
‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত, আমার নয়ন দুটি জলে ভাসত আর ভালোবাসত।’ আমি যখন সৈয়দ আব্দুল হাদীর কণ্ঠে এ গান রেডিওতে শুনেছি, তখন বুঝিনি গানটির ভাবের গভীরতা। যখন বুঝলাম তখন ভাবলাম, আহা, কি গান! এমন গান বাংলাদেশে, কে সেই বিখ্যাত সুরকার? গানের সুর অনেকেই করেন, কারও কারও সুরের গান দেশ-কাল-সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বজনীন ও কালজয়ী হয়ে যায়। যিনি সুর করেন তাঁকে সুরকার বলা হয়, গানের সুর যদি শিল্পের পর্যায়ে পড়ে, তখন সেই সুরকারকে সুরশিল্পী, সুরস্রষ্টা বলা হয়। প্রয়াত সুরকার, সংগীত পরিচালক আলাউদ্দীন আলী একজন সুরস্রষ্টা ছিলেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেন নির্মিত সিনেমায় আলাউদ্দীন আলীর সুর ও সংগীত আয়োজনে সৈয়দ আব্দুল হাদী, সাবিনা ইয়াসমীন গান গাইলেই সেই সময় গানটি সাধারণত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেতেন। আলাউদ্দীন আলী নিজ কর্মগুণেই হয়েছেন স্মরণীয়। ২০২০ সালে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন সংগীতজ্ঞ আজাদ রহমান, কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর, সুরস্রষ্টা আলাউদ্দীন আলী। একই বছরে আমাদের সংগীতজগতে বারবার আঘাত! কালজয়ী মানুষদের এভাবে চলে যাওয়া আমাদের সংগীতাঙ্গনে গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করল।
১৯৫২ সালে বৃহত্তর ঢাকার মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ীর বাঁশবাড়ী গ্রামে সংগীত পরিবারে জন্ম আলাউদ্দীন আলীর। পিতা ওস্তাদ জাভেদ আলী ও ছোট চাচা ওস্তাদ সাদেক আলীর কাছে সংগীতের হাতেখড়ি। তিনি ছেলেবেলায় বেহালা বাজানোর জন্য অল পাকিস্তান চিলড্রেনস প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছিলেন। আলাউদ্দীন আলীর প্রয়াত স্ত্রী নজরুলসংগীতশিল্পী সালমা সুলতানা, তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মিমি আলাউদ্দীনও একজন আধুনিক গানের শিল্পী। তাঁর মেয়ে আলিফ আলাউদ্দীন একজন কণ্ঠশিল্পী। সংগীতশিল্পী আবিদা সুলতানা তাঁর স্ত্রীর ছোট বোন আর সংগীত পরিচালক শওকত আলী ইমন তাঁর স্ত্রীর ছোট ভাই। সংগীত পরিচালক আলী আকবর রূপু আলাউদ্দীন আলীর বড় বোনের ছেলে।
আলাউদ্দীন আলী মূলত বেহালাবাদক ছিলেন। তিনি ষাটের দশকে বেহালা বাদক হিসেবে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন, এ ছাড়া টেলিভিশন ও বেতারে সুরকার হিসেবে নিয়মিত ছিলেন। ‘ও আমার বাংলা মা তোর’, সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া গানটি তাঁর টেলিভিশনের জন্য প্রথম সুর করা গান। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গানে শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদ ও প্রখ্যাত সুরকার আনোয়ার পারভেজের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। ‘সন্ধিক্ষণ’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার মধ্য দিয়ে আলাউদ্দীন আলী চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা শুরু করেন। এরপর তিনি ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘ফকির মজনু শাহ’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করলে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। আলাউদ্দীন আলী বাংলাদেশ চলচ্চিত্র, বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন মিলে প্রায় পাঁচ হাজার গানের সুর সৃষ্টি করেছেন। ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই’, ‘আছেন আমার মোক্তার আমার ব্যারিস্টার’, ‘আমায় গেঁথে দাওনা মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা’, ‘শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে’, ‘কি করে বলিব আমি আমার মনে বড় জ্বালা’, ‘ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়’, ‘চোখের নজর এমনি কইরা’, ‘যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে মনে হয় এ দেহে প্রাণ আছে’, ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’, ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত’, ‘সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি’, ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িত গেলাম’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো’, ‘সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারও ঘরনি’, ‘একা একা কেন ভালো লাগে না’—এই গানগুলো সুরস্রষ্টা আলাউদ্দীন আলীকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে।
‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটির সুর করেছেন প্রখ্যাত সুরকার আনোয়ার পারভেজ। গানটি তৈরির সময়ে আলাউদ্দীন আলী আনোয়ার পারভেজের সহকারী ছিলেন। আলাউদ্দীন আলীর সহকারী হলেন ফিডব্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফুয়াদ নাসের বাবু। আলাউদ্দীন আলীর সুর ও সংগীতে গান করেন সৈয়দ আব্দুল হাদী, এন্ড্রু কিশোর, কুমার শানু, সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা, মিতালি মুখার্জিসহ প্রবীণ-নবীন অনেক শিল্পী। শুধু বাংলাদেশ নয়, পাশের দেশ ভারতের অনেক বড় বড় শিল্পী পঙ্কজ উদাস, অভিজিৎ, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, অলকা ইয়াগনিকসহ আরও অনেকেই গান গেয়েছেন এই সুরস্রষ্টার সুরে। সুরস্রষ্টা আলাউদ্দীন আলী মোট আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এর মধ্যে সাতবার শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে এবং একবার সেরা গীতিকার হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন।
আলাউদ্দীন আলী ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত পরপর তিনবার সংগীতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে বিরল রেকর্ড করেন। উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ১৯৭৯ সালে মুক্তি পায় ‘সুন্দরী’, ১৯৮০ সালে মুক্তি পায় ‘কসাই’।
তিনটি সিনেমারই পরিচালক ছিলেন প্রয়াত আমজাদ হোসেন। এ তিন ছবিতে আলাউদ্দীন আলীর সঙ্গে পুরস্কার লাভ করেন সৈয়দ আব্দুল হাদী ও সাবিনা ইয়াসমীন, দুটি ছবিতে গীতিকার হিসেবেও পুরস্কার পান আমজাদ হোসেন। এ ছাড়া আলাউদ্দীন আলী উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষের কালজয়ী ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ সিনেমায় সংগীতের কাজ করেন। আলাউদ্দীন আলী বাংলা গানে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কলকাতায়ও সম্মাননা পেয়েছেন। কলকাতার ৩০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গের যুব মন্ত্রণালয় আয়োজিত কলকাতার সল্টলেক স্টেডিয়ামে আধুনিক বাংলা গানে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আলাউদ্দীন আলী, সলিল চৌধুরী, আশা ভোসলে, লতা মঙ্গেশকর, ভূপেন হাজারিকা ও রুনা লায়লাকে সম্মাননা প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে একটি সেমিনারে আমার অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছিল। উপস্থিত ছিলেন সুরস্রষ্টা আলাউদ্দীন আলী ও এন্ড্রু কিশোর। তাঁদের কথা বলতে না দিয়েই অনুষ্ঠান শেষ করে বক্তব্য দিচ্ছিলেন অতিরিক্ত সচিব মহোদয়! এতে উপস্থিত সবার আপত্তি ছিল। যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা বললেন, ‘এখানে উপস্থিত আছেন প্রখ্যাত সুরকার আলাউদ্দীন আলী ও কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর, আমরা তাঁদের কাছে রয়েলিটি ও কপিরাইট বিষয়ে কিছু কথা শুনতে চাই।’ সবাই অনেক অনুরোধ করার পর তাঁরা দুজন কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেখানে কথা বললেন এন্ড্রু কিশোর; তিনি গানের রয়েলিটি নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, ‘যদি গানের গীতিকার-সংগীত পরিচালক-সুরকার-কণ্ঠশিল্পী গানের রয়েলিটি ঠিকমতো পান, তবে তাঁদের কেউ একজন অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য অপরের দ্বারস্থ হওয়া লাগবে না। রয়েলিটি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই তাঁরা বহুবার ট্রিটমেন্ট করতে পারবেন।’
এ প্রসঙ্গে তিনি আমাদের দেশের বিভিন্ন ফোন কোম্পানি এবং এফএম রেডিওর কথা উল্লেখ করেছিলে। এ ছাড়া মিউজিক ভিডিও আর টেলিভিশনে গানের অনুষ্ঠান থেকেও গানের রয়েলিটি পাওয়া সম্ভব বলে তাঁরা মতামত ব্যক্ত করেন। আমরা কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোরের কথার বাস্তবতাও পেলাম। কিন্তু গানের রয়েলিটি প্রাপ্তির বিষয়ে সমাধান হলো কি না, বোঝা গেল না! সুরস্রষ্টা আলাউদ্দীন আলী বাংলাদেশের গানের গীতিকার-সংগীত পরিচালক-সুরকার-কণ্ঠশিল্পীর রয়েলিটি প্রাপ্তির বিষয়ে নিবেদিত হয়ে কাজ করেছেন। আলাউদ্দীন আলী অসুস্থ থাকা অবস্থায়ও তাঁর গানের রয়েলিটি দাবি করেছেন। তিনি কারও অনুগ্রহ নেওয়ার চেয়ে নিজ রয়েলিটি প্রাপ্তির দিকেই বেশি জোর দিয়েছেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, এমন দিন আসবে, তখন আর গানের রয়েলিটি না দিয়ে আর কেউ পার পাবেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, আজকের এই রয়েলিটি আন্দোলন একদিন বিপ্লবে রূপ নেবে।
সংগীত পরিবারের ছেলে স্টাইলিস্ট অভিনয়শিল্পী জাফর ইকবালকে সুরস্রষ্টা আলাউদ্দীন আলী গায়ক হিসেবেও দর্শকদের মধ্যে পরিচিত করেছেন। ‘বদনাম’ ছবিতে নায়ক রাজ্জাকের লিপে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’ জাফর ইকবালের অন্যতম একটি সেরা গান। এ ছাড়া ‘ফকির মজনু শাহ’ সিনেমায় ‘প্রেমের আগুনে জ্বলে গেলাম’ এবং আধুনিক গান ‘সুখে থাকো নন্দিনী’ গানগুলোও দর্শকদের মাতিয়েছে। উল্লেখ্য, নায়ক জাফর ইকবাল গায়িকা শাহনাজ রহমতুল্লাহ ও প্রখ্যাত সুরকার আনোয়ার পারভেজের ছোট ভাই।
আলাউদ্দীন আলী ছিলেন সংগীতের নেপথ্য নায়ক। তাঁর জীবনের প্রথম সুর করা গানটি ছিল দেশাত্মবোধক। আলাউদ্দীন আলী বাংলা ধ্রুপদি ও লোকজ গান ব্যবহার করে আধুনিক গানের এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছেন। তাঁর ছোঁয়ায় বাংলা সিনেমার গান ধন্য হয়েছে। তাঁর গান সব শ্রেণির দর্শকের হৃদয় নাড়া দিয়েছে। তবু সুরকার আলাউদ্দীন আলী নিজ কণ্ঠে ‘ফকির মজনু শাহ’ সিনেমায় গাইলেন ‘কিবা জাদু জানো বন্ধু’। সেই সময় গানটি দর্শকনন্দিত হয়েছিল।
কেউ তাঁকে কোনো দিন কথা দেয়নি। কেউ তাঁকে ভালোবাসলে তাঁর নয়ন জলে ভাসত। সময় হয়েছিল, তবু তিনি ফিরে যেতে চাননি। তবে তাঁকে যেতে হয়েছে চিঠি এসেছিল বলে! তাঁর পিঞ্জর ভেঙেছিল, তবু তিনি ডানা মেলেছিলেন। এরপরও তাঁর মতো কেউ সুখী ছিল? ভালোবাসা তাঁর কাছে জীবনের চেয়ে বড় ছিল, তাই তো তিনি বদনামের ভয় করেননি, বিনি সুতার মালা গেঁথেছেন। সুরকার ও সংগীত পরিচালক সুরস্রষ্টা আলাউদ্দীন আলী। এর বাইরে তিনি গীতিকার ও গায়ক হিসেবেও সমাদৃত। বাংলা সংগীতের সুরের এ নেপথ্য জাদুকর ৯ আগস্ট ২০২০ সালে ৬৭ বছর বয়সে ভক্তদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমান। তুমি সুরের মায়ায় বিনি সুতায় বেঁধেছ, গান দিয়ে করেছ ঋণী। ভালোবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধা সুরস্রষ্টা আলাউদ্দীন আলী; তাঁর মৃত্যু অনপনেয় ক্ষতি বাংলা সংগীতে।
লেখক: গল্পকার ও কবি fattahtanvir@gmail.com