অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

হান কাঙের গল্প

আমার নারীর ফল

‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’, ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’, ‘দ্য হোয়াইট বুক’, ‘উই ডু নট পার্ট’-এর মতো জনপ্রিয় বইয়ের লেখক হান কাং ২০২৪ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। দক্ষিণ কোরীয় এই ঔপন্যাসিক ও গল্পকারের ‘আমার নারীর ফল’ গল্পটি ব্রিটিশ অনুবাদক ডেবোরা স্মিথ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। পরে সেটি ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত সাহিত্য ম্যাগাজিন ‘গ্র্যান্টা’র অনলাইনে প্রকাশিত হয়।

অনুবাদ: নকিব মুকশি

আমার স্ত্রীর শরীরের নীলচে দাগগুলো আমার নজরে আসে মে মাসের শেষ দিকে।

সেদিন ওই মুহূর্তে বাড়ির তত্ত্বাবধায়কের ঘরের পাশের ফুলবাগানে লাইলাক ফুলগুলো কাটা জিহ্বার মতো পাপড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছিল, আর প্রবীণ নাগরিক কেন্দ্রের প্রবেশপথের পাকা স্ল্যাবগুলো ভরে উঠেছিল পচে যাওয়া সাদা সাদা ফুলে। পথচারীদের জুতার নিচে পিষ্ট হয়ে সেগুলো আরও স্তূপ হয়ে উঠছিল।

সূর্য তখন প্রায় মধ্যগগনে।

পাকা পিচ ফলের ভেতরের লাল অংশের মতো রাঙা সূর্যালোক লিভিংরুমের মেঝেতে ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছিল, আর তার সঙ্গে সঙ্গে এক দঙ্গল ধুলোকণা আর পরাগ ঢুকে পড়ে মাতালের মতো উড়ছিল।

সেই একপলকা মিঠা, কুসুম গরম রোদ আমার সাদা গেঞ্জি পরা পিঠে ঢলে পড়ছিল, যখন আমি আর আমার স্ত্রী রোববার সকালের সংবাদপত্র উল্টে দেখছিলাম।

গত সপ্তাহটিও আমার কাছে বড্ড একঘেয়ে, ক্লান্তিকর ছিল। মাসের পর মাস ধরে আমার এমন অনুভূতিই হচ্ছে।

উইকেন্ডে ঘুম থেকে সাধারণত একটু দেরি করেই উঠি। কয়েক মিনিট আগেই ঘুম ভাঙল। পাশ ফিরে আমার অবসন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে একটু আরামদায়ক অবস্থানে নিলাম এবং যতটা সম্ভব ধীরে ধীরে সংবাদপত্রের পাতাগুলো ওলটাতে থাকলাম।

‘এটা একবার দেখবে? জানি না কেন ক্ষত দাগগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে না।’

স্ত্রীর কথাটায় গুরুত্ব না দিয়ে আমি শুধু নিস্তব্ধতার কাপড়ে একটা হালকা বুননের মতোই সেটাকে অনুভব করেছিলাম। তারপর অন্যমনস্কভাবে তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিলাম।

আমি হঠাৎ সোজা হয়ে বসলাম। পত্রিকার পড়া জায়গাটা আঙুল দিয়ে চিহ্নিত করে হাতের তালু দিয়ে চোখ ঘষলাম। স্ত্রী তার ঊর্ধ্বাঙ্গে পরা স্লিভলেস জামাটি ব্রা পর্যন্ত তুলেছিল—গভীর ক্ষতচিহ্নে তার পিঠ ও পেট ছোপ ছোপ হয়ে আছে।

‘এগুলো কীভাবে হলো?’

স্ত্রী কোমরটা এতটুকু ঘোরালো যে আমি তার প্লিটেড স্কার্টের জিপার থেকে শুরু করে ওপর দিকে সারি বেয়ে ওঠা মেরুদণ্ডের কশেরুকাগুলোও দেখতে পেলাম।

ফ্যাকাশে নীল রঙের ছোট ছোট ক্ষতচিহ্ন—নবজাতকের মুঠির সমান—এতটাই স্পষ্ট, যেন সেগুলো কালি দিয়ে ছাপা হয়েছে।

‘বলছ না কেন? কীভাবে হলো এগুলো?’

আমার তীক্ষ্ণ ও জোরালো কণ্ঠস্বর আমাদের আঠারো পিয়ং ফ্ল্যাটের ভেতরের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিল।

‘জানি না…নিজের অজান্তেই হয়তো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে। ভেবেছিলাম, ক্ষতগুলো সেরে যাবে। কিন্তু এখন দেখছি, এগুলো আরও বড় হচ্ছে।’

আমার স্ত্রী এমনভাবে আমার চোখ এড়িয়ে গেল, যেভাবে এড়িয়ে যেতে চায় ভুল কিছু করতে গিয়ে ধরা পড়া কোনো শিশু।

তাকে বকেছি বলে সামান্য অনুতপ্ত হয়ে আমি স্বরটা কোমল করার চেষ্টা করলাম।

‘ব্যথা করে না?’

‘না, একেবারেই না। আসলে ক্ষতচিহ্নের জায়গাগুলোতে কোনো অনুভূতিই নেই। কিন্তু জানো, এটা আরও চিন্তার।’

কয়েক মুহূর্ত আগে তার মুখে ধরাপড়া ভাবের যে ছাপ দেখেছিলাম, তা পুরোপুরি মিলিয়ে গেছে। তার বদলে এসেছে নরম, অথচ পরিস্থিতির সঙ্গে একদমই বেমানান একটা হাসি।

আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, ‘হাসপাতালে কি যাওয়া উচিত?’ তার ঠোঁটের কোণে তখনো সেই হাসিটা লেগে ছিল।

আমি অদ্ভুতভাবে পুরো পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্ত্রীর মুখের দিকে শীতল, নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালাম। যে মুখের সামনে দাঁড়ালাম, তা যেন পরিচিত নয়, প্রায় অবাস্তব। অথচ এটা ভাবাই যায় না, যেহেতু আমরা চার বছর ধরে একসঙ্গে সংসার করছি।

তার চোখের কোণ থেকে ছড়িয়ে পড়া সূক্ষ্ম রেখাগুলো গুনতে চেষ্টা করলাম। এরপর তাকে শরীরের সব পোশাক খুলে ফেলতে বললাম। তখন লজ্জায় তার গালে লালচে আভা ফুটে ওঠে, আর তার ওজন কমে যাওয়ায় গালের হাড়গুলো অস্বাভাবিকভাবে ভেসে ওঠে। সে আপত্তি জানাতে চেষ্টা করল। ‘কেউ যদি দেখে ফেলে?’

আমার স্ত্রী আমার থেকে তিন বছরের ছোট। বিয়ের সময় তার বয়স ছিল উনত্রিশ। বিয়ের আগে যখন আমরা বাইরে যেতাম, তার মুখ এতটাই অল্প বয়সী দেখাত যে মাঝে মাঝে বিব্রত লাগত। এখন তার চেহারায় অবসাদের ছাপ এতই স্পষ্ট যে তার সেই ডাগর চোখের কালিমাহীন সারল্যের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। এখন আর কেউ তাকে স্কুলছাত্রী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ভেবে ভুল করবে, এমন সম্ভাবনা নেই। বরং তার চেহারায় প্রকৃত বয়সের চেয়ে বেশি বয়স লেগে আছে। আর তার গাল দুটো—যেখানে একসময় পাকতে শুরু করা কাঁচা আপেলের গায়ে লালচে আভা ফুটে ওঠার মতো একধরনের লাবণ্য ছিল—তা এখন দাবানো মাটির মতো বসে গেছে। মিষ্টি আলুর লতার মতো একদা তার যে কোমর ছিল অসম্ভব নমনীয় আর মোলায়েম, যে তলপেটে ছিল আকর্ষণীয় এক বিভঙ্গ; এখন তা শুকিয়ে এক করুণ শীর্ণতায় এসে ঠেকেছে।

আমি মনে করতে চেষ্টা করছিলাম, শেষ কবে আমি আমার স্ত্রীকে নগ্ন অবস্থায় দেখেছি, যখন পর্যাপ্ত আলোয় তার শরীরের প্রতিটি নান্দনিক বাঁক দেখা গিয়েছিল। এ বছর তো নয়ই, আগের বছরও দেখেছি কি না, নিশ্চিত নই।

একমাত্র যে মানুষটার সঙ্গে আমি বাস করছি, তারই শরীরের এত গভীর ক্ষত দাগগুলো কীভাবে আমার চোখ এড়িয়ে গেল!

আমি তার চোখের কোণ থেকে ছড়িয়ে পড়া সূক্ষ্ম রেখাগুলো গুনতে চেষ্টা করলাম। এরপর তাকে শরীরের সব পোশাক খুলে ফেলতে বললাম। তখন লজ্জায় তার গালে লালচে আভা ফুটে ওঠে, আর তার ওজন কমে যাওয়ায় গালের হাড়গুলো অস্বাভাবিকভাবে ভেসে ওঠে। সে আপত্তি জানাতে চেষ্টা করল।

‘কেউ যদি দেখে ফেলে?’

অধিকাংশ ফ্ল্যাটের মুখ সাধারণত কোনো বাগান বা কার পার্কিংয়ের দিকে হয়। কিন্তু আমাদের ফ্ল্যাট তেমন নয়, এর ব্যালকনি পূর্ব দিকের প্রধান সড়কমুখী। আমরা নিকটতম অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক থেকে তিন রাস্তা দূরে, মাঝখানে প্রধান সড়ক আর ছোট্ট চুংনাং নদী বহমান। তাই শক্তিশালী দুরবিন ছাড়া কারও পক্ষে উঁকি দিয়ে দেখা সম্ভব নয়। রাস্তা দিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে যাওয়া গাড়িগুলোর ভেতর থেকে আমাদের বসার ঘর কারও পক্ষে একঝলকও দেখতে পাওয়ার কথা নয়। তাই আমি স্ত্রীর আপত্তিকে কেবল লজ্জার প্রকাশ হিসেবে নিলাম।

বিয়ের সেই শুরুর দিনগুলোতে, সাপ্তাহিক ছুটির দিনের অলস দুপুরে আমরা ঠিক এই বসার ঘরটাতেই কাটাতাম। আগস্টের সেই দমবন্ধ করা ভ্যাপসা গরম থেকে একটু নিষ্কৃতি পেতে বারান্দার কাচের দরজা আর দূরের জানালাগুলো হাট করে খুলে দিতাম। আর ভরদুপুরে আমরা বারবার রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হতাম। যেহেতু আমরা কামচর্চায় নতুন, আনাড়ি ও অপটু ছিলাম, ফলে ক্রমাগত পরীক্ষা করতে গিয়ে প্রতিবার পুলক ছড়ানো, তৃপ্তিকর নতুন নতুন কামশৈলী আবিষ্কার করছিলাম। এই অপটু প্রয়াস চলত, যতক্ষণ না আমরা ক্লান্তির ভারে নুয়ে পড়তাম।

এক বছর পার হওয়ার পর আমাদের মধ্যকার সেই স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা, উদ্দাম যৌনতা—সবই যেন হারিয়ে গেল। সেই শুরুর দিনের তীব্র আবেগ, উন্মাদনা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে গেল। আমার স্ত্রী বেশ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ত এবং সে অস্বাভাবিক গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকত। আমি রাত করে বাড়ি ফিরলে ধরেই নিতাম, সে ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে।

যখন দরজার তালায় চাবি ঘুরিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকতাম, আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর মতো কেউ জেগে থাকত না। হাত-মুখ ধুয়ে যখন অন্ধকার ঘরটায় ঢুকতাম, তার শ্বাসপ্রশ্বাসের কোমল ছন্দও আমার কাছে কেমন অবর্ণনীয় শূন্যতা-নিঃসঙ্গতা নিয়ে আসত।

এই লোনলিনেস কমানোর আশায় আমি তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরতাম। ঘুমে আচ্ছন্ন, আধখোলা তার চোখ দুটি দেখে বুঝতেই পারতাম না—সে কি আমার আলিঙ্গন প্রত্যাখ্যান করছে, নাকি উষ্ণভাবে ফিরিয়ে দিচ্ছে। শুধু আলতো করে আমার চুলে তার আঙুলগুলো বিলি কেটে যেত যতক্ষণ না আমার শরীরের সব নড়াচড়া থেমে যেত।

‘সবকিছু? তুমি চাইছ, আমি সব খুলে ফেলি?’

চোখের জল চেপে রাখার মতো মুখভঙ্গি করে স্ত্রী সদ্য খোলা অন্তর্বাসটিকে বলের মতো গুটিয়ে নিয়ে তার গোপনাঙ্গ ঢেকে দিল। বসন্তের রোদ এসে পড়েছে তার সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, নগ্ন শরীরে। সত্যিই অনেক দিন ধরে এমন দৃশ্য দেখতে পাই না।

তবু আমার ভেতরে যৌনাকাঙ্ক্ষার সামান্য সঞ্চারও হলো না। হলুদাভ-সবুজ ক্ষত দাগগুলো শুধু তার নিতম্বেই নয়, বরং পাঁজর ও পায়ের পাতায়, এমনকি ঊরুর ভেতরের সাদা মাংসেও ছড়িয়ে পড়েছিল। তীব্র রাগ আমাকে গ্রাস করল, তারপর হঠাৎই উবে গেল, আর রেখে গেল অকারণ বিষণ্নতা।

সে এমন অন্যমনস্ক নারী যে তার মন সর্বদাই বিক্ষিপ্ত থাকে, চারপাশে বিচরণ করে। হয়তো কোনো এক সন্ধ্যায় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ধীরগতির কোনো গাড়ির সঙ্গে থাক্কা খেয়ে, অথবা পা হড়কে আমাদের ভবনের অন্ধকার সিঁড়িতে পড়ে তার এ অবস্থা হয়েছে। অধিক ঘুমের কারণে ইতিমধ্যে তার অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। ফলে এ স্মৃতি হয়তো তার ঘুমের ভেতর মিলিয়ে গেছে, এখন আর মনে নেই।

আমার স্ত্রী তার গোপনাঙ্গ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। শেষ বসন্তের রোদ তার পিঠে ঝরনার মতো ঝরে পড়ছে।

অন্যমনস্কভাবে জিজ্ঞেস করছে, ‘হাসপাতালে কি যাওয়া উচিত?’

এ দৃশ্য এতটাই করুণ, অসহায়, বেদনাদায়ক যে অচেনা এক বিমর্ষতা আমাকে ছুঁয়ে গেল, যা বহুদিন হয় অনুভব করিনি। আমি কেবল তার বিশীর্ণ শরীরটিকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।

২.

আমি ধরে নিয়েছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে। সে কারণেই বসন্তের দিনে স্ত্রীর হাড়জিরজিরে শরীরটিকে আমার বাহুডোরে টেনে নিয়ে বলেছিলাম, ‘যেহেতু ব্যথা করছে না, ক্ষতচিহ্নগুলো শিগগিরই মিলিয়ে যাবে। তুমি তো এর আগে কখনো এমন সমস্যায় আক্রান্ত হওনি, তাই না?’ কথার তীব্রতা কমাতে আমি একটু জোরেই হাসলাম।

গ্রীষ্মের শুরুতে এক রাতে তাপসিক্ত বাতাস উঁচু সিকামোর গাছের পাতায় তার আঠালো গাল ঘষছিল, আর রাস্তাগুলো রক্তাভ চোখে আলো-অন্ধকারে টলছিল। রাতের খাবার ভাগ করে খেতে খেতে আমার স্ত্রী হঠাৎ চামচ টেবিলে ঠক করে রাখল। আমি তার ক্ষতচিহ্নের কথা পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলাম।

‘আশ্চর্য…আরেকবার দেখো তো।’

আমার স্ত্রী তার ছোট হাতা থেকে বেরিয়ে থাকা কৃশকায় হাত দুটি ভালো করে পরীক্ষা করল, এরপর দ্রুত তার টি-শার্ট আর ব্রা খুলে ফেলল। আমার মুখ থেকে একটুখানি গোঙানি বেরিয়েই গেল, যা আমি গিলে ফেলতে পারিনি।

গত বসন্তে নবজাতকের মুষ্টির সমান যে ক্ষতচিহ্নগুলো ছিল, এখন সেগুলো বড় কচুপাতার মতো হয়ে গেছে। ক্ষতগুলোর রং আরও গাঢ় হয়েছে, যেন কাঁদতে থাকা উইলো গাছের শাখার মতো, যাতে গ্রীষ্মের শুরুতে ফ্যাকাশে সবুজ আর হালকা নীলের আভা মিশে থাকে।

আমার কাঁপতে থাকা হাতটা স্ত্রীর ক্ষতচিহ্নে ভরা কাঁধে রাখলাম। মনে হলো আমি যেন অপরিচিত কারও শরীর স্পর্শ করেছি। এমন বড় ক্ষতে কতটা যন্ত্রণা হতে পারে!

এখন ভাবলে মনে পড়ে, সেদিন স্ত্রীর মুখে নীলাভ আভা ছিল, যেন সিসা মেশানো পানিতে ডুবিয়েছে তার মুখটা কেউ। একসময় চকচকে ছিল তার চুল, এখন শুকনা মুলাপাতার মতো ভঙ্গুর। তার চোখের সাদা অংশে ফ্যাকাশে নীলের ছাপ, যেন অস্বাভাবিক কালো মণির কালি ছড়িয়ে পড়েছে তাতে। তার চোখে জল চিকচিক করছিল।

‘দিনে বারবার বমি করার অনুভূতি বুঝতে পারো? যেন মাটিতে দাঁড়িয়ে থেকেও মোশন সিকনেস হচ্ছে। হাঁটতে গেলে কুঁজো হয়ে যেতে হয়। মাথাব্যথা করে…যেন ডান চোখটা মাথায় গেঁথে যাচ্ছে। কাঁধ কাঠের মতো শক্ত হয়ে যায়, বমি হয়, লালা, পাকস্থলীর হলুদ অ্যাসিড জমা হয় ফুটপাতের ওপর, রাস্তার গাছের গোড়ায়…’

‘আমার সঙ্গে কেন এমনটা হচ্ছে? আমি যতটা দ্রুত সম্ভব বাইরে যেতে চাই, সূর্যের আলো দেখলেই সমস্ত পোশাক খুলে ফেলতে ইচ্ছা করে। শরীর যেন নিজেই তা চাইছে।’ আমার স্ত্রী উঠে দাঁড়াতেই পুরো বছরে এই প্রথম তার শীর্ণ, নগ্ন শরীরকে এত স্পষ্টভাবে দেখলাম।

‘পরশু দিন আমি কিছু না পরে বারান্দায় গিয়ে ওয়াশার-ড্রায়ারের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। কেউ দেখছে কি না জানি না…লুকানোরও চেষ্টা করিনি…যেন আমি কোনো পাগল মহিলা!’

আমি কিছুই করিনি, শুধু তার জীর্ণ শরীরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, নার্ভাস হয়ে হাতে ধরা চপস্টিকের কিনারায় আঙুল চালাচ্ছিলাম।

‘আমার ক্ষুধামান্দ্য হয়েছে। পানি বেশি খাচ্ছি…কিন্তু দিনে আধবাটি ভাতও খেতে পারছি না। খাওয়া না হওয়ার কারণে হয়তো পাকস্থলীর অ্যাসিড ঠিকমতো নিঃসৃত হচ্ছে না। জোর করে খেলেও হজম হয় না, বমি হয়ে যায়।’

সে সুতা ছেঁড়া পুতুলের মতো হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে আমার ঊরুতে মুখ গুঁজে দিল। সে কি কাঁদছিল? আমার ট্র্যাকস্যুটের কাপড়ে উষ্ণ, ভেজা এক দাগ ফুলে উঠল নিঃশব্দে।

‘দিনে বারবার বমি করার অনুভূতি বুঝতে পারো? যেন মাটিতে দাঁড়িয়ে থেকেও মোশন সিকনেস হচ্ছে। হাঁটতে গেলে কুঁজো হয়ে যেতে হয়, সোজা হওয়া যায় না। মাথাব্যথা করে…যেন ডান চোখটা মাথায় গেঁথে যাচ্ছে। কাঁধ কাঠের মতো শক্ত হয়ে যায়, বমি হয়, লালা, পাকস্থলীর হলুদ অ্যাসিড জমা হয় ফুটপাতের ওপর, রাস্তার গাছের গোড়ায়…’

নষ্ট হয়ে আসা ফ্লুরোসেন্ট বাতি থেকে পোকামাকড়ের তীক্ষ্ণ গুঞ্জন ভেসে আসছিল। এ বাতির তীব্র আলোর নিচে আমার স্ত্রী তার পিঠে ক্যাটালপা গাছের পাতার মতো এক বড় ক্ষত নিয়ে নিজের ভেতর থেকে ঝরঝর করে বের হতে থাকা কাঁদো কাঁদো গোঙানিটাকে কোনোমতে থামাতে পারল।

‘হাসপাতালে যাও,’ আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম। ‘আগামীকাল সরাসরি ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগে যাও।’

তার ভেজা, দাগে ভরা মুখটা বিবর্ণ লাগছিল। আমার ছড়ানো আঙুল দিয়ে তার ভঙ্গুর চুলে বিলি কাটতে কাটতে একপাটি দাঁত বের করে হাসলাম, ‘সাবধানে যেয়ো। আবার কোথাও আঘাত পেয়ো না। দুম করে পড়ে কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার মতো শিশু তো তুমি নও।’

আমার স্ত্রীর অশ্রুসিক্ত মুখটি কেঁপে উঠে হাসিতে রূপ নিল, আর গড়িয়ে এসে ঠোঁটে ঝুলে থাকা একফোঁটা অশ্রু দীর্ঘ হয়ে ঝরে পড়ল।

৩.

আমার স্ত্রী কি সব সময় এত সহজে কেঁদে ফেলত? না, তা নয়। যখন তার বয়স ছাব্বিশ, সেই প্রথমবার তাকে কাঁদতে দেখেছিলাম।

তরুণবেলায় সে সহজেই হাসত, তার কণ্ঠে থাকত প্রফুল্ল স্বর, হাসিতে যেন বইত রঙের ধারা। সেই কণ্ঠস্বর ছিল শান্ত ও পরিণত, যা তার তারুণ্যদীপ্ত চেহারার সঙ্গে মেলানো যেত না।

এই প্রথমবারের মতো তার কণ্ঠস্বর শুনে কেঁপে উঠলাম, যখন সে আমাকে বলল, ‘সাংগিয়ে-ডংয়ের ওই উঁচু অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে থাকতে আমার ঘৃণা হয়।’

‘সাত লাখ মানুষ গাদাগাদি করে থাকে। মনে হয়, শুষ্ক-ম্লান হয়ে মরব। আমি ঘৃণা করি একই নির্মাণশৈলীর এই শত শত বিল্ডিং, যেগুলোর রান্নাঘর, ছাদ, টয়লেট, বাথটাব, বারান্দা, লিফটও একই রকম একঘেয়ে। আমি ভীষণ অপছন্দ করি এদের পার্ক, বিশ্রামস্থল, দোকান, জেব্রাক্রসিং—সবকিছু।’

‘এমন কী হলো হঠাৎ?’ আমি খিটখিটে শিশুকে শান্ত করার মতো করে তাকে কথাটা বললাম। কথার চেয়ে কণ্ঠের কোমলতায় বেশি জোর দিলাম, ‘অনেক মানুষ একসঙ্গে বসবাস করলে ক্ষতি কী?’ আমি কিছুটা কঠোর মুখভঙ্গি নিয়ে তার প্রাণবন্ত, ঝলমলে চোখের দিকে তাকালাম।

‘আমি সব সময় চাইতাম, আমার ভাড়া বাড়ি যেন বিনোদন এলাকার কাছে হয়। আমি শুধু সেই সব জায়গায় থাকতাম, যেখানটা মানুষে গমগম করত, রাস্তায় সংগীতের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়ত, যানজট লেগে থাকত আর ক্রমাগত বাজত গাড়ির কান ফাটানো হর্ন। তা না হলে আমি টিকতে পারতাম না। একা থাকার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারতাম না।’

আমার স্ত্রী তার হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তার দুই গাল বেয়ে পড়া চোখের জলের একটা ধারা মোছার সঙ্গে সঙ্গে আরও নতুন অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছিল—অবিরামভাবে।

‘এখন মনে হচ্ছে, আমি কোনো দীর্ঘস্থায়ী অসুখে পড়ব আর মারা যাব। মনে হচ্ছে, আমি এই ত্রয়োদশ তলা থেকে নামতে পারব না, বাইরেও যেতে পারব না।’

‘এত নাটক করছ কেন? সত্যি, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে!’

‘আমি বাইরে যেতে চাই এবং চাই, আমার শিরায় শিরায় নতুন রক্ত আসুক,’ সে বলেছিল। সেদিন সন্ধ্যায়ই সে তার ঊর্ধ্বতনকে পদত্যাগপত্র দিয়েছিল। বলেছিল, তার শিরায় জমাট বাঁধা খারাপ রক্তকে সিস্টের মতো বের করে দিতে চায় ও, আর ক্লান্ত জরাজীর্ণ ফুসফুসে নতুন বাতাস ঢোকাতে চায়।

এই হাইরাইজ ফ্ল্যাটে ওঠার পর প্রথম বছরটায় আমার স্ত্রী প্রায়ই অসুস্থ থাকত। সে সিউলের পাহাড়ি এলাকায় প্রাকৃতিক পরিবেশে ভাড়া বাড়িতে থেকে অভ্যস্ত ছিল, আর তার শরীর যেন সেন্ট্রাল-হিটেড ও সিল করা ফ্ল্যাটে মানিয়ে নিতে পারছিল না। তার শক্তি দ্রুত কমে গিয়েছিল। সামান্য পারিশ্রমিকে ছোট একটা প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করত। দিনে একবার পাহাড়ি খাড়া ঢাল বেয়ে এই সংস্থায় পৌঁছালেও এর বেশি আর পেরে উঠত না।

কিন্তু সে চাকরিটা আমাদের বিয়ের কারণে ছাড়েনি, বরং চাকরি ছাড়ার কিছুদিন পরেই আমি তাকে বিয়ের কথা স্পষ্টভাবে বলি। সে তার মাসিক বেতন থেকে সঞ্চয়, পেনশন ভাতা, সাপ্তাহিক ছুটিতে পার্টটাইম কাজের অতিরিক্ত আয়—সব টাকা তুলে নিয়েছিল, আর দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করেছিল।

‘আমি বাইরে যেতে চাই এবং চাই, আমার শিরায় শিরায় নতুন রক্ত আসুক,’ সে বলেছিল। সেদিন সন্ধ্যায়ই সে তার ঊর্ধ্বতনকে পদত্যাগপত্র দিয়েছিল। বলেছিল, তার শিরায় জমাট বাঁধা খারাপ রক্তকে সিস্টের মতো বের করে দিতে চায় ও, আর ক্লান্ত জরাজীর্ণ ফুসফুসে নতুন বাতাস ঢোকাতে চায়। সে বলেছিল, ছোটবেলা থেকেই স্বাধীনভাবে বাঁচা-মরার স্বপ্ন ছিল তার। সঠিক সময় আসেনি বলে এত দিন তা পিছিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এখন সেই স্বপ্নকে বাস্তব করার সময় হয়েছে, ইতিমধ্যে যথেষ্ট সঞ্চয়ও করেছে সে।

সে ঠিক করেছিল, কোনো একটি দেশ বেছে নেবে, যেখানে ছয় মাসের মতো থাকবে, তারপর অন্য কোথাও যাবে, এভাবে চলতে থাকবে তার জগৎ-ভ্রমণ।

‘আমি মরার আগে এই স্বপ্ন পূরণ করতে চাই,’ সে বলেছিল, আর নিচু স্বরে হেসেছিল। ‘আমি পৃথিবীর একেবারে প্রান্ত পর্যন্ত দেখতে চাই। ধাপে ধাপে যত দূরে সম্ভব যেতে চাই।’

কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৃথিবীযাত্রা শুরু করার বদলে আমার স্ত্রী তার সামান্য সঞ্চয় ঢেলে দিল এই ফ্ল্যাটের ডিপোজিট আর আমাদের বিয়ের খরচে। সে আমাকে ছোট্ট একটা বাক্যে সব ব্যাখ্যা করেছিল, ‘আমি এটা করেছি, কারণ তুমি-আমি আলাদা কেউ না।’

তার এই স্বপ্নটা, স্বাধীনতার স্বপ্নটা কতটা বাস্তব ছিল? সে যেহেতু এত সহজে সেই পরিকল্পনা বা স্বপ্নটা ছেড়ে দিতে পারল, আমি ধরে নিয়েছিলাম—ওটা তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। সবটাই বোধ হয় ছিল অবাস্তব, রোমান্টিক এক ভ্রম বা কল্পনা। আর তার পরিকল্পনাগুলো ছিল কোনো শিশুর চন্দ্রভ্রমণের মতোই কল্পবিলাসী। শেষ পর্যন্ত সে নিজেই হয়তো তা বুঝতে পেরেছিল। আর আমি হালকা আবেগাপ্লুত হয়েছিলাম, গর্বও হয়েছিল—ভাবছিলাম, হয়তো আমিই তাকে দেরিতে হলেও এই বোধোদয়ে পৌঁছে দিয়েছি।

সম্ভবত তার ঘন ঘন অসুস্থতার কারণেই এমনটা হয়েছিল। কিন্তু যখন দেখলাম সে ব্যালকনির কাচের দরজায় গাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার সরু কাঁধ শুকনো বাঁধাকপির পাতার মতো ঝুলে পড়েছে, আর নিচে দ্রুতগামী গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে, আমার মন তখন বিষাদে ডুবে গেল। সে এতটাই নিশ্চল হয়ে ছিল যে তার অবিশ্বাস্য রকম মৃদু শ্বাসের শব্দই কেবল নিশ্চিত করছিল—সে এখনো বেঁচে আছে। একজোড়া অদৃশ্য হাত যেন তার কাঁধ চেপে ধরে রেখেছিল, যেন অদৃশ্য লৌহবেড়ি তাকে একটুও নড়তে দিচ্ছিল না।

গভীর রাতে এবং ভোর হওয়ার আগেই আমার স্ত্রীর হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেত ফাঁকা রাস্তা দিয়ে গর্জন করতে করতে কোনো ট্যাক্সি বা মোটরবাইকের চলে যাওয়ার আওয়াজে। ‘যেন গাড়িগুলো নয়, খোদ রাস্তাটাই দ্রুত ছুটে চলেছে, আর সেই সঙ্গে এই ফ্ল্যাটও যেন ভেসে যাচ্ছে,’ সে বলেছিল। এমনকি ইঞ্জিনের আওয়াজ যখন দূরে মিলিয়ে যেত, আর ঘুম তাকে গ্রাস করত, আমার স্ত্রীর সুন্দর মুখটি তখন মৃতের মতো ফ্যাকাশে হয়ে যেত।

তেমনই এক রাতে আমার সহধর্মিণী স্বপ্নের ঘোরে বিড়বিড় করে কথা বলছিল (তার ভগ্নকণ্ঠস্বর প্রায় শোনাই যাচ্ছিল না), ‘সেই সব জিনিস কোথা থেকে এসেছিল...আর এখন কোথায় ছুটে পালাচ্ছে?’

৪.

পরদিন সন্ধ্যায় যখন আমি সামনের দরজা খুলে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকলাম, আমার স্ত্রী হয়তো করিডরে আমার পায়ের শব্দ শুনেই আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল। সে খালি পায়ে এসেছিল। তার পায়ের নখ, যা সে নিয়মিত কাটছিল না, সাদা আভায় ঝলমল করছিল।

‘হাসপাতাল থেকে কী বলল?’

কোনো উত্তর নেই। আমি জুতো খুলতে খুলতে স্ত্রীর দিকে তাকালাম, সে চুপচাপ আমাকে দেখল, তারপর মুখ ফিরিয়ে নিল। আর গালের ওপর ঝুলে থাকা এক গোছা নিষ্প্রভ চুল কানের পেছনে গুঁজে দিল।

আমার কল্পনায় ভেসে উঠল সেদিনের তার সেই মুখশ্রী, যখন তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়। আমার অফিসের সিনিয়র সহকর্মী—যিনি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছিলেন—আমাদের একা রেখে চলে যেতেই কী এক মিহি নীরবতা নেমে এসেছিল তার মুখে। সেই নীরবতামিশ্রিত রহস্যময় অভিব্যক্তি আমাকে অস্থির করে তুলেছিল। মনে হয়েছিল, তার মন যেন দূরে কোথাও, কোনো এক অজানা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

যেই মুখ প্রথম দর্শনেই উজ্জ্বল ও লাবণ্যময় মনে হয়েছিল, সেই মুখই হঠাৎ এক অপ্রত্যাশিত নিঃসঙ্গতায় ঢেকে গেল—এ যেন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন মানুষ! আর সেই মুহূর্তেই মনে হয়েছিল, সে আমাকে বুঝতে পেরেছে। এই বিশ্বাস আর মদের নেশার ঘোরে

আমি হঠাৎ তাকে বলে ফেলি, আমি সারাটা জীবন নিঃসঙ্গ ছিলাম। তখন সেই ছাব্বিশ বছরের তরুণী, যে পরবর্তী সময়ে আমার স্ত্রী হতে চলেছে, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল দূর দিগন্তের দিকে, আর আমাকে ফেলে গিয়েছিল এক হিমশূন্যতায়, যার মুখোমুখি আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি।

‘তুমি হাসপাতালে গিয়েছিলে তো?’

আমার স্ত্রী কেবল সামান্য মাথা নেড়ে হ্যাঁ-সূচক ইঙ্গিত দিল।

সে কি অসুস্থ চেহারা লুকোনোর জন্য মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, নাকি আমি কোনো ভুল কিছু করেছিলাম বলে?

‘আরে, দয়া করে কথা বলো তো, ডাক্তার কী বলল?’

‘সব ঠিক আছে,’ সে বলল—কথার চেয়ে তার নিশ্বাসই যেন স্পষ্টভাবে বেরিয়ে এল। তার কণ্ঠস্বর ছিল ভীষণ ভাবলেশহীন।

সেই প্রথম পরিচয়ের সময় তার কণ্ঠস্বরই আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল। তুলনাটা হয়তো অদ্ভুত, তবু বলি—তার কণ্ঠস্বর আমাকে মনে করাত চমৎকারভাবে পলিশ করা মসৃণ মার্জিত কোনো এক টি-টেবিলের কথা, যা কেউ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অতিথি ছাড়া আর কারও জন্য বের করতে চায় না এবং যেখানে কেবল চমৎকার কাপে সেরা চা পরিবেশন করাই উচিত।

সেই রাতে আমি হালকা মাতাল অবস্থায় মুখ ফসকে যা বলেছিলাম, তা তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করেনি বোধ হয়। বরং সে একেবারে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে, তার চিরচেনা স্থির কণ্ঠেই জবাব দিয়েছিল, ‘আমি আসলে কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় থিতু না হয়েই কাটাতে চাই।’

এরপর তার সঙ্গে গাছপালা নিয়ে কথা হয়। তাকে বললাম, ‘একসময় স্বপ্ন দেখতাম—আমার বারান্দাজুড়ে বড় বড় টব। প্রতিটি টবেই সবুজ লেটুস আর পেরিলা গাছ। গ্রীষ্মকালে পেরিলাগাছে তুষারবিন্দুর মতো ছোট ছোট সাদা ফুল ফুটবে। আর রান্নাঘরের পাশে আমি শিমও ফলাব।’

স্ত্রী তখন আমাকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিল, যেন এসব কথা আমার স্বভাবের সঙ্গে যায় না। অবশেষে তার ঠোঁট বেয়ে একটা ক্ষীণ চাপা হাসি ফুটে ওঠে। সেই নিরীহ ভঙ্গুর হাসির রেশ ধরে আমি আবার বললাম, ‘আমার সারাটা জীবন কেটে গেছে নিঃসঙ্গতায়।’

এখন বারান্দার আয়তাকার টবগুলোতে শুকনো মাটি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমি ভাবতাম, মৃত গাছগুলো কোথায় গেল? আর সেই বৃষ্টির দিনগুলোতে, যখন আমি টবগুলো জানালার ধারে রেখেছিলাম ঠান্ডা বৃষ্টিধারায় তাদের হাত ভেজানোর জন্য—সেই তরুণ দিনগুলোই-বা কোথায় হারিয়ে গেল?

বিয়ের পর আমি সত্যিই ব্যালকনিতে টব রেখেছিলাম। কিন্তু আমরা কেউই সবুজ আঙুলের মানুষ ছিলাম না। আমি ভেবেছিলাম, সবুজ শাকসবজিগুলো শুধু নিয়মিত পানি পেলেই দিব্যি বেঁচে থাকবে। কিন্তু যে কারণেই হোক, সেই শক্তপোক্ত গাছগুলোও শেষ পর্যন্ত শুকিয়ে মরে গেল; আমাদের একটিও ফলন দিল না। কেউ বলেছিল, গাছগুলো শুকিয়ে যাওয়ার কারণ আমাদের ফ্ল্যাটটি মাটির শক্তি থেকে অনেক দূরে। কেউ বলেছিল, বাতাস আর পানির মান খারাপ বলেই আমাদের গাছগুলো মরছে। আবার কেউ কেউ এটাও বলল, জীবিত জিনিসের যত্ন নেওয়ার জন্য যে আন্তরিক বিশ্বাস দরকার, তা আমাদের নেই। কিন্তু সেটা মোটেই সত্যি ছিল না। গাছগুলোর দেখভালে আমার স্ত্রী যে পুরো মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিল, তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ছিল। কোনো একটা লেটুস বা পেরিলাগাছ যদি শুকিয়ে যেতে, তাতেই সে আধা দিন বিষণ্নতায় ডুবে থাকত। আর কোনো গাছ যদি সামান্যও বেঁচে থাকার ইঙ্গিত দিত, সে খুশি হয়ে গুনগুন করে গান গাইত।

কিন্তু যে কারণেই হোক, এখন বারান্দার আয়তাকার টবগুলোতে শুকনো মাটি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমি ভাবতাম, মৃত গাছগুলো কোথায় গেল? আর সেই বৃষ্টির দিনগুলোতে, যখন আমি টবগুলো জানালার ধারে রেখেছিলাম ঠান্ডা বৃষ্টিধারায় তাদের হাত ভেজানোর জন্য—সেই তরুণ দিনগুলোই-বা কোথায় হারিয়ে গেল?

আমার সহধর্মিণী হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বলেছিল, ‘চলো, আমরা দুজন মিলে অনেক দূরে কোথাও চলে যাই।’ গাছগুলো অন্তত বৃষ্টিতে সামান্য প্রাণ ফিরে পেত, কিন্তু স্ত্রী যেন আরও গভীর বিষণ্নতায় শুকিয়ে যাচ্ছিল।

‘এই দমবন্ধ করা জায়গায় থাকা অসম্ভব,’ লেটুসপাতার ওপর হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ধরে বারান্দায় ছিটিয়ে দিতে দিতে সে বলেছিল।

‘এই বৃষ্টি নোংরা, শ্লেষ্মা আর থুতুতে কালো’—এই বলে তার চোখ আমার সম্মতি চাইছিল।

‘এটা জীবন নয়,’ সে থুতু ছিটিয়ে বলেছিল, ‘শুধু জীবনের মতো দেখায়।’ তার কণ্ঠ ছিল তীক্ষ্ণ, যেন মাতাল চিৎকার করছে—‘এই দেশটা পুরো পচে গেছে! এখানে কিছুই জন্মাতে পারে না, বুঝছ না? এই দমবন্ধ, বধির করা জায়গায় আটকে থেকে কিছুই জন্মাবে না!’

আমি আর এসব কথা সহ্য করতে পারছিলাম না।

‘কিসের দমবন্ধ…?’

আমি সহ্য করতে পারছিলাম না এই ধারালো কথাগুলো, যা আমার নতুন পাওয়া সুখ ভেঙে দিচ্ছিল, আর তার ক্ষীণ শরীর থেকে দীর্ঘদিনের চাপা কষ্টের রক্ত টেনে আনছিল।

আমার হাতের তালুতে জমা বৃষ্টির পানি তার কাঁধে ছিটিয়ে দিতে দিতে বললাম, ‘বলো তো, দমবন্ধ, বধির করা—এসব কথা দিয়ে কী বোঝাচ্ছ?’

আমার স্ত্রীর মুখ থেকে নিচু স্বরের কেবল একটা গোঙানি বেরিয়েছিল, আর তার সচকিত হাত একঝটকায় তার মুখের দিকে চলে গেল। বৃষ্টির ঠান্ডা পানি ব্যালকনির জানালার শার্সিতে ছিটকে পড়ল, আমার মুখেও। জানালার ধারে রাখা ফুলের টব তার পায়ে লেগে মেঝেতে ভেঙে পড়ল। ভাঙা টুকরো আর মাটির দলা তার পোশাকে, খালি পায়ে লেগে গেল। সে ঝুঁকে আহত পা দুই হাতে চেপে ধরল আর নিচের ঠোঁট কামড়াতে ছিল।

ঠোঁট কামড়ানো তার পুরোনো অভ্যাস। বিয়ের আগেও আমি রেগে গেলে বা গলা উঁচু করলে সে ঠোঁট কামড়াত। এতে তার চিন্তা গুছিয়ে নিতে সুবিধা হতো, আর কিছুক্ষণ পর শান্তভাবে যুক্তি সাজিয়ে উত্তর দিত। কিন্তু খেয়াল করলাম, ব্যালকনির সেই ঘটনার পর তার ঠোঁট কামড়ানোই একমাত্র প্রতিক্রিয়া ছিল। সেই দিন থেকে আমাদের মধ্যে আর কোনো কথা-কাটাকাটিও হয়নি।

‘ডাক্তার বলেছেন, কিছু হয়নি?’

আমার ভেতর এক তীব্র ক্লান্তি আর নিঃসঙ্গতার ঢেউ এসে ধাক্কা দিল। আমি আমার জ্যাকেট খুললাম, কিন্তু স্ত্রী সেটা হাত বাড়িয়ে পর্যন্ত নিল না।

‘উনি বলেছেন, কোনো সমস্যাই খুঁজে পাওয়া যায়নি,’ মুখটা তখনো অন্যদিকে ফিরিয়ে রেখেই সে কথাটার সায় দিল।

৫.

আমার স্ত্রী ধীরে ধীরে তার অবশিষ্ট বাক্‌শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছিল। তাকে কিছু না বললে সে কিছু বলত না, আর বললেও শুধু মাথা নেড়ে বা মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিত। আমি যদি গলা চওড়া করে উত্তর চাইতাম, সে দূরের কোনো এক দিকে তাকিয়ে থাকত, চোখে থাকত অস্পষ্ট দ্ব্যর্থকতা। তার ক্রমশ খারাপ হতে থাকা চেহারার রং এখন ফ্লুরোসেন্ট বাতির আবছা আলোতেও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।

ডাক্তার যেহেতু বলেছিল তার কোনো শারীরিক সমস্যা নেই, তাই মনে হলো হয়তো তার পাকস্থলী বা অন্ত্রের অসুখ নয়, বরং নিছক কোনো অন্তর্গত আকুলতা। কিন্তু সে কিসের জন্য এত আকুল?

গত তিনটা বছর ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে উষ্ণ ও শান্তিপূর্ণ সময়। আমার কাজ খুব একটা চাপের ছিল না। বাড়িওয়ালা ফ্ল্যাটের জন্য ডিপোজিট বাড়ানোর চেষ্টা করেনি, নতুন ফ্ল্যাটের ঋণ প্রায় শোধ হয়ে গিয়েছিল, আর আমার স্ত্রী-ই ছিল আমার কাঙ্ক্ষিত সঙ্গী, যদিও সে অতুলনীয় সুন্দরী ছিল না। আমার তৃপ্তিবোধ ছিল ভরা বাথটাবের সেই উষ্ণ জলের মতো, যা আলতো ঢেউ তুলে চারপাশের দেয়ালে আছড়ে পড়ত, আর আমার ক্লান্ত শরীরে আদর বুলিয়ে দিত।

সাহিত্যে নোবেলজয়ী দক্ষিণ কোরীয় কথাসাহিত্যিক হান কাং (২৭ নভেম্বর ১৯৭০)

তাহলে আমার স্ত্রীর সমস্যাটা কী? সে যদি সত্যিই কোনো কিছুর জন্য আকুল হয়ে থাকে, সেই আকুলতা যে এত ভয়াবহ হয়ে মানসিক রোগে পরিণত হতে পারে, সেটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। আর প্রতিবার যখন ভাবতাম, আমাকে এমন নিঃসঙ্গ করে তোলার অধিকার তার আদৌ আছে কি না, তখন আমার সমগ্র সত্তা যেন সীমাহীন এক বিতৃষ্ণায় ভরে যেত, যা আমাকে পুরোনো ধুলোর স্তরের মতো সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিত।

এর পরের রোববার সকালে, বিদেশে সপ্তাহব্যাপী ব্যবসায়িক সফরে যাওয়ার আগের দিন, আমি দেখলাম—স্ত্রী বারান্দায় ধোয়া কাপড় ঝেড়ে শুকাতে দিচ্ছে। তার হাতে নীলচে দাগগুলো এত বেশি ছড়িয়ে পড়েছিল যে ত্বকের স্বাভাবিক সাদা অংশগুলোকেই উল্টো ক্ষতের মতো লাগছিল—নীলের ভেতরে ছোট ছোট সাদা দাগ। দৃশ্যটা দেখে আমার শ্বাস আটকে এল। সে যখন খালি ঝুড়িটা হাতে নিয়ে বসার ঘরে ফিরে আসছিল, আমি তার পথ আগলে দাঁড়ালাম; তার গায়ের পোশাক খুলে শরীরের অবস্থাটা দেখাতে বললাম। সে কিছুটা বাধা দিচ্ছিল, কিন্তু আমি খানিকটা জোর করেই তার টি-শার্ট খুলে ফেললাম—বেরিয়ে এল তার কালচে, বিবর্ণ নীলে ছেয়ে যাওয়া একটি কাঁধ।

আমি টলতে টলতে পিছিয়ে গেলাম আর তার শরীরের দিকে তাকালাম। তার বগলের ঘন লোমের অর্ধেকের বেশি ঝরে পড়েছে, আর বাদামি স্তনবৃন্তের রং মুছে গেছে, যা আগে ছিল কোমল ও স্নিগ্ধ।

‘এভাবে আর চলতে পারে না। আমি এখনই তোমার মাকে ফোন করছি।’

‘না, না, করো না, আমিই করছি,’ স্ত্রী তড়িঘড়ি করে চেঁচিয়ে উঠল; তার কথাগুলো এমন অস্পষ্ট আর জড়িয়ে যাচ্ছিল, যেন সে নিজের জিভ চিবোতে চিবোতে কথা বলছে।

‘হাসপাতালে যাও, বুঝলে? ডার্মাটোলজিস্টের কাছে যাও। না, না, কোনো জেনারেল হাসপাতালে যাও।’

সে নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।

‘তুমি তো জানোই, তোমার সঙ্গে যাওয়ার মতো সময় পাচ্ছি না। নিজের শরীরটা তো তুমিই সবচেয়ে ভালো বোঝো। তাই এটার যত্ন তোমাকেই নিতে হবে, তাই না?’ সে আবার মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।

‘শোনো, তোমার মাকে ফোন করো।’

আমার স্ত্রী ঠোঁট চেপে একইভাবে মাথা নেড়ে যাচ্ছিল। তার এই মাথা নাড়ানোর মানে কি সে আমার কথাগুলো শুনছে? মনে হয় না, সম্ভবত আমার কথাগুলো তার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল; আমি যেন শুনতে পাচ্ছিলাম কথাগুলো বসার ঘরের মেঝেতে আছড়ে পড়ছে, আর সস্তা বিস্কুটের মতো ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে।

৬.

লিফটের দরজা খট করে খুলে গেল। আমি ভারী স্যুটকেস হাতে অন্ধকার করিডর দিয়ে হেঁটে এসে কলবেল বাজালাম। কোনো সাড়াশব্দ নেই।

আমি দরজার ঠান্ডা ইস্পাতে কান ঠেকালাম। বারবার কলবেল বাজালাম—দুবার, তিনবার, চারবার...চেক করলাম কাজ করছে কি না; করছে, ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে কলবেলের শব্দটা আসছে, যদিও দরজার আড়ালের কারণে মনে হয় শব্দটা যেন অনেক দূর থেকে আসছে। আমি স্যুটকেসটা দরজার পাশে রেখে ঘড়ি দেখলাম। রাত আটটা। আমার স্ত্রী গভীর ঘুমের মানুষ, কিন্তু এতটা তো নয়।

আমি বেশ ক্লান্ত ছিলাম। কিছুই খাওয়া হয়নি। চাবিটা বের করতেও ঝামেলা মনে হচ্ছিল।

হয়তো আমার স্ত্রী তার মাকে ফোন করেছে এবং হাসপাতালে গেছে, যেহেতু তাকে যেতে বলেছিলাম অথবা গ্রামে আত্মীয়দের কাছে গেছে। কিন্তু না, ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম তার চেনা স্যান্ডেল, অ্যাথলেটিক জুতা, স্মার্ট জুতাগুলো এলোমেলো পড়ে আছে।

আমি নিজের জুতা খুলে স্লিপার পরলাম। অবচেতনভাবেই ফ্ল্যাটের স্বাভাবিক শীতলতা টের পেলাম। কয়েক কদম যেতেই একটা কটু গন্ধ পেলাম। ফ্রিজ খুলে দেখি, জুচিনি আর শসা রাখার ডিশটি কুঁচকে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

আমার স্ত্রী শোবার ঘরে নেই, নেই বাথরুমে, এমনকি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা অন্য ঘরগুলোতেও খুঁজে পেলাম না তাকে। আমি তার নাম ধরে ডাকলাম; কোনো উত্তর নেই। গত সপ্তাহের সংবাদপত্র, ৫০০ মিলি দুধের খালি প্যাকেট, জমাট বাঁধা দুধের ফোঁটা লেগে থাকা গ্লাস, উল্টে রাখা সাদা মোজা সব লিভিংরুমে পড়ে আছে।

রাইস কুকারে আধবাটি ভাত শুকিয়ে প্যানের সঙ্গে লেগে আছে। ঢাকনা খুলতেই পুরোনো ভাতের গন্ধ নাকে এসে লাগল, সঙ্গে উষ্ণ বাষ্পও। সিঙ্কে ময়লা থালা-বাসন জমে আছে, আর ওয়াশিং মেশিনের ওপর রাখা প্লাস্টিকের বাটির ধূসর সাবানজলে ভেজা ধোয়া কাপড় থেকে পচা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

আমার স্ত্রী শোবার ঘরে নেই, নেই বাথরুমে, এমনকি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা অন্য ঘরগুলোতেও খুঁজে পেলাম না তাকে। আমি তার নাম ধরে ডাকলাম; কোনো উত্তর নেই। গত সপ্তাহের সংবাদপত্র, ৫০০ মিলি দুধের খালি প্যাকেট, জমাট বাঁধা দুধের ফোঁটা লেগে থাকা গ্লাস, উল্টে রাখা সাদা মোজা, আর লাল কৃত্রিম চামড়ার পার্স—সব লিভিংরুমে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে।

বাইরের প্রধান সড়ক থেকে গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন যেন ফ্ল্যাটের নিস্তব্ধতাকে ধারালো কোনো ভারী ও কঠিন পদার্থ দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করছে।

আমি ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত ছিলাম। সিঙ্কের ভেতর মরচে ধরা থালা-বাসন জমে আছে। ভাত তোলার জন্য একটাও পরিষ্কার চামচ নেই। দূর সফর শেষে ফাঁকা ঘরে ফিরে আমি নিঃসঙ্গ বোধ করলাম। দীর্ঘ বিমানযাত্রার নানা অভিজ্ঞতা, বিদেশি ট্রেনের জানালা দিয়ে দ্রুত সরে সরে যাওয়া ভূদৃশ্য দেখা—এসব শেয়ার করার মতো কেউ নেই। ‘তুমি কি ক্লান্ত?’—এই সামান্য কথাটুকুও জিজ্ঞেস করার কেউ নেই, যেখানে সব ক্লান্তি হজম করে বলতে পারতাম, ‘আমি ঠিক আছি।’ আমি বড়ই একা বোধ করলাম। আর এই নিঃসঙ্গতার কারণে আমার ভেতরে ক্রোধ সৃষ্টি হলো। মনে হলো আমার এই দুর্বল শরীরের কারণে এই পৃথিবীর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছি না। পোশাকের ভেতর দিয়ে হিমশীত ঢুকে যাচ্ছিল। জীবনে এত দিন আমি যা করতে পেরেছি তা হলো নিজেকে ঠকিয়ে নিজেকে প্রশংসা করা—এই ভেবে আমার রাগ হচ্ছিল। নিজেকে বড়ই একা লাগছিল, যার ভালোবাসার কেউ-ই নেই—আমার অস্তিত্ব যেন ইতিমধ্যেই নিভে গেছে।

ঠিক তখনই আমি একটা রুগ্ণ ক্ষীণ শব্দ শুনতে পেলাম। আমি সেই শব্দের দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। আমার স্ত্রীর কণ্ঠ। ব্যালকনি থেকে আসা অস্পষ্ট বিড়বিড়ানি, যার কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না।

অবিলম্বে সেই তীব্র নিঃসঙ্গতা বদলে গেল স্বস্তিতে। আমি বারান্দার দিকে এগোলাম, একগাদা বিরক্তি জিবের ডগা থেকে সাপের মতো পেঁচিয়ে বেরিয়ে এল, ‘তুমি এতক্ষণ ওখানে কী করছিলে, উত্তর দিলে না কেন?’ আমি ক্ষিপ্র বেগে বারান্দার দরজা খুলে ফেললাম।

‘এভাবে সংসার চলে? পৃথিবীতে বেঁচে আছ কেমন করে?’

তারপর আমি স্ত্রীর নগ্ন শরীরটার দিকে তাকালাম, আর থমকে গেলাম।

স্ত্রী হাঁটু গেড়ে বসে আছে বারান্দার জানালার গ্রিলের দিকে মুখ করে, দুই হাত উঁচু করে যেন উল্লাস করছে। তার পুরো শরীর গাঢ় সবুজ। তার ছায়াচ্ছন্ন মুখ এখন মসৃণ চিরসবুজ পাতার মতো দীপ্ত। তার শুকনো মুলাপাতার মতো চুল এখন বুনো ভেষজ গাছের ডালপালার মতো ঝকঝকে।

তার ফ্যাকাশে সবুজ মুখে দুটি চোখ চকচক করছিল। আমি পিছিয়ে যেতেই সে মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল, উঠতে চাইল যেন। কিন্তু তার পায়ে অকারণ একটা খিঁচুনি উঠল। সে ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারছিল না। তার নমনীয় কোমর যন্ত্রণায় মোচড়াচ্ছিল। তার অবসন্ন জিহ্বা গভীর নীল ঠোঁটের ভেতর জলজ উদ্ভিদের মতো দুলছিল। দাঁতের কোনো চিহ্নও দেখা যাচ্ছিল না। ফ্যাকাশে দাগে ভরা ঠোঁটের ভাঁজ থেকে বেরোল একটিমাত্র শব্দ, কান্নার মতো গোঙানি—‘পানি…’।

আমি দৌড়ে গেলাম সিঙ্কে, কল পুরোটা খুলে প্লাস্টিকের বাটিটা ভরে ফেললাম। তাড়াহুড়ো করে হাঁটার কারণে বাটি দুলে বসার ঘরের মেঝেতে পানি ছলকে পড়ছিল। বারান্দায় ফিরে এসে স্ত্রীর বুকে পানি ছিটাতেই তার পুরো শরীর কেঁপে উঠল, যেন বিশাল কোনো গাছের পাতার পুনর্জাগরণ।

আমি আবার বাটি ভরে এনে তার মাথায় ঢেলে দিলাম। তার চুল হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, যেন কোনো অদৃশ্য ভার এত দিন চাপা দিয়ে রেখেছিল। আমি দেখলাম, আমার স্ত্রীর ঝলমলে সবুজ শরীর খ্রিষ্টধর্মের রীতি বারিসিঞ্চনের মতো আমার এই জলসিঞ্চনে নতুন করে ফুটে উঠছে।

আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল—আমার স্ত্রী কখনো এতটা সুন্দর ছিল না।

৭.

মা,
তোমাকে আর চিঠি লিখতে পারছি না আমি। এমনকি তোমার রেখে যাওয়া সেই সোয়েটারটাও আর পরতে পারছি না; সেই কমলা রঙের পশমি সোয়েটারটা, গত শীতে আমাদের এখানে বেড়াতে এসে যেটা তুমি ভুল করে ফেলে গিয়েছিলে।

ও ব্যবসায়িক সফরে যাওয়ার পরদিন আমি ওটা পরেছিলাম। তুমি তো জানোই মা, আমি বেশ শীতকাতুরে। সোয়েটারটা কাচা হয়নি, তাই ওটাতে তোমার গায়ের গন্ধের সঙ্গে মিশে ছিল রান্নাবান্নার সেই পরিচিত বাসি ঘ্রাণ। সেদিন বড্ড ঠান্ডা না পড়লে হয়তো ওটা কেচে ফেলতাম। অবশ্য না কাচার আরেকটা কারণ আছে, আমি তোমার ওই গন্ধটুকু বারবার বুক ভরে নিতে চেয়েছিলাম। তাই সেদিন ওটা গায়েই রেখে দিয়েছিলাম, এমনকি ওটা পরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

পরদিন সকালেও শীতের কামড় আলগা ছিল না। সম্ভবত তীব্র শীত আর তৃষ্ণায় আমি এতটাই কাতর ছিলাম যে যখন শোবার ঘরের জানালা দিয়ে সকালের রোদ্দুর এসে পড়ল, আমার ভেতর থেকে এক রুদ্ধ হাহাকার বেরিয়ে এল—‘মা…’!

ওই উষ্ণ আলোয় নিজেকে সঁপে দিতে আমি ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, আর শরীর থেকে খুলে ফেলেছিলাম সব পোশাক। আমার অনাবৃত শরীর ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যাওয়া সেই রোদের তেজ ঠিক তোমার গায়ের গন্ধের মতোই ছিল; আমি সেখানে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম আর শুধু ডাকতে লাগলাম—‘মা, ও মা…’। আর কোনো শব্দ আমার মুখ দিয়ে বেরোচ্ছিল না।

জানি না কতটা সময় পেরিয়ে গেছে—দিন, সপ্তাহ, নাকি মাস? বাতাস খুব একটা উষ্ণ ছিল না; কেবল এটুকুই টের পাচ্ছিলাম যে তাপমাত্রা সামান্য একটু বেড়েছে, আর তার পরপরই ঘটছে সমপরিমাণ পতন।

যেকোনো মুহূর্তে চুংনাং নদীর ওধারে থাকা দূরের ফ্ল্যাটগুলোর জানালায় জানালায় কমলা রঙের আলো জ্বলে উঠবে। ওখানে থাকা মানুষগুলো কি আমায় দেখতে পাচ্ছে? ওই যে প্রধান সড়ক দিয়ে হেডলাইটের আলো ছড়িয়ে গাড়িগুলো তীব্র বেগে ছুটে যাচ্ছে—ওগুলো থেকে কি কেউ আমাকে দেখছে? আমাকে এখন দেখতে ঠিক কেমন লাগছে?

*

ও ইদানীং বড্ড বেশি মায়া দেখাচ্ছে। বড়সড় একটা ফুলের টব কিনে এনে সে আমাকে তাতে রোপণ করেছে। ছুটির দিন, মানে রোববারের পুরো সকালটা সে বারান্দার চৌকাঠে বসে কাটায়—আমার গায়ের পোকাগুলো খুঁটে খুঁটে মারে।

যে মানুষটা সব সময় ক্লান্তিতে নুয়ে থাকত, এখন সে রোজ ভোরে আমাদের ব্লকের পেছনের পাহাড়ে উঠে ঝরনার এক বালতি জল নিয়ে ফিরে আসে আমার পায়ে ঢালবে বলে (তার মনে আছে যে আমি কলের জল একদমই সইতে পারি না)। এই তো কিছুক্ষণ আগে সে আমার টবটা খালি করে তাতে এক আঁজলা নতুন উর্বর দোআঁশ মাটি দিয়ে দিল। আগের রাতের বৃষ্টিতে শহরের বাতাস অনেকটা ধুলোময়লামুক্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই সে অবারিত করে খুলে দেয় সামনের দরজা আর জানালাগুলো, যাতে বিশুদ্ধ সতেজ হাওয়া মনের সুখে ঘরের ভেতর হু হু করে ঢুকতে পারে।

*

বড় অদ্ভুত লাগে, মা। দেখা, শোনা, ঘ্রাণ নেওয়া কিংবা স্বাদ আস্বাদন করা ছাড়াও এখন সবকিছু আগের চেয়ে বেশি সতেজ আর জীবন্ত মনে হয়। পিচঢালা রাস্তার ওপর দিয়ে যখন গাড়ির চাকাগুলো ঘষে ঘষে ছুটে চলে, আমি সেই রুক্ষ ঘর্ষণটুকুও টের পাই। ও যখন সদর দরজা খুলে আমার দিকে হেঁটে আসে, তার পায়ের সেই অতি সূক্ষ্ম কম্পনটুকুও আমার চৈতন্য ছুঁয়ে যায়। আমি অনুভব করি—বৃষ্টিভেজা স্যাঁতসেঁতে বাতাস কীভাবে উর্বর সব স্বপ্নে ফুলেফেঁপে উঠছে, আর ভোরের সেই ধূসর আধো-আলোটুকুও অনুভব করি।

কাছে কিংবা দূরে, যেখানেই কোনো গাছের কুঁড়ি প্রস্ফুটিত হয় কিংবা পাপড়ি নিজেকে মেলে ধরে—আমি তা বুঝতে পারি। গুটি থেকে খোলস ভেঙে শুঁয়াপোকার বেরিয়ে আসা, কুকুর-বিড়ালের শাবক জন্ম দেওয়া, পাশের বাড়ির সেই বৃদ্ধের ধুঁকতে থাকা নাড়ির স্পন্দন—সবই আমার ইন্দ্রিয়গোচর হয়। এমনকি ওপরতলার রান্নাঘরে কড়াইয়ে পালংশাক সেদ্ধ হওয়া কিংবা নিচতলার ফ্ল্যাটে গ্রামোফোনের পাশে রাখা ফুলদানি থেকে ছিঁড়ে আনা একগুচ্ছ চন্দ্রমল্লিকার অস্তিত্বও আমি টের পাই। দিন হোক বা রাত, নক্ষত্ররা আকাশে এক শান্ত জ্যামিতিক পথে হেঁটে বেড়ায়; আর প্রতিদিন সূর্য ওঠার সাথে সাথে হাইওয়ের ধারের ওই সাইকামোর গাছগুলো (ডুমুরগাছবিশেষ) তাদের তৃষ্ণার্ত শরীর নিয়ে পুব দিকে ঝুঁকে পড়ে। আমার শরীরও ঠিক একইভাবে সাড়া দেয়।

তুমি কি বুঝতে পারছ মা? আমি জানি, অচিরেই হয়তো আমার চিন্তাশক্তিটুকুও হারিয়ে যাবে; কিন্তু এতে আমার কোনো আক্ষেপ নেই, আমি বেশ আছি। কতকাল ধরে আমি এমনই একটা জীবনের স্বপ্ন দেখেছি, যেখানে বেঁচে থাকার জন্য বাতাস, রোদ আর জল ছাড়া অন্য কোনো কিছুরই প্রয়োজন হবে না।

মা, ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ে। দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে তোমার স্কার্টে মুখ লুকাতাম—আহা, কী দারুণ সেই গন্ধ! তিলের তেলের ঘ্রাণ, মচমচে ভাজা তিলবীজের সুবাস। আমার হাতে তো সব সময় কাদামাটি লেগেই থাকত। সেই মাটিমাখা হাতে তোমার স্কার্টের কোণ কত যে নোংরা করেছি!

আমার বয়স তখন কতই-বা ছিল, খুব তো বেশি নয়। হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আসা বসন্তের এমনই এক দিনে বাবা আমাকে পাওয়ার টিলারে তুলে নিয়ে সমুদ্রের পাড়ে যাচ্ছিলেন। রেইনকোট পরা বড়দের সেই নির্ভার হাসি; কপালে লেপ্টে থাকা ভেজা চুলের শিশুরা ছোটাছুটি আর হাত নাড়িয়ে হইচই করছে। সেই সব শিশুর মুখ যেন ঝাপসা ঘূর্ণির মতো আজও আমার চোখে ভেসে ওঠে।

মা, সমুদ্রের ধারের ওই দরিদ্র গ্রামই ছিল তোমার একমাত্র দুনিয়া। ওখানেই তোমার জন্ম, ওখানেই বেড়ে ওঠা। ওখানেই তোমার মা হওয়া, হাড়ভাঙা খাটুনি আর ওখানেই জরাগ্রস্ত হওয়া। একদিন তোমাকেও বাবার পাশে আমাদের পারিবারিক কবরস্থানেই শুইয়ে দেওয়া হবে।

মা, ঠিক তোমার মতো ছোট্ট এক দুনিয়ায় শেষ হয়ে যাওয়ার ভয় থেকেই আমি ঘর আর নিজের মধ্যে এক দুস্তর ব্যবধান তৈরি করেছিলাম। আর সতেরো বছর বয়সে ঘর ছেড়ে পালিয়েছিলাম। বুসান, দেগু কিংবা গাংনুংয়ের মতো সেই শহরগুলোতে পুরো এক মাস উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। এসব আজও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। জাপানি রেস্তোরাঁয় বয়স লুকিয়ে কাজ করা, একা একা ফরমাশ খাটা, আর লাইব্রেরির রিডিং রুমে ভ্রূণের মতো কুঁকড়ে রাত কাটানো—জায়গাটা আমার বড্ড প্রিয় ছিল। শহরের সে কী চোখধাঁধানো আলো, আর ওখানকার মানুষগুলোর সে কী চকচকে জাঁকজমক জীবন!

আমি জানি না ঠিক কবে প্রথম টের পেয়েছিলাম যে একদিন আমিও এই অচেনা মানুষের ভিড়ে বুড়ো হয়ে যাব, নিঃশেষ হয়ে যাব। আমি বাড়িতেও অসুখী ছিলাম, অন্যত্রও সেই একই যন্ত্রণা—বলো তো মা, আমি তাহলে কোথায় যেতাম?

সুখ আমার কপালে কোনো দিনই ছিল না। আমার পিঠের ওপর কি কোনো অভিশপ্ত আত্মা সারাক্ষণ সওয়ার হয়ে থাকে, যে আমার গলা টিপে ধরে, জাপটে ধরে আমার হাত-পা? আমি সব সময় শুধু পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছি—একেবারে আদিম এক সহজাত তাড়না—যে যন্ত্রণা হাহাকার হয়ে বেরিয়ে আসে, যে দংশন তীব্র চিৎকার জন্ম দেয়—তেমনই এক ছটফটানি যেন। বাসের পেছনের সিটে হাঁটু গুটিয়ে এমনভাবে বসে থাকতাম, যেন আমি ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানি না; অথচ সেই সময় আমার মন চাইত—নিজের হাতের মুষ্টি দিয়ে জানালার কাচটা গুঁড়িয়ে দিই, তারপর নিজের হাতের তালু বেয়ে গড়িয়ে পড়া সেই রক্ত চেটে চেটে খাই, যেভাবে তৃষ্ণার্ত বিড়াল দুধ খায়। আমি আসলে কী থেকে পালাতে চেয়েছিলাম মা? কোন যন্ত্রণা আমাকে এত অস্থির করে তুলেছিল যে আমি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে গিয়ে লুকোতে চেয়েছিলাম? আর কোন মায়া বা বন্ধন আমাকে পেছনের দিকে টেনে ধরে রেখেছিল? কী আমাকে আটকে রেখেছিল, খোঁড়া করে দিয়েছিল? এই বিষাক্ত রক্ত ঝরিয়ে দিয়ে নতুন জন্মের পথে যেতে কোন অদৃশ্য শিকল আমার পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছিল?

প্রবীণ চিকিৎসক বারবার আঙুল দিয়ে স্টেথোস্কোপে টোকা দিচ্ছিলেন আর বিড়বিড় করে বলছিলেন, আমার ভেতরটা নাকি কবরের মতো সুনসান, কোনো শব্দ নেই; কেবল দূর থেকে ভেসে আসা বাতাসের ঝাপটার এক অদ্ভুত প্রতিধ্বনি শোনা যায়। স্টেথোস্কোপটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে তিনি আলট্রাসাউন্ডের মনিটরটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন। আমি নিশ্চল হয়ে শুয়ে রইলাম; তিনি আমার পেটে আঠালো আর ঠান্ডা একধরনের জেল মাখিয়ে দিলেন। এরপর লাঠির মতো দেখতে একটা শীতল যন্ত্র আমার শরীরের ওপরাংশ, মানে বুকের খাঁচা থেকে তলপেট পর্যন্ত খুব নিয়ম করে ঘুরে বেড়াতে লাগল। যন্ত্রটির মাধ্যমেই বোধ হয় আমার শরীরের ভেতরের সাদা-কালো ছবিগুলো মনিটরে ফুটে উঠছিল।

‘সব তো স্বাভাবিকই আছে,’ জিহ্বায় অস্পষ্ট একটা শব্দ করে তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন।

‘এখন তোমার অন্ত্রগুলো দেখছি...এখানেও কোনো সমস্যাই নেই।’

সবকিছুকেই শেষ পর্যন্ত ‘স্বাভাবিক’ বলে ঘোষণা করা হলো।

‘পাকস্থলী, লিভার, জরায়ু, কিডনি—সবই ঠিক আছে।’

তিনি কেন দেখতে পাচ্ছিলেন না যে আমার এই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে, সহসাই এগুলো সব অদৃশ্য হয়ে যাবে? কতগুলো টিস্যু দিয়ে আমি পেট থেকে জেলের বেশির ভাগটাই মুছে ফেললাম। আমি যখন ওঠার চেষ্টা করছিলাম, তিনি আমাকে আবার শুয়ে পড়তে বললেন। আমার পেটের কয়েকটা জায়গায় তিনি জোরে চাপ দিলেন, কিন্তু খুব একটা ব্যথা লাগছিল না। চোখে চশমা আঁটা সেই লোকটা যখন খুব দায়সারাভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ব্যথা করছে?’ আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে কেবল মাথা নাড়লাম।

‘এখানে ঠিক আছে তো?’

‘এখানটায় কি ব্যথা লাগছে?’

‘না, লাগছে না।’

একটা ইনজেকশন দেওয়া হলো আমায়। ফেরার পথে সাবওয়ে স্টেশনের ভেতর আমি আবার বমি করলাম। স্টেশনের টাইলস লাগানো দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আমি কুঁকড়ে বসে রইলাম। ব্যথাটা কমার অপেক্ষায় আমি প্রহর গুনছিলাম। ডাক্তার আমাকে শান্ত থাকতে বলেছিলেন, বলেছিলেন সুন্দর আর আরামপ্রদ কিছু ভাবতে। সবকিছুই নাকি মনের ব্যাপার—কোনো এক বৌদ্ধ ধর্মগুরুর মতো তিনি সুরে সুরে কথাগুলো বলছিলেন। বমি চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে আমি আওড়িয়ে যাচ্ছিলাম—সুখকর চিন্তা, শান্ত চিন্তা...এক, দুই, তিন, চার...অন্তহীন শান্তি...ব্যথায় আমার চোখ ফেটে জল আসছিল, পাকস্থলীর সেই তীব্র অম্ল উগরে দেওয়ার সময় সারা শরীর খিঁচিয়ে ধরছিল বারবার। শেষ পর্যন্ত যখন আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না, তখন আমি মেঝেতে এলিয়ে পড়েছিলাম। পায়ের তলার এই কাঁপতে থাকা মাটিটা কখন স্থির হবে, দোহাই তোমার, এবার থামো! কত দিন আগের কথা এসব!

*

মা, আমি বারবার একই স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নে দেখি, আমি একটা পপলারগাছের মতো দীর্ঘ হয়ে উঠছি। ব্যালকনির ছাদ ফুঁড়ে, এর পরের তলার ছাদ ভেদ করে আমি ক্রমশ ওপরে উঠছি—পনেরো তলা, ষোলো তলা…সব কংক্রিট আর লোহার রড ছিন্নভিন্ন করে আমি একেবারে ওপরের ছাদটাও বিদীর্ণ করে বেরিয়ে যাচ্ছি।

আমার ডালপালার একদম ডগায় সাদা শুঁয়াপোকার মতো ফুলগুলো কিলবিল করে ফুটছে। আমার প্রাণনাড়ি স্বচ্ছ জল এমনভাবে টেনে নিচ্ছে আকণ্ঠ তৃষ্ণায়, যেন ফেটে পড়বে এখনই। আমার বুকের খাঁচাটা আকাশের দিকে ঠেলে উঠছে আর আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি আমার শাখা–প্রশাখাগুলো আরও ছড়িয়ে দিতে। এভাবেই আমি এই খাঁচার মতো ফ্ল্যাটটা থেকে মুক্তি পাই। প্রতি রাতে মা, প্রতি রাতে আমি এই একই স্বপ্ন দেখি।

*

দিনগুলো ক্রমেই শীতল হয়ে আসছে। আজও হয়তো এই পৃথিবী দেখেছে অনেক পাতার ঝরে যাওয়া, অনেক সাপের খোলস বদলানো, কত শত নাম না–জানা পতঙ্গের তুচ্ছ প্রাণের অবসান; হয়তো দেখেছে ব্যাঙেদের শীতনিদ্রায় চলে যাওয়া—সময়ের একটু আগেই।

আমি এখনো তোমার সেই সোয়েটারটার কথা ভাবি। তোমার গায়ের গন্ধের স্মৃতিটা এখন আর আগের মতো স্পষ্ট নেই। ওকে বলতে ইচ্ছে করে, সোয়েটারটা যেন আমার গায়ের ওপর বিছিয়ে দেয়, কিন্তু এখন যে আর আমার বাক্‌শক্তি নেই। আমি কী করে বলব বলো? সে আমার এই শুকিয়ে যাওয়া দেখে কাঁদে, আবার রাগও করে। তুমি তো জানোই, এ পৃথিবীতে আমিই তার সব। আমি অনুভব করি, তার উষ্ণ অশ্রু মিশে যাচ্ছে সেই মিনারেল ওয়াটারে, যা সে আমার ওপর ঢালে। আমি অনুভব করি, চারপাশের বাতাসের অণুগুলোর অস্থিরতা, যখন সে লক্ষ্যহীনভাবে তার মুষ্টিবদ্ধ হাতগুলো শূন্যে ছুড়তে থাকে।

*

মা, আমার বড্ড ভয় করছে। আমার হাত-পাগুলো এবার ঝরিয়ে দিতে হবে। এই ফুলের টবটা বড্ড ছোট, এর দেয়ালগুলো বেশ শক্ত। তাই আমার শিকড়ের ডগায় ডগায় তীব্র ব্যথা হয়েছে। মা, শীত আসার আগেই হয়তো আমি মরে যাব।

কিন্তু আমার সন্দেহ হয়, এ পৃথিবীতে আমি আর ফুটতে পারব কি না।

৮.

ব্যবসায়িক সফর শেষে সেদিন রাতে বাসায় ফেরার পর তিন গামলা জল দিয়ে আমার স্ত্রীর শরীর ভালো করে ভিজিয়ে দিয়েছিলাম। এর পরপরই সে পাকস্থলীর হলদেটে অম্ল উগরে দেয়। দেখলাম, তার ঠোঁট দুটো কুঁচকে আসছে এবং খুব দ্রুত একে অপরের সাথে সেলাই হওয়ার মতো মিশে গেল—রক্তমাংস মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।

আমার কম্পিত আঙুলগুলো তার সেই ফ্যাকাশে দাগে ভরা ঠোঁটের ওপর যখন হাতড়াচ্ছিল, শেষবারের মতো এক ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম; আওয়াজটা এতটাই অস্পষ্ট যে তার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা গেল না। ওটাই ছিল আমার স্ত্রীর শেষ কথা। এরপর তার মুখ থেকে কখনো একটা গোঙানি পর্যন্ত বের হয়নি।

তার ঊরু চিরে সাদা শিকড়ের এক ঘন জট বেরিয়ে এল। বুক ফুঁড়ে ফুটে উঠল কালচে লাল ফুল। নিপল বা বোঁটার অগ্রভাগ ভেদ করে বেরিয়ে এল জোড়া পুংকেশর, যার গোড়াটা স্থূল আর হলদেটে, কিন্তু ডগাটা ধবধবে সাদা। তার তুলে রাখা হাত দুটোয় যতটুকু যৎসামান্য শক্তি অবশিষ্ট ছিল, তা দিয়েই সে আমার গলাটা জড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করছিল। তার চোখের দিকে তাকালাম, তাতে তখনো একফালি ম্লান আলো বেঁচে ছিল। তার সেই ক্যামেলিয়া ফুলের পাপড়ির মতো হাতের আলিঙ্গনের ভেতর আমার মাথাটা গলিয়ে দিলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি ঠিক আছ?’ পেকে কালো হয়ে যাওয়া এক জোড়া আঙুরের মতো তার চোখ দুটোতে একফালি অস্ফুট হাসি চিকচিক করছিল।

হেমন্তের মাঝামাঝিতে আমি লক্ষ করলাম, একটা স্বচ্ছ কমলা আভা ধীরে ধীরে আমার স্ত্রীর শরীরে ফুটে উঠছে। আমি যখন জানালাগুলো খুলে দিলাম, ওপরের দিকে প্রসারিত তার হাতগুলো বাতাসের ঝাপটায় সামান্য দুলছিল।

যখন হেমন্ত বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, আমার স্ত্রীর পাতাগুলো দু-তিনটে করে ঝরতে শুরু করে। তার সেই কমলা রঙের শরীর ধীরে ধীরে ঘোলাটে খয়েরি রং ধারণ করছিল।

আমি আমাদের সর্বশেষ শারীরিক মিলনের কথা ভাবছিলাম। তার শরীর থেকে নিঃসরিত তরল পদার্থের সেই চেনা টক গন্ধের বদলে তখন তার নিম্নাঙ্গ থেকে এক অজানা, মৃদু মিষ্টি সুবাস আসছিল। আমি তখন ভেবেছিলাম, সে হয়তো সাবানের ব্র্যান্ড বদলেছে, নয়তো হাতে কিছুটা সময় ছিল বলে শরীরে কয়েক ফোঁটা সুগন্ধি ছিটিয়ে নিয়েছে। সেসব কত দিন আগের কথা!

এখন তার অবয়বে দুপেয়ে মানুষের সামান্যতম চিহ্নও আর অবশিষ্ট নেই। ডাগর কালো আঙুরে রূপান্তরিত তার চোখ দুটো এখন খয়েরি ডালপালার নিচে ধীরে ধীরে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। আমার স্ত্রী এখন আর দেখতে পায় না। এমনকি সে তার ডালগুলোর ডগাও নাড়াতে পারে না। কিন্তু আমি যখনই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই, ভাষাতীত এক অদ্ভুত ধোঁয়াশাচ্ছন্ন অনুভূতি আমাকে আবিষ্ট করে; যেন এক অতি সূক্ষ্ম বিদ্যুৎ তরঙ্গ তার শরীর থেকে নির্গত হয়ে আমার শরীরে প্রবাহিত হয়। যে পাতাগুলো একসময় আমার স্ত্রীর হাত আর চুল ছিল, সেগুলো সব ঝরে পড়েছে; আর যেখানে তার ঠোঁট দুটো জোড়া লেগে ছিল, সেই সন্ধিস্থল ফেটে গিয়ে একগুচ্ছ ফল বেরিয়ে এল। ঠিক তখনই সেই অনুভূতিটা পাতলা এক সুতো ছিঁড়ে যাওয়ার মতো নিঃশব্দে শেষ হয়ে গেল।

ডালিমের মতো করে ছোট ফলগুলো একসঙ্গে ফেটে বেরিয়ে এসেছিল। আমি সেগুলো দুহাতে সংগ্রহ করলাম আর বারান্দা ও বসার ঘরের মাঝখানের সেই চৌকাঠে গিয়ে বসলাম। হলদেটে সবুজ রঙের এই ফলগুলো আমি জীবনে এই প্রথমবার দেখলাম। এগুলো বেশ শক্ত, বিয়ারের সঙ্গে পপকর্নের পাশে দেওয়া সূর্যমুখী বিচির মতোই শক্ত।

আমি এর একটা ফল তুলে মুখে নিলাম। এর পাতলা মসৃণ আবরণের কোনো স্বাদ বা গন্ধ নেই। ফলটা খাওয়ার সময় কড়কড় শব্দ হচ্ছিল। এটা এমন এক নারীর ফল, যে নারী এই পৃথিবীতে কেবল আমারই ছিল।

ফলটার স্বাদ ছিল অম্লীয়, ঝাঁজালো, জিহ্বাকে যেন পুড়িয়ে দিচ্ছিল। খাওয়ার অনেক পরও জিবের গোড়ায় এর তিক্ত স্বাদের রস লেগে ছিল।

পরদিন আমি এক ডজন ছোট গোলাকার মাটির টব কিনে আনলাম এবং সেগুলো উর্বর মাটিতে ভরে বীজগুলো রোপণ করে দিলাম। ডাল-পাতা ঝরে শুকিয়ে যাওয়া আমার স্ত্রী যে টবটিতে আছে, তার পাশেই আমি সেই ছোট টবগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে জানালা খুলে দিলাম। আমি রেলিংয়ে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম, আর আমার স্ত্রীর নিম্নাঙ্গ থেকে হঠাৎ ফুটে ওঠা সেই কচি ঘাসের গন্ধ প্রাণভরে নিতে লাগলাম। হেমন্তের শেষ বিকেলের হিমেল বাতাস আমার সিগারেটের ধোঁয়া আর আমার লম্বা চুলগুলোকে অগোছালো করে উড়িয়ে দিচ্ছিল।

বসন্ত যখন আসবে, আমার স্ত্রী কি আবার মুকুলিত হবে? তার ফুলগুলো কি আবার লাল হয়ে ফুটবে? আমি জানি না, সত্যিই জানি না।