গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি

সুলতানের দানবীয় মানবেরা কেন হারিয়ে যায়

সুলতানের তুলিতে সাধারণ মানুষ হয়ে ওঠে মহিমান্বিত, দানবীয়, অবিনাশী। কিন্তু ইতিহাসের পটভূমিতে তাদের পদচিহ্ন যেন ক্ষণিকেই মুছে যায়। এ লেখায় উন্মোচিত হয়েছে সেই হারিয়ে যাওয়ার সামাজিক-রাজনৈতিক কারণ।

১০ আগস্ট ছিল শিল্পী শেখ মোহাম্মদ সুলতানের (এস এম সুলতান) ১০১তম জন্মবার্ষিকী। গত বছরের শুরুর দিকে এস এম সুলতানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্​যাপন করার জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থান এবং তারপর পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তেমন কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়নি। জুলাই ঘোষণাপত্রের কারণে এ বছরের আগস্ট মাসও ছিল গত বছরের মতোই রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল। তারপরও ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সুলতানের স্মরণে বেশ কিছু অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। জুলাই ঘোষণাপত্র পড়তে পড়তে আমার মাথায় একটি প্রশ্ন জাগে, সুলতানের দানবীয় মানবেরা, অর্থাৎ এ দেশের সাধারণ মানুষের বিশাল আকার, প্রাণের বিনিময়ে ইতিহাসের মোড় ঘোরানো নায়ক হওয়ার পরও, তারা কেন তাদের অর্জিত ফল ঘরে নিয়ে যেতে পারে না।

সুলতান বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীদের একজন। প্রথম জীবনে তাঁর আঁকা ছবিগুলো ইম্প্রেশনিস্ট ধাঁচের হলেও ১৯৭৬ ও ১৯৮৭ সালের প্রদর্শনীগুলোতে তিনি এক নতুন রূপে আমাদের কাছে ধরা দেন। কামরুল হাসান ও শাহাবুদ্দিন আহমেদের মতো সুলতানের কাজেও মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব খুবই স্পষ্ট। শাহাবুদ্দিনের কাজে যেমন গতি প্রাধান্য পেয়েছে, সুলতানের কাজের বিশেষত্ব হচ্ছে তাঁর দানবীয় ফিগারগুলো। ফিগারগুলোর আকার এতই বড় থাকে যে সেগুলো আমাদের দৃশ্যপটে তীব্র প্রভাব বিস্তার করে।

আমরা দেখব, সুলতানের এই দানবীয় মানবেরা বাংলাদেশের রাজনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আবির্ভূত হয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে, ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে, ১৯৯০ সালের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে, সর্বশেষ ২০২৪ সালের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে।

বাংলাদেশের বহু শিল্পসমালোচক মনে করেছেন সুলতানের ফিগারগুলোয় বিখ্যাত রেনেসাঁ যুগের শিল্পী মিকেলাঞ্জেলোর প্রভাব রয়েছে। বাস্তবতা হলো, ছাপা বইয়ে মিকেলাঞ্জেলোর ফিগারগুলো দানবীয় আকারের মনে হলেও ভ্যাটিকানের সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদে আঁকা শিল্পকর্মগুলো সরাসরি দেখার অভিজ্ঞতা সে কথা বলে না। মেঝে থেকে সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদের উচ্চতা প্রায় ৬৬ ফুট বা ২০ মিটারের মতো। মেঝে থেকে ছাদে আঁকা ফিগারগুলো দেখলে স্বাভাবিক আকৃতির মনে হয়। কোনো কোনো ছবিতে ফিগারগুলোকে স্বাভাবিকের চেয়েও ছোট বলে মনে হয়।

আমাদের মনে রাখা দরকার, রেনেসাঁ শিল্পকর্মের সঙ্গে প্রাক্​রেনেসাঁ চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য কৌশলগত। রেনেসাঁ শিল্পীরা জ্যামিতিক পটভূমি কৌশল ব্যবহার করে দ্বিমাত্রিক অবতলে ত্রিমাত্রিক ভ্রম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে কৌশল ব্যবহার করে তাঁরা এ কাজটি করতেন, তাকে বলা হয় সিঙ্গল পয়েন্ট পারসপেক্টিভ। চিত্রকলার এ কৌশল ব্যবহার করে দ্বিমাত্রিক চিত্রতলে ত্রিমাত্রিক জগৎকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে বিভিন্ন বস্তুর আকার ও সন্নিবেশ বাস্তব জগতের মতো দর্শকের কাছে আরামদায়ক ও স্বাভাবিক মনে হয়। মিকেলাঞ্জেলো তাঁর চিত্রকর্মে বাস্তব জগৎকে উপস্থাপন করেননি। তিনি চিত্রায়িত করেছিলেন বাইবেলের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো।

অন্যদিকে সুলতানের ১৯৭৬ সালের প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত অনেকগুলো ক্যানভাসের দৈর্ঘ্য ছিল ৩০ থেকে ৪০ ফুট, প্রস্থ ছিল অনেক কম। শিল্পকর্মগুলো দূর থেকে দেখার জন্য আঁকা হয়নি, বরং আঁকা হয়েছিল অজন্তার দেয়ালচিত্রের মতো হাঁটতে হাঁটতে দেখার জন্য। হাঁটতে হাঁটতে কাছ থেকে দেখার জন্য ক্যানভাসগুলো প্রস্তুত করা হয়েছিল বলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের ফিগারগুলো ছোট আকৃতির হওয়ার কথা। কিন্তু মানুষের ফিগারগুলো তিনি আঁকলেন দানবীয় আকারে। ফিগারগুলো আঁকার সময় প্রকৃতপক্ষে সুলতান পাশ্চাত্যের জ্যামিতিক পটভূমির বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যাকরণ ভেঙে দিয়েছিলেন। অথচ আমাদের শিল্পসমালোচকেরা ভেবেছেন, তিনি পাশ্চাত্যের ব্যাকরণই আত্মস্থ করতে পারেননি।

কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, সুলতানের ফিগারগুলো কেন দানবীয়? অজন্তার দেয়ালচিত্রে বুদ্ধকে মহিমান্বিত করার জন্য অপরাপর সাধারণ মানুষের আকারের চেয়ে তাঁকে বিশাল আকারে উপস্থাপন করা হয়েছিল। সুলতানের চিত্রেও আমরা মহিমান্বিত করার প্রয়াস দেখি। তাঁর চিত্রে মহিমান্বিত করা হয়েছে সাধারণ মানুষকে, শ্রমজীবী মানুষকে, কৃষিজীবী মানুষকে। কারণ, তারা হাজার বছরের শাসন–শোষণের মধ্যেও টিকে থেকেছে। টিকে থেকেছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মধ্যেও।

আমরা দেখব, সুলতানের এই দানবীয় মানবেরা বাংলাদেশের রাজনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আবির্ভূত হয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে, ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে, ১৯৯০ সালের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে, সর্বশেষ ২০২৪ সালের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে। ১৯৬৯ ও ১৯৯০ সালের গণ–অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানের পার্থক্য আছে। ’৬৯ ও ’৯০-এর গণ–অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে রাজনৈতিক দল এবং তাদের ছাত্রসংগঠন। কিন্তু ২০২৪-এর অভ্যুত্থানে কোনো রাজনৈতিক দল নেতৃত্ব দেয়নি। এর সফলতার পেছনে ছিল সাধারণ মানুষের বিপুল আন্দোলনময় উত্থান।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র উপনিবেশের উত্তরাধিকার। ঔপনিবেশিক আমলে সাধারণ মানুষের ওপর যেমন দমন-নিপীড়ন চলত, পাকিস্তান আমলেও তা অব্যাহত ছিল। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে এই দমন–পীড়নের অবসান তো হয়ইনি, বরং গত দেড় দশকে তার মাত্রা আরও বেড়ে গিয়েছিল। এ ধরনের দমন, নিপীড়ন ও হত্যা মূলত মানুষকে বি–মানবায়নের সবচেয়ে বড় বহিঃপ্রকাশ। অন্যদিকে এর আরেক অস্ত্র যে সমাজের বিরাজনীতিকরণ, সেটিও বি–মানবায়নের আরেক রূপ। এই বিরাজনীতিকরণের উপায় ছিল মতপ্রকাশে বাধা দেওয়া, রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে না দেওয়া, সর্বোপরি সব ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতায় বাধা দেওয়া।

২০২৪ সালের জুলাই মাসে বিগত স্বৈরাচারী সরকার যখন শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে নির্বিচার হত্যা করতে শুরু করে, তখন সুলতানের উপজীব্য এই সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে। এস এম সুলতান এই অভ্যুত্থানের ছবি আঁকলে সাধারণ মানুষকে আরও দানবীয় রূপে প্রকাশ করতেন।

বিরাজনীতিকরণ উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর এক স্বাভাবিক প্রবণতা ও বাস্তবতা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর প্রায় সব সরকার বিরাজনীতিকরণের এই প্রক্রিয়া চালু রেখেছে। বিগত সরকারও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিরাজনীতিকরণ ঘনীভূত করেছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গত দেড় দশকে পুনঃ রাজনীতিকরণ ও নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি দিয়েছে। কিন্তু জনগণের সম্পৃক্ততা না থাকায় সে আন্দোলনগুলো ব্যর্থ হয়েছে। জনসম্পৃক্ততা না থাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে প্রথাগত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বিগত স্বৈরাচারী সরকার যখন শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে নির্বিচার হত্যা করতে শুরু করে, তখন সুলতানের উপজীব্য এই সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে। তারা শত বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে রুখে দাঁড়িয়ে সরকারের পতন ঘটায়।

এস এম সুলতান এই অভ্যুত্থানের ছবি আঁকলে সাধারণ মানুষকে আরও দানবীয় রূপে প্রকাশ করতেন।

জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের সাধারণ একটি আকাঙ্ক্ষা এই ছিল যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি হবে মানবিক। কিন্তু জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদে আবারও বিরাজনীতিকরণের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আইনসভার কাঠামো, উচ্চকক্ষ-নিম্নকক্ষের বিতর্ক, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ইত্যাদি বিষয়। অথচ সাধারণ মানুষের প্রাণের অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকারসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা থেকে মুক্তির কোনো দিকনির্দেশনা সেখানে নেই। আরও মারাত্মক বিষয় হলো প্রস্তাবিত জুলাই সনদের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে যে জরুরি অবস্থা চলাকালে জীবনের অধিকার এবং মানবাধিকার খর্ব না করার প্রসঙ্গ রাখা হয়েছে, সে বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনে উপস্থিত থাকা ৩৫টি দলের মধ্যে ছয়টি দল দ্বিমত পোষণ করেছে। তার মানে, সাধারণ মানুষের প্রাণের অধিকার রক্ষার জন্য এই গণ–অভ্যুত্থানে যে হাজারখানেক মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, আমাদের এই রাজনীতিবিদদের কাছে তা যথেষ্ট নয়।

ফলে গণ–অভ্যুত্থানে এত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পরও সুলতানের সাধারণ মানুষেরা কেন হারিয়ে যায়, সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। তার অন্যতম কারণ সুলতানের সাধারণ মানুষ হচ্ছে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘মাস’। অর্থাৎ ‘আম’, তারা ‘পলিটিকো’ নয়। অর্থাৎ তারা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত নয়। সুলতানের ছবিতে তাঁর দানবীয় মানবের রাজনৈতিক চেতনার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। তারা অভ্যুত্থানের নায়ক হিসেবে হাজির হয় ঠিকই, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দ্রুত হারিয়ে যায়, নামচিহ্নহীন ভিড়ের মধ্যে।

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়