লিটন আহম্মেদের (৪৩) বুদ্ধি আছে বটে, তবে তা ধর্ষকামী বুদ্ধি। এ রকম বুদ্ধি আছে বলেই না তিনি তাঁর কুবাসনা চরিতার্থ করতে পেরেছেন। শনিবার প্রথম আলোয় লিটনের এই কর্মের খবর প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার পোলট্রি ব্যবসায়ী লিটন আহম্মেদের বাড়িতে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবেশী এক কিশোরী বেড়াতে আসে। এ সময় লিটন ওই কিশোরীকে ধর্ষণ করেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি ধর্ষণের ঘটনা ভিডিও করে রাখেন। এরপর ওই ভিডিও ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে কিশোরীকে আরও বেশ কয়েকবার ধর্ষণ করেন তিনি। পরে কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে ঘটনাটি ফাঁস হয়।
তবে এমন বুদ্ধি শুধু লিটনের আছে, তা নয়। এমন কুবুদ্ধির পরিচয় অতীতে বহু পুরুষ দিয়েছেন। বুদ্ধি প্রয়োগ করে তাঁরা মেয়েদের সর্বনাশ করছেন। রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীর ধর্ষণের ঘটনাও ভিডিও করা হয়েছিল। ধর্ষকদের উদ্দেশ্য ছিল তাঁদের আরও কয়েক দফা ধর্ষণ করা। ধর্ষণের ভিডিও করে তা ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখানো ছাড়াও তাঁরা আরও নানা কৌশল অবলম্বন করেন। কেউ প্রাণে মেরে ফেলার বা বাবা-ভাই বা বোনকে মেরে ফেলার হুমকি দেন, কেউ বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেন। আর সেই হুমকি ধমকিতে ভয় পেয়ে আর মিথ্যা বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে বহু মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ভিডিও ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করা ছাড়াও মেয়েদের কাছ থেকে টাকাপয়সা ও স্বর্ণালংকার আদায়ের ঘটনাও ঘটেছে।
আসলে আমাদের সমাজটা এ রকম যে এখানে ধর্ষণের শিকার নারীকে সহজভাবে মেনে নেওয়া হয় না। আমাদের সমাজে ধর্ষিতা অচ্ছ্যুৎ। এমনকি নিজের পরিবারে সে নানাভাবে নিগ্রহের শিকার হয়। কোনো অবিবাহিতা মেয়ে যদি ধর্ষণের শিকার হয়, তাহলে তার ভবিষ্যতে আর বিয়ের সম্ভাবনা নেই বলেই ধরে নিতে হবে। আমাদের এমনই এক সমাজ, যে সমাজে ধর্ষণের জন্য ধর্ষককে দায়ী না করে ধর্ষিতাকেই দায়ী করা হয়। আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাচ্ছেন তথাকথিত ‘বুদ্ধিমান’ পুরুষেরা। কী মজা তাই না! সমাজের এমন মনোভাবের কারণে অনেক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলেও নীরব থাকে। সারা জীবনেও হয়তো প্রকাশ করে না যে এ রকম একটি জঘন্য ঘটনা তার সঙ্গে ঘটেছে। অনেকে এ ঘটনা মেনে নিতে পারে না। তাই জানাজানি হলে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
বিচারহীনতার সংস্কৃতিও এ ধরনের ঘটনার জন্য দায়ী। দেখা যায়, ধর্ষণের ঘটনা ফাঁস হলেও ধর্ষকের কোনো বিচার হয় না, শাস্তি হয় না। তখন ধর্ষণের শিকার মেয়েটি বা তার অভিভাবকেরা ভাবেন, কী লাভ হলো মামলা করে বা সবাইকে জানিয়ে? উল্টো গোটা সমাজ এখন তাদের অন্য চোখে দেখছে। তাই সবাই চুপ করে থাকাকেই শ্রেয় মনে করে। কিন্তু আর চুপ করে থাকা চলবে না।
ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ। এ অপরাধের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। ধর্ষণের শিকার মেয়েদের লোকলজ্জার ভয় দূর করতে হবে। ঘটনা জানাজানির ভয় না করে ধর্ষকের কুকীর্তির কথা সবাইকে জানাতে হবে। তা না হলে ধর্ষকেরা এভাবে মেয়েদের ব্ল্যাকমেল করতেই থাকবে। এ থেকে মেয়েদের নিস্তার মিলবে না। এ ক্ষেত্রে মেয়েদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তারা নীরব থেকে আরও বহু মেয়েকে ধর্ষিত হওয়ার পথকে সহজ করে দিচ্ছে। নীরবতার এ সংস্কৃতি ভাঙতে হবে। চিৎকার করুন। জানান সবাইকে। তাহলে ধর্ষকেরা সাহস হারাবে।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক