ছিল। তাঁর রাজনৈতিক দলের নামও ‘জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল’।
কিন্তু এটা সত্ত্বেও, বদরুদ্দীন উমর একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদের যেকোনো উগ্রতার বিপক্ষে সর্বদা অটল ছিলেন। উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী কিংবা আদিবাসীদের যেকোনো সংগ্রামে সব সময় পাশে থেকেছেন মানুষটি। অর্থাৎ বাঙালি পরিচয়কে একটি শ্রেষ্ঠত্ববাদী রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে সামনে আনার প্রশ্নে তিনি সক্রিয় বিরোধিতা করে গেছেন। কেননা যেমনটা জাসদের ওই ১৯৭২ সালের বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, জাতীয়তাবাদের প্রায়ই শ্রেষ্ঠত্ববাদী ফ্যাসিবাদে রূপান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রথাগত বামপন্থীকে বদরুদ্দীন উমর পাশে পাননি। কালে কালে বাংলাদেশের একটা বড় অংশের বামপন্থীই মুজিববাদী বামপন্থীতে পরিণত হয় (যে মুজিববাদ কথাটা শেখ মুজিবুর রহমানও বিশেষ একটা বলতেন না), বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিপীড়নের একটা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।
বাংলাদেশে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের ওপর একক দখলদারিকে রাজনৈতিক বৈধতার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্যের অন্যতম ভিত্তি ছিল। ১৯৯০-এর দশকের শেষভাগে সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার বাংলাদেশ সংস্করণে বদরুদ্দীন উমরের একটি প্রবন্ধ ও কবি ফরহাদ মজহারের একটি কবিতা ছেঁটে দেওয়ার প্রতিক্রিয়া গঠিত হয় ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক কমিটি’। বদরুদ্দীন উমর, ফরহাদ মজহারের পাশাপাশি এতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন সেক্টর কমান্ডার কাজী নুরুজ্জামান, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আহমদ ছফা প্রমুখ।
বদরুদ্দীন উমর আওয়ামী ফ্যাসিবাদী চরিত্রের পাশাপাশি রাজনৈতিক তত্ত্বের সাপেক্ষে বাংলাদেশে আরও একটি রাজনৈতিক দলের ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বিষয়ে সেই সময়ে একই সঙ্গে আলোচনা করেছেন। দলটি জামায়াতে ইসলামী। তাঁর মতে, বাংলাদেশে এই দুটি দলের দুটি বিশিষ্ট রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই তাদের মধ্যে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার প্রবণতা বিদ্যমান।
এই কমিটির বৈঠকেই বাংলাদেশের শাসকদের ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠার সক্ষমতা বিষয়ে তখন একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। সেটা হলো, ধ্রুপদি ফ্যাসিবাদ যে শ্রেষ্ঠত্ববাদী রাজনীতি করতে আগ্রহী, তার পরিবেশ বাংলাদেশে কতখানি রয়েছে? জার্মান ফ্যাসিবাদ শ্রমিক শ্রেণির ওপর প্রবল নিপীড়ন করলেও জার্মানিতে তারা শিল্পকারখানার ভিত্তি নির্মাণ করেছিল, প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমি গ্রাস করছিল এবং আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেছিল। বিশেষভাবে এই প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল বামপন্থীদের দিক থেকেই। কেননা এ অভিধাটি আওয়ামী লিগের প্রতি প্রয়োগ করতে তারা আগ্রহী ছিল না।
বদরুদ্দীন উমর তাঁর তখনকার লেখালেখি ও বক্তৃতায় আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট চরিত্র সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং এর একটা তাত্ত্বিক ভিত্তিও তিনি প্রদান করেছেন। শ্রমিক ও কৃষকের দাবি এড়িয়ে জাতীয়তবাদের কথা তোলা যে ফ্যাসিবাদের লক্ষণ, এ কথা বদরুদ্দীন উমর ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধের আগেও লিখেছেন। তিনি দেখান যে আওয়ামী লীগ একটা জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠত্ববাদী রাজনীতি করছে, এমনকি ইতিহাসের ওপরও দখলদারি কায়েমের মাধ্যমে তাকে সর্বময় করারও চেষ্টা করছে।
উল্লেখ্য, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে তখন কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে দিয়ে চেষ্টা চলছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে ভাষা আন্দোলনেরও প্রধান নায়কে পরিণত করার। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানসহ আরও কয়েকজন বুদ্ধিজীবী ইতিহাসের প্রশ্নে বদরুদ্দীন উমরকে সমর্থন প্রদান করলেও জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ববাদী রাজনীতি বাংলাদেশে ক্রমাগত জেঁকে বসে এবং বলা যায়, এই বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা প্রায় নীরবই ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ইতিহাসের ওপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা করে, এমনকি ভিন্ন ইতিহাসের চর্চাকে ফৌজদারি অপরাধের বিষয়বস্তু বানানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের জনযুদ্ধ চরিত্রকে বাতিল করে মুক্তিযুদ্ধকে এক ব্যক্তির অর্জন হিসেবে দেখানো ছিল এই ফ্যাসিবাদের মতাদর্শগত ভিত্তি। এই পর্যায়ে এসেই আওয়ামী লিগের ফ্যাসিস্ট চরিত্র বিষয়ে দলটির কয়েকজন মিত্র ব্যতীত সবাই একমত হন।
কিন্তু ফ্যাসিবাদের তো নিজস্ব একটি একচেটিয়া জনভিত্তি প্রয়োজন, বাংলাদেশে কীভাবে আওয়ামী লীগ এই ফ্যাসিবাদী নিপীড়ন কায়েম করছে? আওয়ামী লিগ জার্মান ফ্যাসিবাদের মতো দেশের অভ্যন্তরে একতরফা কোনো জনপ্রিয়তা ভোগ করছে না; তার উগ্রতা, ভিন্নমত দমন কিংবা শ্রেষ্ঠত্ববাদী রাজনীতি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে পছন্দের নয়। কেননা রাষ্ট্রের বিকাশে বা অগ্রগতিতে, এমনকি কর্মসংস্থান তৈরিতে বা নাগরিকদের গর্বের অনুভূতি তৈরিতে তা কোনো ভূমিকা রাখছে না। বদরুদ্দীন উমরের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের এই ফ্যাসিস্ট চরিত্র তৈরি হওয়া সম্ভব হয়েছে বাইরের শক্তির জোরে, সেটি ভারত।
ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকার জন্য যে শক্তিমত্তার প্রয়োজন, তা এ দলটি দেশের ভেতর থেকে সংগ্রহ করতে সক্ষম নয়। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের এই মতাদর্শ এমন একটা ধরনের ফ্যাসিবাদ, যার পুষ্টির উৎস ভিন্ন একটি রাষ্ট্রে, যার অনুগত থেকেই সে ফ্যাসিস্ট হিসেবে বাংলাদেশে ভূমিকা পালন করে। সামান্য কিছুটা সাদৃশ্য হয়তো মিলবে মুসোলিনির ইতালির সঙ্গে। কিন্তু বদরুদ্দীন উমরের মতে, ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক আরও গভীর এবং তা শেখ হাসিনার আমলে, এমনকি শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়েও বহুগুণ বেশি।
বদরুদ্দীন উমর আওয়ামী ফ্যাসিবাদী চরিত্রের পাশাপাশি রাজনৈতিক তত্ত্বের সাপেক্ষে বাংলাদেশে আরও একটি রাজনৈতিক দলের ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বিষয়ে সেই সময়ে একই সঙ্গে আলোচনা করেছেন। দলটি জামায়াতে ইসলামী। তাঁর মতে, বাংলাদেশে এই দুটি দলের দুটি বিশিষ্ট রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই তাদের মধ্যে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার প্রবণতা বিদ্যমান। দ্বিতীয় রাজনৈতিক দলটি তার ধর্মীয় ব্যাখ্যাটিকে বাংলাদেশের জনগণের ওপর একচেটিয়াভাবে চাপিয়ে দিতে চায় বলেই উমর এ দলটিকেও ফ্যাসিস্ট চরিত্রের অধিকারী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বাংলাদেশের বাকি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো বিষয়ে তাঁর মত অনুযায়ী, সেগুলো বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামো ব্যবহার করে স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠে—এ কারণেই শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭২ সালের সংবিধানের আলংকারিক নানা অংশে তারা হস্তক্ষেপ করলেও এই সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামো তারা কখনো বদল করেনি—কিন্তু তাদের পক্ষে ফ্যাসিবাদী চরিত্র অর্জন করার মতো রসদ সমাজে উপস্থিত নেই।
সংক্ষেপে, গণ–অভ্যুত্থান ও ফ্যাসিবাদ—এ দুটি বিষয়ে বদরুদ্দীন উমরের বুদ্ধিবৃত্তিক সফরের খুবই খণ্ডিত একটি উপস্থাপন এখানে করা হলো। তাঁর এ–সম্পর্কিত অধিকাংশ রচনা নানা গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে। ইতিহাসের স্বার্থেই খুবই জরুরি কাজ হবে সেগুলোকে একত্রে সংকলন ও সম্পাদনা করা। এমনকি দশকওয়ারি বদরুদ্দীন উমরের চিন্তা ও কাজের বিকাশের একটা মানচিত্রও বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের একটা খতিয়ান নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)