গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

মৃদুল মধুর সন্তরণ

অসংগঠিত জনতার প্রজ্ঞা এবং উচ্ছৃঙ্খল জনতার উন্মত্ততা

জীবন এত ছোট কেন? এই আক্ষেপ নেই, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। অথচ জীবন উপভোগের উপকরণ কত বিপুল! জানার–বোঝার, দেখার–শোনার, পড়ার–সক্ষমতার অপরিসীম সীমাবদ্ধতা নিয়েই বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে জি এইচ হাবীব -এর নিয়মিত পাক্ষিক— মৃদুল মধুর সন্তরণ

আদিতে ছিল উচ্ছৃঙ্খল জনতার ভিড় (মব), আর এই ভিড় ছিল মন্দ। এডওয়ার্ড গিবনের ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রচিত বই ‘ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার’-এ হরহামেশাই রোমক ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতার ভিড়’ দেখা যায়; এবং প্রায়ই তারা কোনো না কোনো আপসহীন কর্তৃত্ববাদী গলাবাজ নেতার প্ররোচনায় শোরগোল তুলে মুফতে খাবারদাবার আর বিনোদনের (রুটি ও সার্কাস) দাবি জানায়। যদিও শাসনক্ষমতা তাদের হাতে যায় না, কিন্তু শাসন কে করবে না করবে সেটা তারা কখনো-সখনো ঠিক করে দেয়।

গিবন ছিলেন, যাকে বলে, একধরনের রক্ষণশীল র‍্যাডিক্যাল; খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে ভীষণ অবজ্ঞা পোষণ করতেন, আর তাঁর গা ঘেঁষাঘেঁষি ছিল মুক্ত চিন্তার অধিকারী এপিকিউরিয়ানিজমের সঙ্গে, অর্থাৎ চতুর্থ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এথেন্সে বাস করা সেই দার্শনিক এপিকিউরিয়াসের ‘আনন্দ বা সুখই পরম মঙ্গল, এবং সুখ আসে সংযম, সরলতা, বন্ধুত্ব এবং সম্প্রদায় থেকে’, এই মতবাদের অনুসারী ছিলেন তিনি। কিন্তু গিবন আবার সামাজিক অব্যবস্থাকে ভয় পেতেন। উচ্ছৃঙ্খল জনতার ভিড় বলতে তিনি বুঝতেন তাঁর নিজের শহর লন্ডন বা রোমের মতো কোনো বড় শহরের লুম্পেনপ্রলেতারিয়েত তথা শ্রেণিচেতনাহীন নিম্নবর্গীয় লোকজনকে (উল্লেখ্য, ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে গিবন রোম সফর করেন এবং সে বছরেরই ১৫ অক্টোবর রোমের বিখ্যাত সাতটি পাহাড়ের একটি ক্যাপিটিলাইন বা ক্যাপিটলের ধ্বংসাবশেষ দেখে তিনি এমনই অভিভূত হয়ে পড়েন যে সেই অভিজ্ঞতাই তাঁকে ’ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার’ লেখার অনুপ্রেরণা জোগায়)।

ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের পটভূমিতে রচিত চার্লস ডিকেন্সের প্রথম উপন্যাস ‘পিকউইক পেপার্স’-এর নামচরিত্র পিকউইক সাহেবকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় যে একটা সাধারণ নির্বাচনের সময় উচ্ছৃঙ্খল জনতার দুটো ভিড় পরস্পরকে লক্ষ করে স্লোগান দিতে থাকলে কী করা উচিত। তখন পিকউইক মহাশয় তাঁর স্বভাবসুলভ প্ররোচনামূলক উত্তরে বলেন, ‘যে দলটা বড় সেটার সঙ্গে গলা মেলানো।’ ধীরে ধীরে উচ্ছৃঙ্খল জনতার ভিড় সম্পর্কে এই আতঙ্কজনক ধারণা বদলে যায়। সে জায়গায় আসে ‘অসংগঠিত জনতার ভিড়’-এর একটা প্রতিচ্ছবি, যে জনতা অধিকাংশ সময়েই ভালো, আর যখন খারাপ তখন তা যেকোনো কিছুর চাইতে কমিক বা মজাদার।

চার্লস ম্যাক বলে এক ভদ্রলোক ১৮৪১ সালে একটা ঢাউস বই লেখেন: ‘এক্সট্রাঅর্ডিনারি পপুলার ডিলিউশনস অ্যান্ড দ্য ম্যাডনেস অব ক্রাউডস’ নামে। বইটিতে হল্যান্ডে টিউলিপ কন্দ (বাল্ব) বা লন্ডনে সাউথ সি কোম্পানির শেয়ার কেনার জন্য জড়ো হওয়া যে লোকজনের কথা বলা হয়েছে, তারা সবাই ছিল উন্মত্ত; ভীষণভাবে একই বিভ্রান্তির শিকার হয়ে এবং বাইরের কারও কারসাজিতে নয় বরং নিজেদেরই সম্মিলিত অযৌক্তিক আচরণের কারণে তারা নিজেরাই নিজেদের আর্থিক সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। এই বিশৃঙ্খল জনতা তাদের ‘উন্মত্ত’ ফাটকাবাজিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেরাই নিজেদের ‘শিকার’ করেছিল (‘টিউলিপ ম্যানিয়া’ বা ‘সাউথ সি বাবল’ নামে বিখ্যাত সেই অর্থনৈতিক বুদ্‌বুদে জনতা টিউলিপ কন্দের বা বাল্বের যে চাহিদা তৈরি করেছিল তা সেই কন্দের দাম কিছুদিনের মধ্যে আকাশচুম্বী করে তুলেছিল এবং যেসব মানুষ সেই অতিস্ফীত মূল্যে টিউলিপ কিনেছিল তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। রক্ষা পেয়েছিল তারা, যারা সেগুলো আগেভাগে বিক্রি করে দিয়েছিল)।

এই অসংগঠিত জনতার ভিড়কে দুভাবে দেখা যেতে পারে। সেটাকে ‘জনসাধারণ’ও (পিপল) বলা যেতে পারে। জনসাধারণের এই ধারণা শক্তিশালী, তবে বেশ দ্ব্যর্থবোধক, রহস্যময়। অনেক সময় সেটার একটা গ্রহণযোগ্যতা বা অনুমোদন থাকে। উদাহরণস্বরূপ, যখন বলা হয়—‘আমরা, যারা জনগণ’ তখন অংশভাগী অধিকার আর গণতান্ত্রিক রীতিনীতিভিত্তিক একটি সবার অন্তর্ভুক্তিমূলক নাগরিক ধারণাকে বোঝানো হয়। আবার তাদেরই ঘৃণাযোগ্য হিসেবেও দেখা যেতে পারে, যেমন নাৎসিরা যখন সেই ‘ফক’ (Volk)-এর নির্ভেজালত্বের প্রচার করত, যে ফকের রক্ত নাকি বহিরাগতদের দ্বারা দূষিত হচ্ছিল, তখন সেই জনসাধারণের ধারণাটিই একটি বিশেষ, অনুদার, জাত্যভিমানমূলক ধারণায় পরিণত হয়।

আরও পরে, অসংগঠিত জনতার ভিড় একটি পুরোপুরি ইতিবাচক শক্তি ও পুরোপুরি সমষ্টিগত কুশলতা নিয়ে ফিরে এসেছিল, যে কুশলতা বা দক্ষতা বা সক্ষমতা বিচ্ছিন্ন একজন মানুষের পক্ষে অর্জন বা প্রদর্শন করা সম্ভব নয়। প্রকাশিত হতে হয়েছিল অসংগঠিত জনতার প্রজ্ঞা নিয়ে নানা বই, অন্যদিকে ‘হু ওয়ান্টস টু বি আ মিলিয়নিয়ার’-এ জটিল কোনো প্রশ্নে আটকে গেলে তার জবাব দেওয়ার সেরা উপায় হিসেবে দর্শকদের একটা অংশের দ্বারস্থ হতে হয়, যে দর্শকেরা কিনা একজন চালাক-চতুর প্রতিযোগীর চেয়ে একটি দল হিসেবে আরও বেশি চৌকস। আবার ‘ক্রাউডসোর্সিং’ হয়ে দাঁড়ায় বেশ নন্দিত একটি বিষয়। এরপর ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের ৯ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটলে যা ঘটল (বা, বাংলাদেশে, ২০২৪ সালে ৫ আগস্টের পর), তাতে যেন একবিংশ শতকের সেই কুইজ শোর জনতা মিশে গেল রোমক উচ্ছৃঙ্খল জনতার ভিড়ের মধ্যে: যে রাষ্ট্রদ্রোহীদের লক্ষ্য ছিল—এক গলাবাজ নেতার কথায় প্ররোচিত হয়ে—খোদ আইন নামক ধারণাটিকে ধ্বংস করা।

কিন্তু এই অসংগঠিত জনতার ভিড় কি আসলেই বদলেছে, নাকি ব্যাপারটা স্রেফ এই যে যেসব শব্দ দিয়ে জনতার এসব ভিড়কে বর্ণনা করা হয় তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে? জনতার ভিড় কি আসলে কেবল বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ভিন্ন ভিন্ন লোকজনের সার্বক্ষণিকভাবে বদলাতে থাকা জমায়েত? নাকি যেমনটা বুলগেরীয় ব্রিটিশ লেখক এলিয়াস কানেটি মনে করতেন যে একটি স্থানে সমবেত হয়ে এক সংক্ষুব্ধ দলে পরিণত হওয়া লোকজন একটা স্বাধীন সত্তায় পরিণত হয় এবং নিজস্ব রীতিনীতি দ্বারা চালিত হয় এবং তারা এমন সব কাজ করে বা কাণ্ড ঘটায় এবং এমনভাবে ঘটায়, যেটা কিনা ওই দলে থাকা লোকজনের কেউ একা থাকলে করত না। কানেটি এই জনতাকে ‘বদ্ধ’ এবং ‘উন্মুক্ত’ বা ‘অবাধ’, এই দুই ভাগে ভাগ করতে চান: ‘উন্মুক্ত’ বা ‘অবাধ’ ভিড় হচ্ছে তেমন একটা ভিড়, যেখানে নানা মত ও পথের মানুষ একটা সাধারণ (কমন) উদ্দেশ্য নিয়ে সমবেত হয়, যদিও সেই উদ্দেশ্য ঠিক কী সেটা সব সময় সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত থাকে না; ঠিক এ রকম ভিড়ই বাস্তিল দুর্গে ঝড়ের বেগে হানা দিয়েছিল। আর ‘বদ্ধ’ ভিড় হচ্ছে পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য একটি সংগঠিত সমাবেশ বা জমায়েত। জনতার এসব ভিড় সামাজিক শ্রেণিকাঠামোকে নাড়া দেওয়ার বদলে সেটাকে আরও জোরদার করে (দ্রষ্টব্য, ১৯৬০ সালে প্রকাশিত কানেটির বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মাসে উন্ড মাখট’ বা, ইংরেজি অনুবাদে, ‘ক্রাউডস অ্যান্ড পাওয়ার’। ১৯২৭ সালে সংঘটিত অস্ট্রিয়ার জুলাই বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থান ছিল কানেটির এই বই লেখার অনুপ্রেরণা)। ইউরোপীয় মধ্যযুগের গোড়ার দিকটির কথা যে জনতার ভিড়ের ইতিহাসে বিশেষভাবে আলোচিত হয় না সেটার কারণ, এই কালপর্বের জমায়েত বা ভিড়গুলো ছিল প্রবলভাবে ‘বদ্ধ’।

১৯২৭ সালের জুলাই বিদ্রোহ ছিল অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় একটি বড় দাঙ্গা, যা ১৫ জুলাই শুরু হয়েছিল

তবে বদ্ধ বা উন্মুক্ত যা-ই হোক, অসংগঠিত জনতার ভিড় বরাবরই ঐতিহাসিক প্রতিভূ হিসেবে টিকে থাকে এবং সেটা তার একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণেই গবেষণার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও মধ্যযুগ–বিশেষজ্ঞ শেন বব্রিকি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ২০২৪ সালে বের হওয়া তাঁর নতুন বই ‘দ্য ক্রাউড ইন দ্য মিডল এজেস’-এ লোকজন অসংগঠিত জনতার ভিড় সম্পর্কে যা কিছু ভেবে এসেছে তার একটা ক্রান্তিকাল বা সন্ধিক্ষণের বর্ণনা দিয়েছেন। এটা হচ্ছে সেই সময় যখন সমাজের ত্বরিত বি-নগরায়ণ রোমক ‘ভালগাস’ বা ‘মব’কে সংকুচিত বা নিকেশ করে ফেলেছে, কিন্তু আবার, এই সময়েই রোমক শৃঙ্খলা বা বিশৃঙ্খলা প্রলম্বিত হয়েছে। সাবেকি ধাঁচের অত্যন্ত পরিশ্রমী গবেষণার ফসল এ বইয়ে বব্রিকি ইউরোপে ৫০০ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মানুষের সংঘবদ্ধ আচরণের গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। আর তা করতে গিয়ে ‘অসংগঠিত জনতার ভিড়’ (ক্রাউড), ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতার ভিড়’ (মব), আর জমায়েত বা সমাবেশ (গ্যাদারিং) বোঝায় এমন প্রায় সব লাতিন শব্দ হাতড়ে অর্থের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রকমফের খুঁড়ে বের করেছেন। মধ্যযুগীয় ইউরোপে ‘ভালগাস’, ‘প্লেবস’, ‘তুর্বা’, ‘পপুলাস’ আর ‘রাস্তিসি’—এই শব্দগুলোর মধ্যকার সূক্ষ্ম তফাত নির্ণয় করার জন্য যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে উন্মুখ হয়ে রয়েছেন বা ছিলেন, অবশেষে তাঁদের সাহায্য করতেই যেন এ বইটি প্রকাশিত হয়েছে। এবং প্রকৃত অর্থেই এই পার্থক্যগুলো তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন—যখন ভালগাসকে জোর করে মুমূর্ষু নগরগুলো থেকে বের করে গ্রামাঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন তারা হয়ে যায় রাস্তিসি—পিচফর্কধারী কৃষক। (উল্লেখ্য, ধ্রুপদি লাতিনে ‘ভালগাস’ বলতে জনসাধারণ বোঝালেও, তার মধ্যে ‘মব’ বা ‘র‍্যাবল’-এর নেতিবাচক দ্যোতনাও ছিল।) আর ধ্রুপদি লাতিনে যা ছিল ‘প্লেবস’, যার মানে ‘সাধারণ লোকজন’, যাদের পদ-পদবি বা মর্যাদা নেই (কমন ফোক), সেটার অর্থ হয়ে যায় আরও নির্বিশেষ বা সাদামাটাভাবে, ‘গোষ্ঠী’ বা ‘জনগোষ্ঠী’। বব্রিকি আমাদের নিশ্চিত করেন, এমনকি ভালগাসও আরও বিশদ বা সুস্পষ্ট ‘পপুলাস’–এর সমতুল্য আরেকটি শব্দ হতে পারত এবং ‘ক্রাউড’ বলতে আধুনিক সময়ে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয় তার ধারণাটা ভালগাস থেকেই এসেছে।

বব্রিকি যে কালসীমার ওপর তাঁর মনোযোগ নিবদ্ধ করেছেন সেটা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিটি দ্ব্যর্থবোধক। ওদিকে গিবনের দৃষ্টিভঙ্গিটা কিন্তু বেশ স্পষ্ট আর সহজ–সরল বলে মনে হতে পারে: জীবন একসময় বেশ ভালো ছিল, তারপর অন্ধকার নেমে এল। তার কারণগুলো জটিল হলেও—যাতে খ্রিষ্টান আর বর্বরেরা দুপক্ষেরই দায় ছিল—ফলাফলটা ছিল পরিষ্কার। উল্টো দিকে, চরম বিপর্যয়কর বলে মনে হয় এমন কিছুর বর্ণনা বব্রিকি দেন বটে, কিন্তু তিনি সেটাকে ঠিক সেভাবে দেখানোর চেষ্টা করেন না খুব একটা। তারপরও, এ কথা তো ঠিক যে একটা সময়ে ব্রিটেনে উষ্ণ স্নানাগার (হট বাথ) ছিল (রোমকরা যা সেখানে ৬০ থেকে ৭০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে চালু করেছিল), তারপর একদিন সেসব অদৃশ্য হয়ে গেল (ব্রিটেন থেকে রোমকরা চলে যাওয়ার পরে, পঞ্চম শতকে)। বব্রিকি যেটাকে অন্ধকার যুগ বলতে রাজি নন, সেই কালে জনসংখ্যার যে হ্রাস ঘটেছিল তাতে করে সমাজের গুণগতমানের ইতরবিশেষ হয়নি বলে দাবি করছে তাঁর গ্রন্থ ‘দ্য ক্রাউড ইন দ্য মিডল এজেস’। কিন্তু আসলেই কি তাই? অর্থনৈতিক এবং সামরিকভাবে শক্তিশালী সংস্কৃতিমান রোমক জাতি—তা সেটা যতই নিষ্ঠুরতা, জনসমক্ষে হত্যা আর দাসব্যবস্থার ক্ষতলাঞ্ছিত হোক—সেটা স্পষ্টতই সেই স্থানটির চেয়ে বেহতর ছিল, যেখানে উল্লিখিত মন্দ ব্যাপারগুলো থাকলেও সেই ভালো জিনিসগুলোর কোনোটাই ছিল না।

সে যা–ই হোক, মধ্যযুগের গোড়ার দিকে ৫০০ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ইউরোপ জনসংখ্যা হ্রাস আর বি-নগরায়ণের জন্য বিশিষ্ট হয়ে আছে। কারণ, খারাপ হতে থাকা আবহাওয়া, নিরন্তর যুদ্ধবিগ্রহ এবং ধারাবাহিক কিছু প্লেগ মহামারি। বদ্ধ ও উন্মুক্ত, দুই ধরনের জনতার ভিড়ই সে সময় যেন সর্বনিম্ন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিল। প্রাচীন ইংরেজি কবিতা ‘দ্য রুইন’-এ আমরা বাথ নগরটিকে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় দেখতে পাই: ‘ছাদগুলো ধসে পড়েছে, বুরুজগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত,/ আংটি–সদৃশ ধাতব ফটক বিধ্বস্ত, চুন-সুরকির ওপর তুষার বিস্তৃত।’ ‘দ্য ওয়ান্ডারার’ কবিতার কথক ‘নির্বান্ধব’ অবস্থায় বিরান ভূমির ভেতর দিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে পথ চলতে চলতে তার স্বজনের মৃত্যুতে বিলাপ করে চলেছে। গ্রেন্ডেলের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার আগে বিউল্ফ হিওরট নামের যে পানঘরে ভোজসভার আয়োজন করে, সেটার অবস্থান একটা জলাভূমির ভেতর। বব্রিকি এক চমৎকার ঊনভাষণ বা আন্ডারস্টেটমেন্টের মাধ্যমে বলছেন যে মধ্যযুগের এই গোড়ার দিকটায় ‘জমায়েত বা সমাবেশের সরবরাহে কম পড়েছিল’। তার জায়গায় তিনি লক্ষ করেছেন জনতার ছোট ছোট ভিড়ের উত্থান: যেহেতু সে সময় ভ্রমণ ছিল বিপজ্জনক, উচ্চপদস্থরা লোকলস্কর বা পারিষদবর্গ বা সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে চলাচল করতেন। এমনই মোক্ষম ছিল এই আবিষ্কারটি যে এখনো আমরা তার ব্যবহার দেখে থাকি, তা সেটা আমেরিকার হিপ হপ সংস্কৃতির রাঘব বোয়াল শিল্পীদের বেলাতেই হোক বা নানা দেশের নেতা বা পাতিনেতাদের বেলাতেই হোক, যাঁরা প্রায় একই রকমের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণেই মূলত কাজটা করেন। সেই সঙ্গে নিজেদের গুরুত্ব বা জাঁক দেখাতেও বটে।

উল্টো দিকে, জনতার বড় ভিড়ের অবনমন ঘটল। সত্যি বলতে কি, জনতার ভিড় যে শাসকদের মন্দ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ‘না’ বলার একটা ক্ষমতা সংগত কারণেই অর্জন করেছিল, এই জোরালো ধারণাটিই মধ্যযুগের ইউরোপে ভীষণভাবে অগ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল। জনতার ভিড়কে প্রায়ই মেয়েলিপনা বা নারীত্বের সঙ্গে যুক্ত করা হলো এবং ‘হিস্টিরিয়াগ্রস্ত নারী’র সঙ্গে সেটার সাদৃশ্য খোঁজা হলো। কারণ, উচ্ছৃঙ্খল বা অসংগঠিত জনতার ভিড়ের আচরণকে প্রায়ই অযৌক্তিক, আবেগময় ও আদিম বলে মনে করা হতো; আর তার বিপরীতে পুরুষোচিত ব্যবহার বলে ভাবা হতো যৌক্তিক ও সংযত ব্যবহারকে। এ প্রসঙ্গে বহুবিদ্যাবিশারদ ফরাসি গুস্তাভ লা বোঁ তাঁর বিখ্যাত ‘লা সিকোলজি দে ফুল’, (‘সাইকোলজি অব ক্রাউডস’)-এ কী লিখেছেন দেখা যাক: ‘জনতার বিশেষ চারিত্রিক লক্ষণাদি হচ্ছে আবেগপ্রবণতা, অস্থিরতা, যৌক্তিক চিন্তায় অক্ষমতা, বিচার-বিশ্লেষণ দৃষ্টিশক্তির অভাব, ভাবপ্রবণতার আধিক্য—যা কিনা সাধারণত নারীকুল, আদিম অধিবাসী এবং বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে প্রবল আকারে পরিলক্ষিত হয়।’ (‘জনতা’, অনুবাদ: নূর মোহাম্মদ মিঞা, বাংলা একাডেমি, আষাঢ় ১৩৯১, জুন ১৯৮৪)

অন্যদিকে সে সময়ের বদ্ধ ভিড়গুলোর মধ্যে ছিল ধর্মীয় নানা মিছিল এবং এমন সব সমাবেশ বা জমায়েত, যেগুলো এমন পরিকল্পতিভাবে আয়োজন করা হতো, যাতে করে বব্রিকির ভাষায়—‘স্বতঃস্ফূর্ত মতৈক্য’র একটা বিভ্রম তৈরি করা যায়। এমন একটা ঘটনা ইতিহাসে অত্যন্ত স্মরণীয় হয়ে আছে। উত্তর ইতালির র‍্যা ভেন্নায়, ৭০০ খ্রিষ্টাব্দে কয়েকটি পৌরসভার মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত ‘গেম অব থ্রোনস’-এর ‘রেড ওয়েডিং’ হত্যাযজ্ঞের মতো একটি ভয়াবহ ও ব্যাপক খুনোখুনিতে শেষ হয়। রুটি ভাঙার মতো তুচ্ছ খ্রিষ্টীয় আচার নিয়ে দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে একটি গোষ্ঠীকে নিকেশ করে দেওয়া হয়। আর তারপর স্থানীয় বিশপ গোটা শহরকে বাধ্য করেন একটা ধর্মীয় কৃত্যমূলক শোভাযাত্রা বা মিছিল বের করতে। রক্তের হোলি খেলায় মত্ত যে উন্মুখ জনতার ভিড়, সেটাকে অনুতাপমূলক কৃত্য পালনকারী জনতার বদ্ধ ভিড়ে পরিণত করা গেল।

বেশ কিছু প্রশ্ন রেখে বব্রিকি তাঁর বইয়ের ইতি টেনেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য হচ্ছে উচ্ছৃঙ্খল অথবা অসংগঠিত জনতার ভিড়ের ধারণাটি যে একটি সুনির্দিষ্ট একক জিনিস বলে ভাবা হয় সেটাকে দূর করে তার বদলে একটি নিয়ত পরিবর্তনশীল এবং অনির্দিষ্ট বিষয় হিসেবে আমাদের কাছে তুলে ধরা, যে জনতাকে কখনো কখনো শাসকশ্রেণি নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করে থাকে—জনতাকে দিয়ে তারা সেসব কাজ করায় যেসব কাজে তারা জনতাকে উৎসাহিত করতে চায়, যাতে সেসব কাজের ফলাফল বিরূপ হলে নিজেদের তার দায় নিতে না হয়, বরং জনতাকে একটা শিখণ্ডী হিসেবে দাঁড় করিয়ে তাদের ওপর দায় চাপানো যায়। বব্রিকি আমাদের দেখান যে সেই জনতার ভিড় আমাদের মাঝেমধ্যে এক অদ্ভুত ও রহস্যময় উপায়ে বিবর্ধিতভাবে রোমক কৃত্য (রিচুয়াল) আর সাহিত্যের মতো দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়।

মধ্যযুগের গোড়ার দিকে ‘নিউ টেস্টামেন্ট’কে পবিত্রতম গ্রন্থ বলে ইউরোপে গণ্য করা হলেও, বব্রিকির মতে, সেটা ছিল মূলত একটা রোমক ‘দলিল’, রোমক সংস্কৃতি, রাজনীতি দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত; এমনকি এমন হওয়াও বিচিত্র নয় যে সেটা আসলে রোমক স্বার্থরক্ষাকারী একটি রচনা যেখানে সাবেক যুগের ঘটনাবলির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেই ঘটনাবলির একটিতে দেখা যায় নগরের উচ্ছৃঙ্খল জনতার একটি ভিড় বা জমায়েত চিৎকার বলছে, ‘বারাব্বাসকে ছেড়ে দাও। আমরা বারাব্বাসকে চাই।’ (উল্লেখ্য, আমরা সুসমাচার বা গসপেল থেকে জানতে পারি পাসওভার উৎসব উপলক্ষে রোমক প্রদেশ জুডিয়ার শাসক পন্টিয়াস পাইলেট কিছু বন্দী অপরাধীকে মুক্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন এবং তখন সে সময়ে কারাবন্দী যিশু আর খুনি ও বিদ্রোহী বারাব্বাসের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে বললে সেই জনতা কিছু পাদরি ও জ্যেষ্ঠ নাগরিকের কথায় প্রভাবিত হয়ে যিশুর বদলে বারাব্বাসের মুক্তি দাবি করে।)

তো বব্রিকি এই বলে উপসংহার টানছেন যে ‘সামগ্রিক ঘটনাটির পরিপ্রেক্ষিতে সেই অশান্ত উচ্ছৃঙ্খল জনতার ভিড়কে নিন্দা করার উদ্দেশ্যে নিউ টেস্টামেন্টে তাদের বর্ণনা দেওয়া হয়নি, হয়েছিল সে সময়ে অন্তরালে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল সেটাকে ঘোলাটে বা অস্পষ্টভাবে উপস্থাপিত করার জন্য। এমনকি যে ঐতিহাসিক সময়ে জনতার বড় বড় জমায়েত সাধারণত ঘটত না বা ছিল না, তখনো জনতার ভিড়ের এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল—একটি ধারণা ও স্বপ্ন হিসেবে এবং জনতার শাসনের কাঠামো বলতে আমরা আধুনিক যুগে যা বুঝি সে সময়ে ঠিক তা না থাকলেও সে সম্পর্কে চিন্তার একটি পদ্ধতি হিসেবে।

মার্কিন প্রাবন্ধিক ও সমালোচক অ্যাডাম গোপনিক

বিগত কয়েকটি শতাব্দী ধরে জনতার ভিড় বা সমাবেশের ভূমিকা সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা ফরাসি বিপ্লবকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়, কিন্তু তারপরও এ-সংক্রান্ত ধ্রুপদি ও মধ্যযুগে প্রচলিত শব্দগুলোর জটাজালটা প্রাসঙ্গিকই রয়ে গেছে। জনতা কি নেহাতই ‘ভালগাস’—উন্মত্তের মতো প্রলাপ–বকা উচ্ছৃঙ্খল লোকজন? নাকি একটা ‘পপুলাস’—সার্বভৌম জনগণ যারা নিজেদের স্বার্থে কথা বলে যখন কর্তৃপক্ষ তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারে না? আসলে জনতার সমাবেশ বা জমায়েত বা ভিড়কে কে কীভাবে দেখছে সেটা নির্ভর করে তাদের রাজনৈতিক আনুগত্য বা অবস্থানের ওপর। জনতা সম্পর্কিত দর্শনের আলোচনার সিংহভাগ যে ফরাসি বিপ্লব অধিকার করে রাখে তার কারণ সেই সময়টাতেই কোনো উচ্ছৃঙ্খল জনতার সমাবেশ (বা সে রকম বলতে যেটাকে মনে হয়েছিল) মানবেতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো চূড়ান্ত বাঁক বদল ঘটিয়েছিল। অনেকের মতে, রোমক প্রজাতন্ত্র সব সময়ই ছিল অভিজাত শ্রেণির ব্যাপার, উচ্ছৃঙ্খল জনতার ভিড় সেখানে কোরাসের ভূমিকা পালন করেছিল মাত্র। এবং নিউ ইয়র্কার পত্রিকার নিয়মিত প্রদায়ক ও লেখক অ্যাডাম গোপনিক দাবি করেন যে এমনকি আমেরিকান বিপ্লবও ছিল অনেকটাই আইন প্রণয়ন–সংক্রান্ত (লেজিসলেটিভ) বিপ্লব এবং স্যামুয়েল অ্যাডামসের জীবন ও কাজ সম্পর্কে অবহিত যারা তাদের কাছে এটা নতুন কোনো খবর নয়।

উচ্চপদস্থ কিছু হোমরাচোমরা আর আপসহীন কর্তৃত্ববাদী নেতার একটি জোট ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত করলেও ফরাসি বিপ্লবে নাগরিকদের এমন কিছু বড় দল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, যারা নিজেদের মতো করেই কাজ করেছিল, নিজেরাই বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ৪ জুলাই একদল বণিক আর আবাদকারীর একটি দলিলে স্বাক্ষর করার ঘটনা মার্কিনরা উদ্‌যাপন করে; অন্যদিকে ফরাসিরা উদ্‌যাপন করে ১৪ জুলাই যে নাগরিকদের একটি জনতা বাস্তিল নামের রাজপ্রাসাদে জোর করে ঢুকে পড়েছিল সেই ঘটনাটি। দুটো ঘটনার মধ্যে তফাত আছে।

সূত্র: অ্যাডাম গোপনিক রচিত ‘গেট ইট টুগেদার’
লেখাটি দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য।