
বাংলাদেশের রাজনীতি সব সময়ই অস্থির, অনিশ্চিত ও সংঘাতময়। আর এই অস্থিরতার পথ ধরে আমরা প্রতি দশকে একটি করে মহাদুর্যোগ নেমে আসতে দেখি।
১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ একদলীয় শাসন কায়েম করে যে গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়েছিল, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কিন্তু গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে পরবর্তী সামরিক শাসকেরা যা করেছেন, তা ব্যক্তিতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া কিছু নয়। এখনো সেই ব্যক্তিতন্ত্রের মহড়া চলছে। পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক দুর্যোগের দায় আওয়ামী লীগের হলে পরবর্তী দুর্যোগের দায় বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকেই নিতে হবে। ১৯৯৫-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মেনে এবং ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে নিজের মতো করে সাজাতে গিয়ে বিএনপি স্বেচ্ছায় মহাদুর্যোগ ডেকে এনেছিল এবং সেই ভুলের খেসারত এখনো দলটিকে দিতে হচ্ছে।
এখন জাতির সামনে কঠিন প্রশ্ন হলো, ২০১৪ সালে আরও একটি মহাদুর্যোগ অপেক্ষা করে আছে কি না? ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সামনে এখন দুটি পথই খোলা আছে, হয় তারা বিএনপির ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে, অথবা স্বখাতসলিলে নিজেরা ডুবে মরবে এবং গণতন্ত্রকেও আরেকবার ডুবিয়ে মারবে। নৌকার মাঝিই ঠিক করবেন, তিনি কী করবেন। সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন করে হেরে গেলে ক্ষমতাসীনদের লজ্জার কিছু নেই। কিন্তু ১৫ ফেব্রুয়ারির মতো প্রহসনমূলক নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও সেটি হবে চরম লজ্জাজনক ঘটনা। এত দিন তারা সেনানিবাসে জন্ম নেওয়া বিএনপি ও জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করত, সেগুলো তখন তাদের ওপরই বর্তাবে।
আসন্ন মহাদুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো, আলোচনার মাধ্যমে বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারের একটি সমঝোতায় আসা। আর সমঝোতায় আসা মানে বিরোধী দলের কাছে সরকারের কিংবা সরকারের কাছে বিরোধী দলের আত্মসমর্পণ করা নয়। আওয়ামী লীগের নেতাদের দাবি, গত সাড়ে চার বছরে তাঁরা দেশের প্রভূত উন্নতি করেছেন, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, দারিদ্র্যের হার কমেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকার অধিকাংশ নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করেছে, জঙ্গিবাদের ভয়াল থাবা থেকে দেশকে রক্ষা করেছে। নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজও শেষ পর্যায়ে। তাহলে সরকারের ভয় কিসের?
নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো কী হবে, সেটি বড় প্রশ্ন নয়; বড় প্রশ্ন হলো নির্বাচনের প্রধান দুই প্রতিযোগী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটি আস্থার পরিবেশ গড়ে তোলা। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ দৃশ্যমান কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, নিতে পারছে, তার ওপরই আগামী নির্বাচন তথা গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে।
আওয়ামী লীগ নিজেদের পরাজয় জেনেও পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেনি, এটি ইতিবাচক ঘটনা বলেই মনে করি। এর পরও জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে বিরোধী দলের যেসব সংশয় ও শঙ্কা আছে, সেগুলো দূর করার দায়িত্ব ক্ষমতাসীনদেরই। ২০০৬ সালে বিএনপি বিরোধী দলের সেই শঙ্কা ও সংশয় দূর করতে পারেনি বলেই কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকতেও নির্বাচন হয়নি। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা তুলে দেওয়ার পর শেখ হাসিনার সামনে এখন অগ্নিপরীক্ষা।
আওয়ামী লীগ যদি বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে একতরফা নির্বাচন করার চেষ্টা করে তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াতে পারে? বিএনপি ও তার সহযোগীরা সেই নির্বাচন ঠেকাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। আওয়ামী লীগ আরও অধিক শক্তি দিয়ে তাদের মোকাবিলা করতে চাইবে। তাতে দেশে মহা অরাজকতা দেখা দেবে, আরও মানুষ মারা যাবে, সম্পদ ধ্বংস হবে। অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে পড়বে।
আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা মন্তব্য করেছেন, ‘বিএনপি না এলেও যথাসময়ে নির্বাচন হবে।’ এসব কথাবার্তায় ১৯৯৬ সালে বিএনপি নেতাদের কণ্ঠস্বরই শুনতে পাচ্ছি। একতরফা নির্বাচনে সরকার বাঁচলেও গণতন্ত্র বাঁচবে না এবং আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হবে। তবে আওয়ামী লীগের নেতারা যদি এসব কথাবার্তা প্রতিপক্ষের প্রতি মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করার জন্য বলে থাকেন, তাহলে আমাদের বলার কিছু নেই। নেতারা মাঠে অনেক কথাই বলেন। কিন্তু তাঁরা যদি সত্যি সত্যি বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করার কথা চিন্তা করে থাকেন, সেটি হবে আত্মঘাতী, দেশঘাতী ও গণতন্ত্রঘাতী।
আওয়ামী লীগের নেতারা এত দিন বলে আসছিলেন, বিএনপির জন্ম যেহেতু সেনানিবাসে, সেহেতু তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে ভয় পায়। তারা ক্ষমতায় থাকার জন্য নানা অপকৌশল করে। ষড়যন্ত্র করে। জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করে। কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক
দলটির জন্ম, সেই আওয়ামী লীগ কেন একতরফা নির্বাচন করবে? কেন এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবে?
আওয়ামী লীগের সবাই নন, বরং যাঁদের পায়ের নিচে মাটি নেই, নিজের নির্বাচনী এলাকায়ও যেতে ভয় পান, তাঁরাই একতরফা কিংবা বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের কথা বলেন। এমনকি কোনো কোনো নেতা আরেক ধাপ এগিয়ে বলেন, বিরোধী দল নির্বাচনে না এলে শেখ হাসিনার সরকারই ক্ষমতায় থাকবে। কত দিন? নির্বাচন না হলে ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিলের পর এক দিনও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। তাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতেই হবেই। নির্বাচিত সরকারের কাছে করলে সেটি হতে হবে পরবর্তী নির্বাচনে যে দল জয়ী হবে, সেই দলের কাছে। কিন্তু সেই নির্বাচনে যদি প্রধান প্রতিযোগী দলটি অংশ না নেয়, তাহলে কার সঙ্গে নির্বাচন, কিসের নির্বাচন?
অনেকে অক্টোবরের পর দেশের পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। নির্বাচন হলে সেই তারিখটি ঠিকই আছে। কিন্তু না হলে আসল সংকট দেখা দেবে ২৪ জানুয়ারির পর। তখন আর সংসদ থাকবে না। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকলেও নির্বাচিত নন, অন্তর্বর্তী। সেই অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের আন্দোলন কেমন হতে পারে, অনুমান করুন।
১৯৭২ সাল ছাড়া জানুয়ারি মাসটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুখকর হয়নি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়নের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে দুজন নিহত হন। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি এরশাদের পুলিশ বাহিনী চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে গুলি চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যা করে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ একদলীয় শাসন চালু করে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দাবি, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনা-সমর্থিত সরকার জাতির ঘাড়ে চেপে বসে।
২০১৪ সালের জানুয়ারি দেশবাসীর সামনে কী অপেক্ষা করছে—মহাদুর্যোগ, না জয়োল্লাস? গণতন্ত্র বাঁচবে, না নিহত হবে?
আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা উচ্চকণ্ঠে বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করার কথা বলছেন। আমরা জানি না, যে দলটি তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, সেই দলটির নেতারা কীভাবে এ রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলতে পারেন। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল ছিল; সংবিধান অনুযায়ী খালেদা জিয়ার সরকার বিচারপতি এম এ আজিজের নেতৃত্বে একটি নির্বাচন কমিশনও গঠন করেছিল। কিন্তু তিনি নির্বাচনটি করতে পারেননি। তাঁর নিয়োগকৃত রাষ্ট্রপতি কাম প্রধান উপদেষ্টা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এতই পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা পালন করেছে, যে জন্য তাঁর প্রতি অনাস্থা জানিয়ে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছিলেন। পরবর্তীকালে কেউ কেউ সুড়ঙ্গের শেষে মাথায় আলো দেখানোর চেষ্টা করলেও সেই আলো দেখা যায়নি, দুই বছর দেশ সেনানিয়ন্ত্রিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়। বিএনপির নেতারা সেই সরকারের দায় যতই আওয়ামী লীগের ওপর চাপাতে চেষ্টা করুন না কেন, আসল দায় তাঁদেরই। কেননা, ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সব কর্মকাণ্ডের পেছনে তাঁরাই কলকাঠি নেড়েছেন।
এখন আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপির ভুল থেকে শিক্ষা নেবেন, না মহাভুলের মোহনায় নিজেদের সমর্পণ করবেন—সেটাই বড় প্রশ্ন। দলের কোনো কোনো নেতা বলার চেষ্টা করছেন যে, নির্বাচন না হলে অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতায় আসবে। সেই অগণতান্ত্রিক শক্তিকে রোধ করার দায়িত্ব কার? প্রথমত এবং প্রধানত ক্ষমতাসীনদের। বিরোধী দল কোথাও বলেনি যে তারা নির্বাচনে যেতে অনাগ্রহী। তারা নির্বাচন বানচাল করতে চায়—এমন দাবি খোদ আওয়ামী লীগও করেনি।
নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, আওয়ামী লীগের নেতারা ততই অস্থির হয়ে উঠেছেন। কিন্তু কেন? তারা কেন জনগণের ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না? বিরোধী দল তথা বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামী গত সাড়ে চার বছর রাজপথে আন্দোলন করে যে ক্ষতি করতে পারেনি, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে আওয়ামী লীগের কয়েকজন মন্ত্রী-নেতা। দলে গোলাম মাওলা রনিদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। তাঁদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না?
আওয়ামী লীগের উচিত নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে একটি সমঝোতায় এসে বাকি সময়টা দল গোছানো ও সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর প্রতি নজর দেওয়া। নির্বাচন নিয়ে যত অনিশ্চয়তা থাকবে, ততই জনমত সরকারের বিপক্ষে যাবে। মানুষ আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা হারাবে।
১৯৯৬ সালে একতরফা নির্বাচন করে বিএনপি ধিক্কার ও নিন্দা কুড়িয়েছিল, সেই একই কাজ কেন আওয়ামী লীগ করবে? নিজের পায়ে কুড়াল মারার খেসারত কেবল দল নয়, গোটা দেশকেই দিতে হবে।
এখনো সময় আছে। রাজনীতির ঝগড়া এখন চুলোচুলিতে ঠেকেছে। দুই নেত্রীই চুল নিয়ে কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সংবিধান থেকে একচুলও নড়বেন না। বিরোধী দলের নেতা বলেছেন, বাতাসে চুল কেন, সবই উড়ে যাবে।
নেত্রীরা চুল নিয়ে যতই চুলোচুলি করুন না কেন গণতন্ত্র ও দেশটা যেন বাঁচে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net