Thank you for trying Sticky AMP!!

একজন সচিব কজনের আদেশ নেবেন

অলংকরণ : মাসুক হেলাল

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্তৃত্ব নিয়ে চারজন নির্বাচন কমিশনার প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা ইউও নোট পাঠিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বরাবর। খবরের কাগজে আসা তাঁদের বক্তব্য অনুসারে কমিশনের সিনিয়র সচিব শুধু সিইসির অনুমোদন নিয়ে সচিবালয় পরিচালনা করছেন। তাঁদের মতে এ ধরনের ব্যবস্থা সংবিধান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন ও সংশ্লিষ্ট বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। একজন নির্বাচন কমিশনার সংবাদ সম্মেলন ডেকে কমিশন সচিবালয়ে স্বেচ্ছাচারিতা চলে আসছে বলে মন্তব্য করেছেন। অভ্যন্তরীণ অনিয়মের কারণে এ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম এখন প্রশ্নের সম্মুখীন বলে মন্তব্য করেছেন ওই নির্বাচন কমিশনার। তাঁর মতে, নির্বাচন কমিশন ও সচিবালয়ের মধ্যে সমন্বয় না থাকলে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

কমিশনের অভ্যন্তরে সচিবালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একটি চাপা আলোচনা-সমালোচনা চলমানই ছিল। এটার বড় ধরনের বহিঃপ্রকাশ ঘটল সম্প্রতি ৩৩৯ জন কর্মচারী নিয়োগ–প্রক্রিয়া নিয়ে। কমিশনের সচিব অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, এ ধরনের নিয়োগ–প্রক্রিয়ায় কমিশনের অনুমোদন অনাবশ্যক। তিনি সংবিধান, আইন ও বিধিবিধান মেনে নিয়োগ দিয়েছেন। এ নিয়োগ–প্রক্রিয়ার লিখিত পরীক্ষা আউটসোর্স করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষদকে। তাদের ৪ কোটি ৮ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। তবে কমিশন সচিবালয় এ নিয়োগ পর্বটি সম্পন্ন করেছে সিইসির অনুমোদন নিয়ে। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিশনের তিনিই প্রধান। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইনে কমিশনের প্রশাসনিক কাজ সিইসির তত্ত্বাবধানে সচিবেরই করার কথা। সিইসির অনুমোদন নিয়ে কাজটি হয়ে থাকলে এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন ২০০৯ এতৎসংক্রান্ত ২০০৭-এর অধ্যাদেশের অনেকটা হুবহু অনুলিপি। সে অধ্যাদেশটি প্রণয়নের সময় কমিশনে ছিলেন তিনজন। তখনো এ দিকটি নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা হয়েছে। আলোচিত হয়েছিল প্রশাসনিক কাজ কমিশনের পক্ষে সিইসির তদারকিতে সচিবের নেতৃত্বে সম্পন্ন হবে। অবশ্য নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়াদিসহ গুরুত্বপূর্ণ সবকিছু সিইসি কমিশনের যৌথ সিদ্ধান্তে হওয়ার কথা। আইনটিতে সে ব্যবস্থাই রয়েছে। এর সাংঘর্ষিক কোনো বিধি হয়ে থাকলে আইনই প্রাধান্য পাওয়ার কথা। আরেকটি সাংবিধানিক সংস্থা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সচিবালয় নিয়ে কোনো আইন নেই। সদস্য ১৪ জন। সচিবালয়ের প্রধান সচিব। তিনি কমিশন চেয়ারম্যানের নির্দেশেই কাজ করেন।

নীতিগত বিষয়াদি চেয়ারম্যান কমিশনের সামনে উপস্থাপন করে যৌথ সিদ্ধান্ত নেন। সংসদ সচিবালয়ও এভাবেই চলে। স্পিকারের নির্দেশে সচিব পরিচালনা করেন সচিবালয়। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জন্যও অনুরূপ ব্যবস্থাই যথার্থ। তবে সিইসিকে তাঁর সহকর্মীদের আস্থায় রাখতে হবে নেতৃত্বের গুণাবলি দিয়ে। তিনি সেটা না পারলে সেটি ভিন্ন সমস্যা। কিন্তু সিনিয়র সচিব যদি সিইসির কাছ থেকে আদেশ নিয়ে দায়িত্ব সম্পাদন করেন, তবে তাকে ভুলও বলা যাবে না। কোনো মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী থাকলে সরকারের কার্যপ্রণালি বিধিমালা অনুসারে মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে অন্যদের কিছু দায়িত্ব দেন। এতে দ্বৈততার কোনো সুযোগ থাকে না। আর প্রতিটি ক্ষেত্রে সবাইকে দেখিয়ে বা সভা ডেকে প্রশাসনিক কার্যাদি করা সব সময় সম্ভব হয় না।

সিইসিসহ তিনজন কমিশনার এবং তিন শতাধিক কর্মচারী নিয়ে চলছে বিশাল ভারতের নির্বাচন কমিশন। আমরা এরই মধ্যে কমিশনের জনবল উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারণ করে ফেলেছি। বলা হয়, যেহেতু আমলাতন্ত্রে দলীয়করণ হয়ে গেছে, তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কমিশনের লোকেরাই নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেন। কিন্তু কমিশনের বিরুদ্ধে যখন পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ার অভিযোগ আসে, তখন তার কর্মচারীরা কীভাবে নিরপেক্ষ থাকতে পারেন এটা বোধগম্য নয়। বাস্তব ক্ষেত্রেও তাই দেখা গেছে। আর সিইসিসহ পাঁচজন কমিশনারের সারা বছর কী কাজ তাও ধারণা করা যায় না। বলা হয় সব নির্বাচন কমিশনের আওতায় অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু একজন সিইসি দিয়েও তো কমিশন চলেছিল।

গেল নির্বাচনগুলোতে যেসব অনিয়ম সবার দৃষ্টিগোচর হয়েছে, আলোচিত হয়েছে দেশ-বিদেশে, তা কি এই প্রতিবাদী নির্বাচন কমিশনারদের নজরে আসেনি? আমরা তো এ ধরনের কোনো বিষয় নিয়ে একটি ইউও নোট চালাচালিও লক্ষ করিনি। সেসব নির্বাচনের গোটা ব্যাপারটি কি সিইসির একক নিয়ন্ত্রণে ছিল? নিশ্চয় নয়। তাহলে জনমনে যেসব বিষয় নিয়ে গভীর সংশয় তার দায়ভার অন্য কমিশনারদের ওপরেও বর্তায়। উল্লেখ্য, যে সংবিধানের আলোকে তাঁরা কর্তৃত্ব দাবি করছেন, সে সংবিধান তাঁদের পদপদবিকে সুরক্ষিত করেছে। এ সুরক্ষিত বলয়ে থেকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবাদ আসা খুবই সংগত ছিল। তবে এর মানে এই নয় যে কমিশনে এখন কোনো অনিয়ম হলে তাঁরা প্রশ্ন করতে পারবেন না। তবে সত্যি বলতে বিগত নির্বাচনগুলো নিয়ে তাদের কার্যক্রমে সবাই হতাশ। যা কিছুই হোক আমরা একটি সুসংগঠিত নির্বাচন কমিশন চাই। সামনেই ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এগুলো যথাযথ হলে আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনব্যবস্থা থেকে কিছুটা পরিত্রাণ মিলবে। সুড়ঙ্গের অপর দিকে আলোর রশ্মি দেখার অপেক্ষায় আছি আমরা।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সব কাজ নির্বাচন কমিশনের আওতাভুক্ত অবশ্যই। তবে কমিশনের পক্ষে প্রশাসনিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে সিইসি সে মৌলিক দায়িত্ব পালন করেন। এমনকি কমিশন সচিবালয়ের অনেক কিছুই উপসচিব-যুগ্ম সচিব পর্যায়েও নিষ্পত্তি হয়ে যায়। সচিব পর্যায়েও আসে না অনেক কিছুই। কমিশনের অধীন আঞ্চলিক কার্যালয়সহ সংযুক্ত সংস্থাগুলোও কিছু নির্বাহী দায়িত্ব পালন করে। এটাই স্বাভাবিক। এতে কমিশনের কর্তৃত্ব খর্ব হয় না। তবে কাজের গুরুত্ব বিবেচনায় সিইসি সময়ে সময়ে কমিশনের সভায় কিছু বিষয়াদি উপস্থাপন করতে পারেন।

মূল কথা, নেতৃত্ব দেওয়ার অবস্থানে থাকার জন্য অন্য সহকর্মীদের আস্থায় রাখতে হবে সিইসিকে। তেমনি অপর কমিশনারদের সবকিছু তাঁদের আওতায় নিতে চাওয়া অনাবশ্যক। তা করলে একটি সংস্থার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়বে। অনুমোদিত জনবলের মধ্যে হলে শূন্য পদ পূরণ একটি রুটিন প্রক্রিয়া। আর একে আউটসোর্স করার প্রক্রিয়া ও এতৎসংক্রান্ত ব্যয় যথাযথ হয়েছে কি না এটা দেখার জন্য অডিট রয়েছে। আরেক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান অডিটর জেনারেলের এখানে সব কর্তৃত্ব রয়েছে। নির্বাচন কমিশনে দুর্নীতি হলে দুদকেরও তা তদন্ত করে দেখার এখতিয়ার রয়েছে। অবশ্য এ সচিবালয়ের অভিভাবক হিসেবে যখন গোটা কমিশন রয়েছে, তখন কোনো ধরনের অনিয়মে তাদের বিচলিত হওয়াকে অসংগত বলা যাবে না। তবে প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে একমত হওয়ার সুযোগ নেই। এ–জাতীয় ইউও নোট অতি গোপনীয় হওয়া সংগত ছিল। সেটি দ্রুত গণমাধ্যমে পৌঁছে দিল কারা? আর একজন কমিশনার তো প্রতিষ্ঠানটিতে বসেই কমিশনের সচিবকে প্রতিপক্ষ করে সংবাদ সম্মেলন করলেন। এটাকে স্বাভাবিক ব্যাপার বলার কোনো সুযোগ আছে কি? কমিশনের পরবর্তী সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক হতে পারত।

বর্তমান নির্বাচন কমিশন সূচনা থেকেই তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে কতটা সফল হয়েছে, তা তারা ভালোভাবে জানে। জানে দেশবাসী। অবশ্য ব্যর্থতার জন্য এককভাবে কেউ তাদেরই দায়ী করে না। একটি দেশের একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান ঠিকভাবে চলবে এমন প্রত্যাশাও কারও নেই। তা সত্ত্বেও কমিশন তাদের সামর্থ্য অনুসারে অবদান রাখুক, এমনটাই আমরা চাই। সচিব সংসদ সচিবালয়ের প্রধান এবং তিনি সিইসির কাছে দায়বদ্ধ। একজন সচিব জবাবদিহি করবেন একজনের কাছেই।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
majumderali1950@gmail.com