গল্প

গ্রামের নাম বর্ণমালা

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

কাঠের বইটা এখনো খুলে দেখেনি তুলি। কারণ, বইয়ের ওপরে বড় বড় করে লেখা, ‘এ বই বড়ই জাদুময়, খোলা বারণ।’ তুলির চোখ বড় বড়। বইয়ের ভেতর জাদু! বাহ্!
বইটা তুলির দাদার দাদার দাদা পেয়েছিলেন। মানে দুই শ বছরের পুরোনো। পুরোনো বইয়ের আলমারি ঘেঁটে বইটা পেয়েছে তুলি। এত দিন নিশ্চয়ই কেউ পড়েনি এটা।
বইটা খুলে দেখলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। মলাট ওল্টাল তুলি। শোঁ শোঁ শোঁ। এ কী! বইটার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে ছোট্ট তুলি! বইটা যেন গিলে খাচ্ছে তুলিকে। এ কি তবে মানুষখেকো বই!
তুলি চোখ মেলল। ‘এ কোথায় এলাম! অ্যাঁ...অ্যাঁ...।’ তুলি বুঝতে পারছে না, সে কি বইটার পেটের ভেতর, নাকি অন্য কোথাও? বইয়ের ভেতরটা এমন কেন? আশপাশে মানুষ নেই কেন?
‘হুমম খুকসস খুককসস...অ অ অ।’
কে যেন কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল। তুলির সামনে একটা বড় নীল রঙের গাছ। গাছের আড়াল থেকেই আসছে শব্দটা।
‘কে ওখানে?’
একটা কিছু উঁকি দিল। তারপর আড়াল থেকে বলল, ‘আমি অ...মানে স্বরে-অ। তোমার নাম কী?’
‘এটা আবার কেমন নাম! আমার নাম তুলি। আমি কোথায়?’
‘তুমি নতুন! ইশ্! কত দিন এই গ্রামে অতিথি আসে না।’
কথা বলতে বলতে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল অ...স্বরে-অ। তুলির চোখ ছানাবড়া। সত্যি সত্যি একটা অ এসে হাজির। দেখতে একেবারে স্বরবর্ণ অ-এর মতো। আরে! অ তো অ-এর মতোই হবে!
‘আমাদের গ্রামের নাম বর্ণমালা। বর্ণমালায় তোমাকে স্বাগত, খুকি।’
‘অ্যাঁ! তুমিই সেই স্বরে-অ? মানে আমরা যেটা পড়ি সেই অ? কী মজা!’
‘হ্যাঁ, ওই যে আমার বড় ভাই স্বরে-আ আসছে।’
সত্যি সত্যিই একটা স্বরে-আ হেঁটে হেঁটে আসছে। তুলি হাঁ করে তাকিয়ে দেখল। তার বেশ মজাও লাগছে। তুলি জানতে চাইল, ‘ই কোথায়? হ্রস্ব-ই?’
‘আমি এখানে!’
চিকন কণ্ঠের একটা মেয়ে কথা বলে উঠল ওপরে কোথাও। ওপরে তাকাল তুলি। গাছের মগডালে নিজের গোলাকার মাথাটা জুড়ে দিয়ে ঝুলে আছে ই।
এভাবে একে একে অনেকে এসে হাজির। বর্ণমালার নতুন অতিথিকে নিয়ে সবার খুব আগ্রহ। তুলিকে দেখার পর থেকে মুখটা গোল করে আছে ‘ও’। ঐ-টা বারবার তাকে বলছে, ‘চলো ঐ পাড়ায় যাই, ঐ যে।’
‘ঐ পাড়ায় কী আছে?’
‘ঐ পাড়ায় ব্যাঞ্জনবর্ণরা থাকে। আমরা হলাম...।’
‘জানি, তোমরা স্বরবর্ণ।’
তুলির খবর ওই পাড়ায় যেতে সময় লাগল না। সবাই তুলিকে দেখতে ছুটে এসেছে। প্রশ্নের শেষ নেই তাদের।
‘তোমরা আমাদের দিয়ে বাংলা পড়ো? লেখালেখি করো?’
দন্ত্যস-কে দেখিয়ে তালব্য-শ জানতে চাইল, ‘বলো তো আমি আগে নাকি ও আগে?’
‘আচ্ছা, আমাদের সবার নাম একে একে বলো তো?’
এমন আরও অনেক প্রশ্ন শুনে শুনে হয়রান তুলি। তবে ঋ-কে তার পছন্দ হয়েছে। সারাক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। চন্দ্রবিন্দুটা নাকি নাকি গলায় বলল, ‘আঁমাকে ছাঁড়া নাঁকি তোঁমরা চাঁদ লিঁখতে পাঁরো নাঁ। হেঁ হেঁ হেঁ।’ অমনি কোথা থেকে দীর্ঘ-উ-কার এসে বলল, ‘উ উ, আমাকে ছাড়া তো সূর্যই হয় না, উউউউ!’
সবাই থামিয়ে দিয়ে খসখসে গলায় খ বলল, ‘খুখকি খুখকি, খিদে লেগেছে? খাবার খাবে? খাবার খাবে?’
তুলির পানির পিপাসা পেল। পানি পাবে কোথায়? একটা বুদ্ধি অবশ্য আছে। বর্ণমালাদের ভেতর প-কে বলল কাছে আসতে। এরপর গাছ থেকে একটা আকার পেড়ে বসিয়ে দিল প-এর পাশে। তারপর দন্ত্য-ন-টাকে রেখে তার আগে বসিয়ে দিল হ্রস্ব-ই কার। সঙ্গে সঙ্গে এক গ্লাস পানি হাজির! বর্ণমালারা এটা দেখে মজা পেয়ে গেল। তুলির কথামতো ওরা একে অন্যের আগে পিছে বসে তৈরি করছে মজার মজার সব খাবার। এই যেমন হ্রস্ব-ই-কারটাকে এবার প-এর আগে বসিয়ে দিল, ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ঠ এসে হাজির। তারপর আকারটা ঠ-এর গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। হয়ে গেল পিঠা!
অনেক খাওয়া হলো। পেট ফুলে ঢোল। এবার বাড়ি যেতে হবে। কিন্তু কীভাবে! তুলির কান্না পেল। এখন উপায়! এমন সময় চোখ মেলে তাকাল ঋ। একটা কিছু বলবে সে।
‘রি রি রি রি। বাড়ি যেতে হলে বাড়ির নাম লিখতে হবে খুকি।’
তুলির গ্রামের নাম তক্ষশীলা। উফ্, গ্রামের নাম এত কঠিন হওয়ার কী দরকার ছিল! ত আছে তালব্য-শ আছে, দীর্ঘ-ই-কারও আছে, ল-ও আছে, ক্ষ-টাকে পায় কোথায়? কী বিপদের কথা!
এমন সময় এগিয়ে এল গ্রামের মুরব্বি ভ। ভ হলো সবার বড় ভাই। এসেই গমগম করে বলল, ক আর মূর্ধণ্য-ষ এগিয়ে আসো। ক আর ষ ভয়ে ভয়ে দাঁড়াল। ভ-এর হাতে একটা ছোট বাক্স। ক আর ষ-কে ইশারা করতেই ওরা বাক্সের ভেতর ঢুকে গেল। তুলির হাতে বাক্সটা দিয়ে ভ বলল, ‘এবার ভালো করে ঝাঁকাও, ভা...লো করে।’
ভীষণ জোরে বাক্সটা ঝাঁকাল তুলি। ওমা! ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ক্ষ! এ তো ম্যাজিক! তার মানে ক আর ষ মিলে ক্ষ হয়? আরে, এবার তো তক্ষশীলা লেখা যায়! ক্ষ গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল জায়গামতো। অমনি শুরু হলো শোঁ শোঁ শোঁ। তক্ষশীলা লেখাটার ভেতর ঢুকে গেল তুলি। ফিরে এল গ্রামে। সেই আলমারির সামনে!
বইটা বন্ধ করে দিল তুলি। তবে পরে আবার খুলবে। বর্ণমালার গ্রামটা তার খুব পছন্দ হয়েছে। একেকটা অক্ষর সাজিয়ে কত কী বানিয়ে ফেলা যায়!