ঋত্বিক প্রতিকৃতি: মাসুুক হেলাল, গ্রাফিকস: প্রথম আলো
ঋত্বিক প্রতিকৃতি: মাসুুক হেলাল, গ্রাফিকস: প্রথম আলো

ঋত্বিক ঘটকের জন্মশতবর্ষ

মেঘে ঢাকা তারা: মাতৃকূটের জটিল প্রকাশ

ভারত উপমহাদেশ ছাড়িয়ে ঋত্বিককুমার ঘটকের চলচ্চিত্রকর্ম এখন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় চর্চিত ও ধ্রুপদি ছবির মর্যাদা পেয়েছে। ব্যক্তিজীবনে বেপরোয়া ও এলোমেলো হলেও, শিল্পসৃজনে তিনি ছিলেন আপসহীন ও আবেগী সত্তা। আর এই ব্যক্তিত্বই ঋত্বিক ঘটককে ধীরে ধীরে পরিণত করেছে কিংবদন্তিতে। আজ ২০২৫ সালের ৪ নভেম্বর তাঁর জন্মশতবর্ষ। সে উপলক্ষে রচিত হয়েছে নিচের লেখাটি।

দেশভাগের পর দেশমাতৃকার সঙ্গে নাড়িছেঁড়ার স্মৃতি নিয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতার এক প্রান্তে গিয়ে আশ্রয় নেয় নীতার পরিবার। সেখানে আরও অনেক উন্মূল মানুষের ভিড়। তারা গঠন করে কলোনি। কলোনির সবাই জানে নীতা অতি নম্র ও পরিশ্রমী মেয়ে। যে টিউশনির সামান্য টাকায় মা-বাবাসহ একাই চার ভাইবোনের সংসার চালায়। দারিদ্র্য তাদের নিত্যসঙ্গী। কলোনির গরিব মুদিদোকানি তাদের পছন্দ করে, কিন্তু বাকিতে সদাই দিতে দিতে সে–ও ক্লান্ত ও অসহায়। দেনার পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। তাই দুটো কথা শুনিয়ে দেয় দোকানি। পায়ে থাকা নিতান্ত চপ্পলও যেন শ্রান্ত নীতার অপমান সইতে পারে না, ফটাস করে ছিঁড়ে যায় ফিতা। ভাগ্যের এমন নির্মম পরিহাস ও নীরবে তা সহ্য করে নিতে নিতে একদিন হারিয়ে যায় নীতা। কিন্তু সর্বত্র সে ছড়িয়ে দিয়ে যায় বাঁচার আকুতি। তবে কে তাকে মেরে ফেলল? নিষ্ঠুর যক্ষা? নির্মম নিয়তি? নিজের প্রতিবাদ না করতে পারার অক্ষমতা? নাকি আপন জন্মদাত্রী মায়ের নির্দয় সাংসারিক হিসাব–নিকাশ? আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে, নীতার পরিণতির জন্য সব কারণই দায়ী। দায় যার ওপরেই বর্তাক না কেন, মূলকথা হলো যন্ত্রণাভোগ। যে নিজে মোমের মতো জ্বলে জ্বলে নিঃশেষ হয়ে যায়, কিন্তু আলোকিত করে যায় অন্যদের জীবন।

‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০) চলচ্চিত্রে নীতা (সুপ্রিয়া চৌধুরী) এমন এক চরিত্র, যে নিজে মাতৃত্বের স্নেহে ভাইবোনদের আগলে রাখে, কিন্তু আপন-মা হয়ে ওঠে পর। নীতা একমাত্র উপার্জনক্ষম বলে তাকেই নিংড়ে সংসার চালান জন্মদাত্রী মা। অবশ্য অন্য সন্তানদের ভর্ৎসনা করেন না, তা নয়। বড় ছেলে শঙ্কর (অনিল চট্টোপাধ্যায়) সংগীতসাধক, সে শিল্পী। সামান্য চাকরি–বাকরি নয়, সে চায় সংগীতের সাধনা করে একদিন অনেক বড় হবে। কিন্তু মা সেটা বুঝতে পারেন না। নীতা বুঝতে পারে অগ্রজ শঙ্কর আর দশজনের মতো নয়। শঙ্করকে নিয়ে তার এই বোঝাপড়া বিফলে যায়নি। কিন্তু তার আগপর্যন্ত সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া মা নিংড়ে নিতে থাকেন নীতাকে। নীতা মনে মনে কষ্ট পায়। সে আরও কষ্ট পায় যখন প্রেমিক সনৎ বিশ্বাসঘাতকতা করে, ছোট দুই ভাইবোনের স্বার্থপরতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করে। এবং শেষ পর্যন্ত যখন শরীরটাও বেঁকে বসে, তখন মুষড়ে পড়ে আজীবন সংগ্রাম করতে থাকা নীতা।

গোটা ছবিতে নীতার মা নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর গোপন অভিপ্রায়ে নীতার সঙ্গে সনতের বিয়ে হয় না। নীতার বোন গীতা যে সনতের দিকে ঝুঁকে পড়ে ও তাকে বিয়ে করে, তার পেছনে কাজ করে মায়ের অভিসন্ধি। কারণ, তিনি চাননি নীতা বিয়ে করে অন্যের সংসারে চলে যাক।
মেঘে ঢাকা তারা চলচ্চিত্রে নীতা চরিত্রে অভিনয়শিল্পী সুপ্রিয়া দেবী

গোটা ছবিতে নীতার মা নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর গোপন অভিপ্রায়ে নীতার সঙ্গে সনতের বিয়ে হয় না। নীতার বোন গীতা যে সনতের দিকে ঝুঁকে পড়ে ও তাকে বিয়ে করে, তার পেছনে কাজ করে মায়ের অভিসন্ধি। কারণ, তিনি চাননি নীতা বিয়ে করে অন্যের সংসারে চলে যাক। সংসারের জন্য এই যে নিজের রক্ত ঘাম করা উপার্জনের সবটাই মায়ের হাতে তুলে দেয় নীতা, তারপরও যেন মায়ের মন পায় না সে। মায়ের কাছ থেকে অভিযোগ, তাচ্ছিল্য ও অবহেলাই যেন প্রাপ্য নীতার। এ কারণে নীতা ধীরে ধীরে মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। নিজের অসুস্থতার খবরও সে মাকে বলে না।

নীতার ভেতর যে মাতৃরূপ দেখাতে চান ঋত্বিক ঘটক, তার ঠিক উল্টোটা দেখি নীতার মায়ের ভেতর। এক মায়ের প্রত্নপ্রতিমা নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছে, আরেক মায়ের প্রত্নপ্রতিমা শুধু নিংড়ে নিচ্ছে। আর্কিটাইপাল ইমেজ অব মাদার ধারণাটি সুইস মনোবিজ্ঞানী কার্ল গুস্তাভ ইয়ুংয়ের। ঋত্বিকের এই ছবিতে মায়ের প্রত্নপ্রতিমা ছাড়াও ইয়ুংয়ের ‘মাতৃকূট’ বা মাদার কমপ্লেক্স ধারণারও প্রয়োগ ঘটেছে। এমনিতে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটিকে সরল ও মেলোড্রামাটিক মনে হলেও এটি ঋত্বিক ঘটকের বেশ জটিল মনস্তত্ত্বের ছবি। নীতার মায়ের সঙ্গে তার সন্তানদের যে সম্পর্ক, সেখানে অনেকগুলো মাত্রা দেখা যায়। ইয়ুংয়ের মতে, সন্তানের সঙ্গে মায়ের যে মনোজাগতিক সম্পর্ক, সেখান থেকে মাতৃকূটের সৃষ্টি হয়।

মা সন্তানের জন্য প্রকৃতির মতো। প্রকৃতি একাধারে লালন করে, আবার ধ্বংসও করে। অর্থাৎ সৃষ্টি ও বিনষ্টের বিপরীতমুখী দুই শক্তিকেই ধারণ করে প্রকৃতি তথা মা। এই মাতৃধারণার সঙ্গে সন্তানের যে মাতৃকূট গড়ে ওঠে, সেটি আবার ভিন্ন হয় নারী ও পুরুষভেদে। অর্থাৎ মায়ের সাথে নীতা ও গীতার যে সম্পর্ক, সেটি শঙ্কর ও মন্টুর চেয়ে আলাদা। এই ছবি জটিল হয়ে ওঠে তখনই, যখন নীতা নিজেও মাতৃরূপে আবির্ভূত হয়। মা ধারণাটির প্রত্নপ্রতিমা আসলে আমরা আবিষ্কার করি যুগপৎভাবে নীতার মা ও নীতার ভেতর। এবং বলার অপেক্ষা রাখে না দেশমাতৃকার ভেতরও। যে দেশ থেকে তাদের চলে আসতে হয়েছে এবং যে দেশে আশ্রয় নিয়েছে।

আর্কিটাইপাল ইমেজ অব মাদার ধারণাটি সুইস মনোবিজ্ঞানী কার্ল গুস্তাভ ইয়ুংয়ের। ঋত্বিকের এই ছবিতে মায়ের প্রত্নপ্রতিমা ছাড়াও ইয়ুংয়ের ‘মাতৃকূট’ বা মাদার কমপ্লেক্স ধারণারও প্রয়োগ ঘটেছে। এমনিতে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটিকে সরল ও মেলোড্রামাটিক মনে হলেও এটি ঋত্বিক ঘটকের বেশ জটিল মনস্তত্ত্বের ছবি।

নীতার মা যেভাবে সন্তানদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে এবং সংসার চালায়, তাতে করে নীতার ভেতর জন্ম নেয় নেতিবাচক মাতৃকূট। আর এ কারণেই সে মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। মায়ের মাতৃরূপের সঙ্গে তৈরি হয় শীতল সম্পর্ক। একই ব্যাপার আমরা ঘটতে দেখি গীতার ক্ষেত্রেও। নেতিবাচক মাতৃকূটের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অনেক নারী নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যায়, স্বার্থপর আচরণ করে এবং কখনো কখনো মাতৃরূপকে আঘাত করারও চেষ্টা করে। গীতার বেলাতে আমরা দেখি, সে বড় বোনের প্রেমিককে শুধু ছিনিয়ে নেয় না, বিয়ের পর নিজের পরিবারের সঙ্গেও দূরত্ব রচনা করে। এ ক্ষেত্রে গীতা মুখোমুখি হয়েছে দুই মাতৃরূপের। এক. জন্মদাত্রী মা, অপরজন হলো মাতৃরূপী নীতা। ইয়ুং বর্ণিত মায়ের দুই রূপ ঋত্বিক ঘটক যেন নীতা ও নীতার মায়ের ভেতর ভাগ করে দিয়েছেন। এখানেও দেশভাগের পর মাতৃভাগ! রূপক অর্থে দেশও কি এমন দুই রূপে আবির্ভূত হয় না? দেশের জন্য মানুষ রক্ত দেয়, প্রাণ উৎসর্গ করে, সেসবের প্রতিদান কি দেশ সব সময় দেয়? বরং আরও রক্ত, আরও প্রাণ বলিদানের জন্য বলতে থাকে। অপর দিকে দেশের হাওয়া-মাটি-জলের কল্যাণেই মানুষ বেড়ে ওঠে। মানুষের জাতিগত পরিচয় গঠন করে দেয় দেশ। দেশের মতোই এই বিপরীতমুখী বৈশিষ্ট্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঋত্বিকের মায়ের প্রত্নপ্রতিমা।

ঋত্বিক ঘটক (জন্ম: ৪ নভেম্বর ১৯২৫—মৃত্যু: ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬)

গীতার বেলায় মাতৃকূট যেভাবে নেতিবাচক হয়ে কাজ করেছে, কিন্তু পুরুষ হিসেবে শঙ্করের বেলায় কিন্তু একটু ভিন্ন হয়েছে। ইয়ুংয়ের সূত্র মেনেই শঙ্কর এখানে নিজেকে গৌণভাবে, নিজেকে সারাক্ষণ ছোট করে রাখে। ইয়ুং আমাদের বলেন, পুরুষ যদি নেতিবাচক মাতৃকূটের শিকার হন, তাহলে হয় সে মায়ের ব্যাপারে অত আবেগী হবে না, নয়তো সে অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠবে। মজার বিষয়, ‘মেঘে ঢাকা তারা’তে শঙ্করের এই দুটোই হয়েছে। জন্মদাত্রী মায়ের ব্যাপারে তার চরম অনাগ্রহ। কিন্তু বোন নীতা, যে মাতৃরূপে সংস্থিতা, তার ওপর সে চরম নির্ভরশীল। এমনতর উভয় আবেগ আমরা কি দেশের নাগরিকদের বেলাতেও দেখি না? দেশের প্রতি আবেগ থাকা মানুষও কি নানা কারণে দেশের প্রতি বিরাগ প্রকাশ করে না?

ইয়ুং আরও একটি ব্যাপার বলেন নেতিবাচক মাতৃকূটের ব্যাপারে। তিনি বলেন, নারীদের বেলায় কোনো কোনো নারী ‘স্ত্রীসুলভ’ বা ‘মেয়েলি’ বিষয়টিকেই অপছন্দ করে। নীতাকে আমরা কোন রূপে দেখি এই ছবিতে? নারীদের গৎবাঁধা কোনো কাজে নীতাকে আমরা দেখি না। তাকে কখনোই রান্নাঘরে দেখা যায় না। এমনকি কারও ঘরের ঘরনি হিসেবেও নয়। সে সারাক্ষণ সংসারে সব সদস্যের চাহিদা মিটিয়ে চলে, ছাত্র পড়িয়ে কিংবা চাকরি করে। এমনকি নিজের প্রেমিক সনতের হাতখরচও চালায় সে।

ইয়ুং বলেন, পুরুষ যদি নেতিবাচক মাতৃকূটের শিকার হন, তাহলে হয় সে মায়ের ব্যাপারে অত আবেগী হবে না, নয়তো সে অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠবে। মজার বিষয়, ‘মেঘে ঢাকা তারা’তে শঙ্করের এই দুটোই হয়েছে। মায়ের ব্যাপারে তার চরম অনাগ্রহ। কিন্তু বোন নীতা, যে মাতৃরূপে সংস্থিতা, তার ওপর সে চরম নির্ভরশীল।
ভাইবোন চরিত্রে অভিনয়শিল্পী অনিল চট্টোপাধ্যায় ও সুপ্রিয়া দেবী

নীতা যেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর উপস্থাপনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে চলে অবিরত। নীতার ভেতর যে কোনো মেয়েলি স্বভাব নেই, সেটি ফুটিয়ে তুলতে ঋত্বিক ঘটক নীতার বিপরীতে বসান গীতাকে। গীতাকে আমরা দেখি শাড়ি পরে সাজগোজ করতে। একটু মেয়েলি ঢঙে কথা বলতে। কিন্তু নীতা একেবারেই তার উল্টো—শান্ত ও দৃঢ়, সবার বস্তুগত চাহিদা মেটাতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু তার নিজের কোনো পরিকল্পনা নেই, নিজের ভবিষ্যৎ যেন তার বর্তমানেই আবদ্ধ। এটিও নেতিবাচক মাতৃকূটে আক্রান্ত নারী বৈশিষ্ট্যের একটি দিক। আর এ কারণেই নীতা শেষ পর্যন্ত নিজেকে আবিষ্কার করে এক অসহায় আবদ্ধ গণ্ডিতে। যেখানে তার বাঁচতে চাওয়ার আকুতি প্রতিধ্বনিত হতে থাকে কেবল।

শুধু নীতা, গীতা বা তাদের মা নয়, ঋত্বিক ঘটকের প্রায় প্রতিটি ছবিতেই আমরা নারী চরিত্রের ভেতর প্রত্নপ্রতিমার উপস্থিতি দেখতে পাই। তার কাছে নারী মাতৃরূপ, আবার দেশমাতৃকার রূপকও বটে। আর এ কারণেই তার ছবিতে নারী চরিত্ররা বিশেষ হয়ে ওঠে। ঋত্বিক এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, ‘নারীরা আমার মতে সমাজের এবং সংসারের আদ্যাশক্তি। সে জন্য আমার ছবিতে সর্বদাই নারীর প্রতি মমতা, স্নেহ এবং শ্রদ্ধার প্রকাশ রাখার চেষ্টা করেছি।’