অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

গল্প

ওয়াচ এয়ার শো

প্লেন টেকঅফের সময় নিজেকে বেলুনের মতো ফাঁপা লাগে। মনে হয় তার পাতলা খোলসটা শূন্যে উড়ছে। তারপরই অসীম শূন্যতা—জানালার বাইরে, খোলসের অভ্যন্তরে।

শূন্যতার ভার কী নির্ভার! শরীরজুড়ে ঝড়ে ওড়া পাতার মতো এলোমেলো অস্থিরতা চড়চড়িয়ে বাড়তে থাকে।

সচরাচর বিমান উড়তে থাকলে সে নিজের গোটা জীবন পাখির চোখে দেখতে পায়। তা ভালো লাগুক আর মন্দ লাগুক, মাঝারি গোছের জীবনই তো! রিলটা চলতে দেয় সে। কিন্তু এবার সেদিকে ছুটলে দৃষ্টিকে টেনে ধরে। লেন্সের ওপর কালো পর্দা টাঙিয়ে দেয়। তারপরও সেই আলো-আঁধার নিয়ন্ত্রণকারী পর্দা ভেদ করে সম্প্রতি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া একজন মানুষ, যার সঙ্গে দুই যুগের অখণ্ড জীবনযাপন, চলমান দৃশ্যের মতো হাজির হয়। এর আবহসংগীত অত্যন্ত করুণ যা অশ্রু ঝরাতে পারে, এমনকি লালবাতির সংকেত সত্ত্বেও সিটবেল্ট খুলে প্লেন থেকে লাফিয়ে পড়ার প্রেরণা জোগাতে পারে।

এভাবে বসে থাকলে পাগল হয়ে যাব, মাথা খারাপ তো হবেই হবে; মাথার একপাশ খামচে ধরে ভাবে সে। কেন এখন কোনো কাজ নেই আমার হাতে! এই যেমন সংক্ষিপ্ত প্লেন জার্নির পর এক ঘণ্টা প্রাণপণ ছুটে কানেকটিং ফ্লাইট ধরলাম। এর আগে প্লেনের পেট থেকে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে ঝুলন্ত মনিটর থেকে চোখে স্ক্যান করে একটা নম্বর তুললাম। তারপর নম্বরটা ঠোঁটে লয়ে দে ছুট... টার্মিনাল থেকে টার্মিনাল, শাটল ট্রেন, এস্কেলেটর, লিফট, বোতাম টিপে পাতালে প্রবেশ, শূন্যে ভাসা। গন্তব্য একটি গেট, একটি বুলন্দ দরওয়াজা—বিজয় তোরণ। অতঃপর নিষ্কাশন।

আহা, এমনই তো চাই! এর মানে সে দেখতে চায় যে নিজেকে কঠিন নিয়মে, শৃঙ্খলায় বেঁধে নিয়েছে। এই সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা অন্ধ ভিখারির সহকারীর মতো হাত ধরে তাকে চালাচ্ছে আর এটিই হচ্ছে তার নতুন জীবনের চাবিকাঠি; নিদেন মুক্তি—শোক থেকে, যন্ত্রণা থেকে। এখন যে সে একটা রেডিমেড ভিসা আর দূরপাল্লার ফ্রি টিকিট পেয়ে উড়ানে উড়ছে, তার জন্য নয় কি! এবার দরকার গন্তব্যে পৌঁছা অব্দি ছোট–বড় কোনো কাজে নিজেকে লাগাতার ব্যস্ত রাখা।

তার সামনের মিনি মনিটরে তুমুল তুষারপাত হচ্ছে। আর সেলোফেনে মোড়া হেডফোনটা কোলে কাত হয়ে পড়ে আছে। এটাকে সিটপকেটে চালান দিয়ে হাত বাড়িয়ে মনিটরের বোতাম টেপে সে। সক্রিয় হয়ে ওঠে পর্দাটা। তুষারপাত থেমে পর্দায় ভেসে ওঠে—ওয়াচ এয়ার শো অ্যান্ড ক্যামেরা...

দুবাই থেকে পারস্য উপসাগর পাড়ি দিচ্ছে তাদের বোয়িং বিমান। এর আগে আগে পথজুড়ে রোল করা কচি কলাপাতা-সবুজ গালিচা নিপাট বিছিয়ে দিচ্ছে অদৃশ্য এক খানসামা। সে এয়ার শো চলতে দেয় মনিটরে। মনে হয়, প্লেনের পেটে স্থির বসে থাকলেও সে স্থির নয়, অক্লেশে উড়ছে। চোখের পলকে নিচের শহর-নগর-সাগর-উপসাগরের মানচিত্রটা গুটিয়ে ছোট হয়ে যাচ্ছে।

এখন টাইগ্রিসের ওপর দিয়ে যাচ্ছে তাদের এয়ারপ্লেন। পাশে বড় করে লেখা—বাগদাদ। ১০ হাজার ৯৭২ মিটার ওপরে উড়ছে বোয়িং বিমান।

গাজায় কী হচ্ছে এখন?

একটা নীল হৃদ ঘিরে গেরুয়া মাটির ল্যান্ডস্কেপ। পুরাই খাকি রং। তার ওপর মহাকাশযানের মতো পর্দায় ভাসছে—‘তাবরিজ’। এর মানে তাবরিজের পাশ দিয়ে প্লেনটা যাবে এখন? দূরে যে ফিরোজা নীল জলাশয়, ওটা কি কাস্পিয়ান হৃদ? সাগরই বলে একে। পৃথিবীর স্থলভাগে পথ হারানো সমুদ্দুর!

খাবারের গন্ধ নাকে লাগতেই সামনের সিটপকেট থেকে সে মেনু কার্ড তুলে নেয়। আরেক হাতে ফের হেডফোন গোঁজে সিটপকেটে। আজ শব্দহীন শোর দর্শক তো সে।

মেনু দেখে সে ‘রোস্টেড চিকেন উইথ হার্বস’ আইটেম বেছে নেয়। ভালোবাসার মানুষটা রোস্টেড চিকেন বাদ দিয়ে বিফের পদটাই নিত, যেখানে ম্যাশড পটেটো আছে। তা শুধু বিফের জন্যই নিত সে। খেতে এত ভালোবাসত! পান করতে ভালোবাসত আরও বেশি। যার লিভার ছাড়া শরীরের আর সব ভালো ছিল, তার তো আশির ওপর বাঁচার কথা!

একফোঁটা চোখের পানি গাল বেয়ে ট্রের কিনারে পড়লে সে চট করে পাশের যাত্রীর দিকে তাকায়। অসতর্কতায় হাতের ছুরি ছিটকে পড়ে মেঝেতে। উইন্ডো সিটের লাল চুলের ছেলেটা, যে কান থেকে হেডফোন নামিয়ে বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে আকাশ দেখছে, তার থুতনিতে একরত্তি দাড়ি। কানজুড়ে গোল গোল মাকড়ি। আর রোদপোড়া ভাঙা গালে ইশকাপনের রাজার মতো পাকানো চিকন গোঁফ। তাদের দলটাই হল্লা করে ব্রিজ কাঁপিয়ে তার পাশ দিয়ে বিমানে উঠেছিল। মুখের পাশ, ঘাড়-গর্দান বা চুল রোদে পোড়া, ভাজা-ভাজা। নিজের দেশের শীত শেষে এশিয়ায় রোদ পোহায়ে ফিরছে। ছেলেটা তাদের দলছুট একজন, যে সোনালি বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে এখন হয়তো বিগত ভ্রমণ নিয়ে আকাশপাতাল ভাবছে।

একবার লম্বা প্লেন জার্নির পর মানুষটার নাক দিয়ে ব্লিডিং হলে সে ভয় পেয়ে যায়। বালিশের সাদা ওয়াড়ে খয়েরি রক্তের দাগ! ওটা কি ডিহাইড্রেশনের জন্য? প্লেনে অতিরিক্ত ড্রিংক করেছিল বোধ হয়! ভাবনাটা ওই পর্যন্তই। তা–ও সকাল না হতেই অনুসন্ধিৎসা মিলিয়ে যায়। দুশ্চিন্তা থাকে আরও কিছুদিন। তারপর নিজের কাজে মন দেয় সে। ভাবে, মাত্র কয়েক ফোঁটা রক্তই তো, তা যেকোনো কারণে হতে পারে। মানুষটা তখন বাহ্যত সুস্থই ছিল। জুন-জুলাই-আগস্ট মাস। সেপ্টেম্বরে এত ডিটোরিয়েট করল! দ্রুত ওজন কমতে থাকল। তারপর প্ল্যাটিলেট কমল। গায়ে জ্বর থাকত বেশির ভাগ সময়। যত সময় যাচ্ছিল, শরীর আরও খারাপ হচ্ছিল। পায়ের ব্যথাটাও তখন বোধ হয় হচ্ছিল। শরীরে গাউট–জাতীয় সোরাইসিস। এটা নাকি লিভার ডিজিজেরই উপসর্গ।

আচমকা অস্থিরতায় শরীরের উত্তাপ বেড়ে গেলে সে গা থেকে কম্বল নামিয়ে ফেলে। জুতার বেল্ট আগেই খোলা ছিল। এখন মোজা জোড়াও পায়ের পাতা থেকে ছাড়িয়ে নেয়। মেঝে থেকে ছুরিটা তোলে। অভুক্ত খাবারের ট্রেতে ঢাকনা লাগায়। দ্রুত ফিরে যায় মনিটরে।

স্ক্রিন থেকে টাইগ্রিস সরছে না। আর্মেনিয়ার উঁচু পর্বত থেকে নেমে আসা দীর্ঘ নদী তো! মনে হয় এর উজান ধরে প্লেনটা উড়বে। এটা এর উড়াল রেখা। টাইগ্রিসের তীরে বাগদাদ, সামারা, মাদাইন...

তার প্রায় ১১ হাজার মিটার নিচে বেধড়ক মার্কিন বোমাবর্ষণ আর লুণ্ঠনে বিরান হালের আল-মাদাইন নগরী। কীভাবে ঘোড়ার খুরের আঘাতে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ভুতুড়ে নগর জেগে উঠতে পারে! দেড় সহস্রাধিক বছর পূর্বের সাসানীয় সম্রাট খসরু অশ্বপৃষ্ঠে তিরাকৃতির খিলানের নিচ দিয়ে রাজধানী মাদাইন ছাড়ছেন। শিরিন আসছে আর্মেনিয়া থেকে। পথে দেখা হয় দুজনের, কিন্তু কেউ কাউকে চিনতে পারে না। একবার জলকেলিতে মগ্ন পথশ্রান্ত শিরিনকে ঘোড়ার আড়াল নিয়ে চুরি করে দেখেনও তরুণ সম্রাট খসরু। তা–ও চিনতে পারেননি। এভাবে মাদাইন-আর্মেনিয়া দুজনের ক্রস জার্নি, অশ্বখুরে আর পাথরে ঠোকাঠুকি মনে হয় অনন্তকাল চলছে। আর স্নানরত শিরিনের দীর্ঘ কেশ অক্টোপাসের অজস্র শুঁড়ের মতো এখনো গোল হয়ে ভাসছে নীল নীল জলতরঙ্গে।

মাদাইনকে মুছে দিয়ে পর্দায় ভেসে ওঠে কুর্দিদের শহর কিরকুক, তারপর মসুল। টাইগ্রিস প্রবহমান। ক্যামেরার বার্ড-আই ভিউতে ধরা দেয় ফের তাবরিজ। দূর থেকে উঁকি মারে কাস্পিয়ান সি। পৃথিবীর স্থলভাগে আটকে পড়া সমুদ্দুর!

খুব দমবন্ধ লাগে তার। কিছুতেই লিভার সিরোসিসের উপসর্গের ভাবনায় ফিরতে চায় না সে। তার রিক্ত মনটা তাবরিজের মতো শহরগুলোর সঙ্গে আত্মীয়তা খোঁজে। যুক্ত হতে চায় সেসব শহরের অতীত ইতিহাসের সঙ্গে। এভাবে বর্তমান-ভবিষ্যৎ মিলেমিশে শহরে শহরে একটা সুন্দর নেটওয়ার্ক তৈরি হতে পারে এবং তা অসম্ভব কিছু নয়। যেমন একটা উল্লম্ব রেখা কল্পনা করে নিলে তার ও শহরগুলোর মাঝখানের দূরত্ব মাত্র ১০ থেকে ১১ কিলোমিটার। এর চেয়ে বেশি দূরত্বে বসবাস করেও একই শহরের ভিন্ন মহল্লার দুজন মানুষ কখনো কখনো একে অন্যকে প্রতিবেশী ভাবে।

এভাবে কতটা সময় পার হয়, তার মালুম নেই। কয়েকবার গলাটা চেপে এলেও অশ্রু ঝরল না। চোখ দুটো জ্বালা করল শুধু। একসময় নিজেকে রুমাল হাতে শূন্যে ভাসতে দেখে সে, যে একে একে পর্দায় ভাসমান বুদ্‌বুদের মতো পিচ্ছিল শহরগুলোকে রুমালে ধরে হাতব্যাগে পুরছে।

পর্দায় আবার মাদাইন ভেসে উঠলে সে ভাবে, এই শিরিন-খসরুর কাহিনিটা কি প্রাচীন কবি নিজামি গাঞ্জাভির? না, আব্বাস কিয়ারোস্তামির দৃশ্যহীন ছবি শিরিন-এ সে তুমুল অশ্বধ্বনি শুনেছিল। আর ছিল তরবারির ঠোকাঠুকি, যুদ্ধের কোলাহল, আর্তনাদ। তা ছাড়া মর্মস্পর্শী সব সংলাপ ছিল, যা শুনতে শুনতে ১১০ জন অভিনেত্রী অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে নানা প্রকার মুখভঙ্গি করছিলেন।

ঝটিতি মনিটর থেকে তাকে দৃষ্টি সরাতে হয়। আইলের সিটে বসা মানে মহা বিড়ম্বনা। উইন্ডো সিটের ইশকাপনের রাজা বাথরুমে যেতে চাইলে সে আসন ছেড়ে আইলে গিয়ে দাঁড়ায়। এবার পুরো অবয়বটা চাক্ষুষ করে চমকে ওঠে সে। আরে! তার সামনে তো এক তাতার সৈনিক; উল্কি আঁকা, আধা মাথা কামানো! তারকোভস্কির মুভি থিয়েটার আন্দ্রে রুবলভের তাতার দলের মতো গায়ে বর্ম, মাথায় পালক বা শিরোস্ত্রাণ না থাকুক, না থাক হাতে ঢাল-তলোয়ার বা পিঠে তির-ধনুক। সিনেমায় তারা সদলবল দুর্গের গেট ভাঙছিল গাছের গুড়ি ঠেলে। সে সিটে বসতে বসতে ভাবে, কিসের সঙ্গে কী, ইউরোপগামী প্লেনের যাত্রীকে ভাবছে মধ্যযুগের তাতার সৈনিক!

বিমানের ঠিক নিচ বরাবর না হলেও ডানে বেশ একটু দূরে এখনো তাবরিজ। হু হু, ইরান কোনো ছোটখাটো দেশ নয়। বরাবরই যুদ্ধের হুমকিতে থাকা পৃথিবীর আদিভূমি। চেঙ্গিস খানের দুই সেনাপতি জেবে ও সুবুদাই সরদার এখনো যেন উত্তর ইরানের উপত্যকা, পার্বত্য অঞ্চলে ঘোড়া দাবড়ে বেড়াচ্ছে। তারা খুঁজছে খরেজমের পরাজিত বাদশাহ শাহ মুহম্মদকে। শুধু তো একের পর এক রাজ্য জয় আর ক্ষমতা প্রদর্শন করতে জনপদ তছনছ করলে চলবে না! পোষা প্রাণীর কথাও ভাবতে হবে। কুকুরটানা স্লেজে চেপে তাতার বাহিনী বরফের ওপর দিয়ে ছুটছে। সবুজ তৃণভূমি বা স্তেপের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের ক্ষুধার্ত প্রাণীগুলোকে।

পোষা প্রাণীগুলো যখন স্তেপে পরমানন্দে ঘাস খাচ্ছে, তখন তার একটু ভাতঘুমের মতো আসে। নিজের নাকডাকার শব্দটা স্বরযন্ত্রের ভেতর দিয়ে কানে পৌঁছালে ধড়ফড়িয়ে জেগে ওঠে সে। দেখে, উইন্ডো সিটের রাঙা চুলের ছেলেটা, যাকে সে একবার ইশকাপনের রাজা ও আরেকবার তাতার সৈন্য কল্পনা করেছিল, সেই বহুরূপী সিটের পিঠে মাথা ঠেকিয়ে মুখ খুলে নিরীহ ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছে। তাদের মাঝখানের ফাঁকা সিটটা আর ফাঁকা নেই। স্কার্ফ, শাল, কম্বলসহ নানা কিছুতে বোঝাই। কিছু তার, কিছু ছেলেটার আর আছে বিমান সংস্থার ভেড়ার লোমের দুখানা কম্বল। তারা হাত উল্টে পেছনের সিটেও মালসামান চালান দিতে পারত। ওই সারির সব আসনই তো ফাঁকা। এর পেছনেরটারও। তারপর আর সিট নেই। বাথরুম, ব্যারিকেড, তারপর ডাবলডেকার ফ্লাইটের ওপরতলায় ওঠার লাল কার্পেটে মোড়া সিঁড়ি।

সে প্লেনের চিপা আইলে কখনো আড়ে, কখনো সিধা হয়ে ক্যারি অন লাগেজ টানতে টানতে, টিকিট কাউন্টারের লোকেদের অভিসম্পাত দিতে দিতে ভাবছিল, এ পথ কখনো ফুরাবে না। অন্যায্যভাবে তাকে পেছনে ঠেলে দেওয়ার কারণ কী? জরুরি নির্গমন গেট কাছে, তাই দুর্ঘটনায় প্লেনের লেজটা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। তোমরা আমাকে লেজে বসার বোর্ডিং পাস দাও, এমন আবদার তো সে করেনি। বাঁচার ইচ্ছা মনে মনেও সে ব্যক্ত করেনি ঘুণাক্ষরে। তাহলে? বিমানের কোন সিট নিরাপদ, তার জন্য গুগলে কেউ কেউ খোঁজাখুঁজি করলেও, সে কাউকে পেছনের সিট চেয়ে কাকুতি-মিনতি করতে শোনেনি কখনো। প্লেন টেকঅফের আগ দিয়ে বিমান ক্রু যখন সিটবেল্ট, অক্সিজেন মাস্ক, ইমার্জেন্সি এক্সিট ডোর ইত্যাদি বিষয়ে রেকর্ড চালিয়ে মুখাভিনয় করে, তখন যাত্রীদের সবচেয়ে বেশি অমনোযোগী ও উদাসীন দেখা যায় বরং। বোর্ডিং, চেকিং, ইমিগ্রেশনজনিত পেরেশানির পর সবাই তখন আল্লাহর ওয়াস্তে নিজ নিজ আসনে শরীর ছেড়ে দিতে পারলেই বাঁচে। কোমরে বেল্ট বাঁধতেও রাজ্যের আলসেমি। কে সারাক্ষণ বাঁচার খায়েশ মাথায় নিয়ে হ্যাংলার মতো ঘোরে?

সে প্রথম ফ্লাইটে এক গ্লাস, দ্বিতীয় ফ্লাইটে আরেক গ্লাস রেড ওয়াইন নিয়েছিল। নাকের ডগাটা ব্যথা করছে। তার পর থেকেই ডিহাইড্রেশনের কথা ভেবে বিমান ক্রুর কাছে চেয়ে চেয়ে পানি খাচ্ছে কাপ কাপ। তবু আতঙ্ক যায় না। যদিও লিভারে তার সমস্যা নেই। এ মৃত্যুভয়, না বাঁচার আকুতি! তা মরতে চাইলে যেকোনো সময় মরাই যায়। বাঁচাটাই কঠিন। কঠিনেরে ভালোবেসে সেই বাঁচতে চেয়ে কঠিন মূল্য দিতে হচ্ছে নাকি তাকে!

সে লক্ষ করেছে, তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা নেই। বেঁচে থাকার স্বয়ংক্রিয় তাগিদ আছে বরং। তাই ঘরের এক জায়গার জিনিস আরেক জায়গায় সরানোর মতো নিজেকে নাড়াচাড়ার মধ্যে জীবন্ত রাখে, সতেজ রাখতে চায়। কখনো কখনো গভীর সংকটে নিজেকে সামনে দাঁড় করিয়ে দর্শক আসনে বসে সে। তারপর নানা অ্যাঙ্গেলে আয়না ধরে নিজেকে নিরিখ করে দেখতে থাকে দর্শকের চোখ দিয়ে।

এখানে কি মেডিটেশন সম্ভব? মনিটরে প্রেয়ারের কম্পাস হঠাৎ ভাসতে দেখে সে। কম্পাসের কাঁটা ঊর্ধ্বে কিবলা দেখাচ্ছে তির চিহ্ন দিয়ে।

সে পিঠ সোজা করে বসে চোখ বোজে। এখন স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস ও দমের ওপর রাখতে হবে পুরো খেয়াল। শ্বাস নিচ্ছে যতটা সময়, শ্বাস ছাড়াটা হবে এর দ্বিগুণ। তার অন্ধচোখের ঘোলা-হলুদ দৃষ্টি কিছুটা সময় নাকের ডগায় স্থির থেকে চোরের মতো নিঃশব্দে সরে যায়। দরজার তালা খুলে বাসায় ঢোকে। ধীরে ধীরে আসবাবে, দেয়ালে চোখ বোলায়। গন্ধ শোঁকে। শূন্য ঘর-বাড়ি। মৃত-নির্জীব। এত দিনের সংসার অবহেলায় ক্ষয়ে যাচ্ছে! ধুলায় মিশে যাচ্ছে! না, সিঁড়ি, ছাদ, বারান্দায় মানুষটার চলাফেরার শব্দ, আগে যেমন ছিল, তেমনই সাবলীল। তবে কিছুটা অধৈর্য। ঘন ঘন সময় দেখছে, তার জন্য অপেক্ষা করছে।

বেশ খানিকটা জোরজবরদস্তির পর দৃষ্টিটা আবার নাকের ডগায় ফিরে আসে। এখন স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস...

মানুষটা বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে কাত হয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কাছে যেতে মনে হলো, খুব অসুস্থ। আরও কাছে যেতে মাথাটা তার কাঁধে ফেলে দিল। আর নড়ল না।

সে চোখ খুলে নড়েচড়ে বসে।

যারা মানুষটাকে কাছ থেকে শেষ দেখা দেখেছে, ওরা তার চোখের কোলে কান্নার দাগ দেখেছে। সে শুধু প্রিয় মানুষটার কপাল ছুঁয়েছিল। খুব ঠান্ডা, বরফশীতল, যা আগে সে কখনো ছিল না। তখনো লাইফ সাপোর্টের মোটা নল ঠোঁটের কোণে ঝুলেছিল।

সে এয়ার ক্রুকে ডেকে পানি চায়। অস্থির চোখে তাকায় এদিক-ওদিক। আবার শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামে ফিরে যাবে? ধ্যানে বসে নিজের ঘরদুয়ার আর বাসার সামনের রাস্তায় হানা না দিয়ে মহাশূন্যযানের মতো যদি উড়তে পারত! বা মনিটরের মানচিত্রের শহরগুলোর মতো যদি স্রেফ মহাশূন্য আঁকড়ে ভেসে থাকতে পারত!

মনিটরে চোখ রাখে সে। মসুল বাঁয়ে রেখে অনেকটা এগিয়ে গেছে তাদের বিমান। এখন ভূমধ্যসাগর পাশ কাটিয়ে ইস্তাম্বুলের ওপর দিয়ে যাবে বোধ হয়। ইস্তাম্বুলের ওপাশে পানির দাগটা কি ব্ল্যাক সি?

মনিটরের পর্দায় ব্ল্যাক সির তুরন্ত আনাগোনা আর তার মনের পর্দায় বিপ্লবী কবি নাজিম হিকমত। একুশ বছরের তরুণ কবি খচ্চরের পিঠে বোচকা চাপিয়ে চড়াই ভাঙছেন। ব্ল্যাক সির উপকূলবর্তী শহর ছেড়ে যাচ্ছেন আঙ্কারায়। তাঁর যাত্রাপথের বাঁয়ে রোদঝলসানো ব্ল্যাক সি, সামনে বরফাচ্ছাদিত ইলগাজ পর্বতমালা, ডানে বসন্ত উৎসবে মাতোয়ারা উপত্যকা। চোখের নাগালে একই সঙ্গে ত্রিঋতুর কী অপূর্ব সমাগম! অথচ তুরস্ক তখন টালমাটাল। সবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেমেছে। সব কটা পরাশক্তির বিরুদ্ধে একা টার্কির জোর প্রতিরোধ লড়াই চলছে। গালিপোলি, ফিলিস্তিনে মার খাওয়ারা ছুটছে নতুন ফ্রন্ট আঙ্কারায়।

সে বর্তমানে চোখ ফেরায়। ইলগাজ পর্বতের দক্ষিণ ঢালে যেন আগুন লেগেছে, পপি খেতের এমনই অবিনাশী বাহার!

এখন তার বার্ড–আই ভিউতে ব্ল্যাক সির উপকূলবর্তী শহর বাটুমে নাজিম হিকমত। ১৯২২ সাল। রুশ বিপ্লবের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। সমাজতন্ত্র হলে টাকাকড়ির লেনদেন থাকবে না, এই বিশ্বাসে ইস্তাম্বুল থেকে জর্জিয়ার বাটুমে যেতে ব্ল্যাক সির বোটের ক্রুদের জিজ্ঞেস করেন হিকমত, ‘বাটুমে কি অর্থের মূল্য আছে? কমিউনিস্ট দেশ যখন, এত দিনে নিশ্চয়ই মুদ্রা বিলুপ্ত হয়ে গেছে!’ তার পকেটে তখন ৫০ লিরা। তা থেকে ৪৯ লিরা তিনি ক্রুদের বিলিয়ে দেন, যারা ছিল সোনা চোরাচালানকারী, পরে জেনেছিলেন তিনি।

বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা স্মৃতি। সেই কবে দুনিয়া থেকে হাপিস হয়ে গেছে! কত ধারণা, কত জানবাজি রাখা বিশ্বাস, রক্তপাত মিথ্যা হয়ে গেছে! তার বুকে বিশাল বিশাল বরফের চাঁই ভেঙে ভেঙে পড়ে। এই পোস্ট-ট্রুথ জমানায় নিজেকে কোথায় থুয়ে একা একা বাঁচবে সে?

বোয়িংয়ের বেগের সঙ্গে তার অতীত-বর্তমান ছোটাছুটির গতির ভারসাম্য নষ্ট হলে সে বোতাম টিপে মনিটর বন্ধ করে। পর্দায় তুষারপাত শুরু হয়ে যায়।

....

ওরা বলত, ‘জীবন সবকিছু সয়ে নেয়। ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নেয় শোকতাপ। তোমারটাও নেবে।’ 

ওরা বলত, ‘ও তো নিয়ম মানত না। অপরিণামদর্শী ছিল। তুমি ভুলে যাবে। সফরের ফিরতি পথে শোক সামলে ফুরফুরে হয়ে যাবে। ঝরঝরে লাগবে নিজেকে। অনেক দিন তো রোগী টানলে! সেই ক্লান্তিও চলে যাবে।’

কই সেই ফুরফুরে, ঝরঝরে হয়ে ঘরে ফিরে চলা? কোথায় সেই ভুলে যাওয়া? অবশ্য সে ভুলতে চাইলে তো! 

কে আসলে ভুলতে চায়?

তার চোখের পর্দায় মানুষটার ছায়া ডুবসাঁতার দেয়। সে প্লেনের জানালা দিয়ে শূন্যে তাকায়। দৃষ্টিটা অসীম নীলে হারিয়ে গেলে একাকিত্ব, নীরবতা আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরে।

আজ মনিটর বন্ধই আছে। ঘরে ফিরে প্রিয় মানুষটার সঙ্গে দেখা হবে না। আর কোনো দিন দেখতে পাবে না। ভাবনাটা মনে আসামাত্র ভারী পাথর ঠেলে সরানোর মতো প্রাণপণে তাড়াতে চায় সে।

চোখের সামনে তাদের ফ্ল্যাটের রুমগুলো ভেসে ওঠে...

মানুষটা এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাচ্ছে। বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়াচ্ছে। সিগারেট নিভিয়ে কম্পিউটার টেবিল থেকে উঠছে। গান গাইতে গাইতে শাওয়ার ছাড়ছে। ডাইনিং টেবিলে সে ব্রেকফাস্টে দুটো সেদ্ধ বা পোচ ডিম রাখত। বিকেলে আরও দুটো। মানুষটার প্রোটিন দরকার ছিল। দুপুরে রান্নাঘরে ও সালাদ বানাত আর মানুষটা অসুস্থতা নিয়েও হরেক মসলা সাজিয়ে রাঁধত তার পছন্দের খাবার।

সে আজ ফিরছে তাদের অনুপম গৃহে।