Thank you for trying Sticky AMP!!

একটি অপ্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রস্তাব!

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে যাচ্ছেন ৭ এপ্রিল। ভারতে বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীর সফর এমনিতেই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এবারের সফরটি আরও গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছে ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনার কারণে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ১৯৭২ সালের মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তিতে প্রতিরক্ষা সমঝোতা-সম্পর্কিত কিছু বিধান ছিল। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে তা সমালোচিত হয়েছে। এই চুক্তি ২৫ বছর মেয়াদি ছিল, এর নবায়নের সুযোগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে ছিল। তখন তা নবায়ন করা হয়নি। বর্তমানে কেন সে তুলনায় আরও জোরালো ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, তা নিয়ে দুই দেশে জল্পনা রয়েছে। এ নিয়ে অস্বস্তি ও ভীতিও রয়েছে বাংলাদেশে।
এই ভীতি অমূলক নয়। এর প্রধান কারণ প্রতিরক্ষা সমঝোতা নিয়ে অস্পষ্টতা। এ বিষয়ে সমঝোতা স্মারকে কী থাকতে পারে তার একটি ধারণা কয়েক দিন আগে একটি ইংরেজি দৈনিকে ছাপানো খসড়ায় দেখা গেছে। কিন্তু এটি কতটা বস্তুনিষ্ঠ বা এটিই চূড়ান্ত বা সবকিছু কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আবার এই খসড়ায় যা ছাপানো হয়েছে (যেমন, ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়, যৌথ টহল, প্রশিক্ষণ ও তথ্যবিনিময় প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ), তা বাংলাদেশের জন্য কতটা স্বার্থানুগ বা এটি আদৌ বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা স্মারক নিয়ে অস্বস্তির আরও কারণ রয়েছে। অতীতে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ভারত মৈত্রী ও সহযোগিতার নামে যে চুক্তিগুলো করেছে, তাতে দেশ দুটোর জন্য অবমাননাকর কিছু শর্ত ছিল। যেমন, নেপালের সঙ্গে ১৯৫০ সালের চুক্তিটিতে বলা আছে যে নেপাল ভারতের সম্মতি ছাড়া তৃতীয় কোনো দেশ থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনতে পারবে না, নেপালের প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়নে ভারত অগ্রাধিকার পাবে। ভুটানের সঙ্গে ভারতের আদি মৈত্রী চুক্তিতে অনুরূপ বিধান ছিল; ছিল এমনি বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের পরামর্শ দ্বারা ‘গাইডেড’ হওয়ার বাধ্যবাধকতাও। নেপাল সম্প্রতি চুক্তিটির কিছু সংশোধনীর প্রস্তাব করলেও ভারতের কাছ থেকে সাড়া পায়নি। অন্যদিকে ভুটানের সঙ্গে চুক্তিটি ২০০৭ সালে নবায়ন হলে তাতে বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন ও সামরিক সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে ভুটানকে অধিকতর স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে বলে যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তা-ও ভুটানের সম-অবস্থানের ইঙ্গিতবাহী নয়।
এসব চুক্তি এই সাক্ষ্য দেয় যে প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক চুক্তি করার একটি মানসিকতা ভারতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে ছিল। ভারতের সমরবিদ ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন লেখায়ও (যেমন সুব্রামানিয়াম স্বামী, ভবানী সেনগুপ্ত) এর প্রতিফলন দেখা যায়। নেপাল ও ভুটানের তুলনায় বাংলাদেশ বহু দিক দিয়ে শক্তিশালী একটি রাষ্ট্র, এ দেশ দুটোর তুলনায় বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসও বহুগুণে গৌরবদীপ্ত ও মর্যাদাকর।
কিন্তু তাই বলে তুলনামূলকভাবে প্রতিকূল কোনো প্রতিরক্ষা সমঝোতায় বাংলাদেশকে রাজি করানোর মতো প্রভাব ভারতের নেই, তা বলা যাবে না। বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব বর্তমানে বহু গুণে বেড়েছে, অন্যদিকে কমেছে দুর্বল ম্যান্ডেটের সংকটে থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের দর-কষাকষির ক্ষমতা। সম্প্রতি চীন থেকে বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনার পর ভারতের অসন্তুষ্ট হওয়ার যে খবরাখবর ভারতের পত্রপত্রিকাতেই পাওয়া যায়, তাতে ভারতকে শান্ত করার একটি মনোভাবও সরকারের মধ্যে কাজ করতে পারে। এই পরিস্থিতিতে সুযোগ গ্রহণ করার মতো চেষ্টা ভারতের নীতিনির্ধারকদের রয়েছে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতা স্মারক তাই বাংলাদেশের জন্য
কতটা স্বার্থানুগ হবে, তা নিয়ে বাংলাদেশের মধ্যে অস্বস্তি থাকা স্বাভাবিক।

২.
গতকালের প্রথম আলোর সংবাদ অনুসারে বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি নিয়ে যে সচেতন রয়েছে, তার কিছু আলামত পাওয়া যায়। এতে ভারতের চাপে কোনো চুক্তি করতে রাজি না হয়ে শুধু সমঝোতা স্মারকের প্রতি বাংলাদেশের সম্মতি রয়েছে বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক চুক্তি আইন অনুসারে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) চুক্তির (অ্যাগ্রিমেন্ট/ট্রিটি) তুলনায় অনেক দুর্বল একটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। চুক্তির তুলনায় সমঝোতা স্মারক পালনের বাধ্যবাধকতাও অনেক কম।
তবে সমঝোতা স্মারক তাই বলে ছুড়ে ফেলার মতো বিষয় নয়। এতে যেসব বিষয় থাকার কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে বহু প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। যেমন এতে ভারত থেকে অস্ত্র আমদানির কথা বলা হয়েছে। ভারত ঐতিহাসিকভাবে মূলত একটি অস্ত্র আমদানিকারক দেশ, রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে এর আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বড় নয়। তুলনামূলকভাবে উন্নত চীনা অস্ত্র ও সরঞ্জামে সজ্জিত বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য ভারতের অস্ত্র কেনার এই বাধ্যবাধকতা কেন থাকবে তাহলে দুই দেশের সমঝোতায়?
সমঝোতা স্মারকে দুই পক্ষের প্রশিক্ষণ, সামরিক পর্যবেক্ষক, প্রশিক্ষণ, প্রতিরক্ষা তথ্যবিনিময়ের কথা বলা হচ্ছে। অতীতে চুক্তি থাকার পরও নদীর পানির মতো ‘নিরীহ’ তথ্যবিনিময়ে ভারতের সহযোগিতা পাওয়া যায়নি, যদিও বাংলাদেশ ভারতের দাবি অনুসারে বহু তথ্য দিয়েছে। এমন অবস্থায় তথ্যবিনিময় বাংলাদেশের জন্য অনুকূলভাবে ব্যবহার করা কখনো সম্ভব হবে কি? প্রশিক্ষণ বিনিময় প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ও আরও নিয়মিতকরণের ক্ষেত্রে দুই দেশের প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক নীতির স্বাতন্ত্র্যের কথা বিবেচনায় নেওয়া হবে কি? তুলনামূলকভাবে বহু গুণে শক্তিশালী ভারতের সঙ্গে ভবিষ্যতে কোনো বৈরিতা হলে এসব বিষয়ে সমঝোতা বাংলাদেশের জন্য কি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে না?
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীনতার এত বছর পর ভারতের সঙ্গে এ ধরনের একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা স্মারক কেন বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন হতে পারে? বাংলাদেশের নিরাপত্তাঝুঁকি (যুদ্ধ বা সীমান্ত সংঘাত বা এক দেশের মাটিতে অন্য দেশের উগ্রবাদীদের আশ্রয় প্রদান) রয়েছে আসলে কোন দেশ থেকে? এই সমঝোতা স্মারক যদি মূলত ভারতের স্বস্তি ও স্বার্থের জন্যই প্রয়োজন হয়, তাহলে বাংলাদেশ বিনিময়ে কী পাচ্ছে? ভারত থেকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে ভারতেরই অস্ত্র কেনা বাংলাদেশের জন্য কতটুকু স্বার্থানুগ হতে পারে না। বাংলাদেশ তাহলে কী পাচ্ছে বিনিময়ে?

৩.
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে লেনদেনের অজস্র বিষয় রয়েছে। বাংলাদেশের স্থলসীমান্ত প্রায় পুরোটাই ভারতবেষ্টিত। ফলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বহু বিষয় রয়েছে, যা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে নেই, থাকা সম্ভবও না।
কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ স্বার্থ সম্পর্কে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি কয়েক দশকেও; বরং ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মূলত ভারতের জন্য সহায়ক হয় এমন আরও বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, ভারত এর উপযুক্ত প্রতিদান দেয়নি। শেখ হাসিনার সরকার বিএনপির আমলে বাংলাদেশে নিরাপদে থাকা ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে কঠোরভাবে দমন করে ভারতের নিরাপত্তাঝুঁকি বহুলাংশে দূর করেছে। ভারতকে অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদানের জন্য বাংলাদেশের স্থলভূমি ও বন্দর ব্যবহার করতে দিয়েছে, ভারতের প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের বাংলাদেশে প্রায় অবাধে উপার্জনমূলক কর্মকাণ্ড করতে দিয়েছে, কম মাশুলে ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, ভারতের সঙ্গে অসম বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছে, আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কূটনীতি বজায় রেখেছে।
বিনিময়ে বাংলাদেশের সামনে এক তিস্তা চুক্তির প্রলোভন জিইয়ে রাখা হয়েছে বহু বছর ধরে। এই চুক্তি না হওয়ার জন্য শুধু পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দোষারোপ করার একটা প্রবণতা বাংলাদেশেও রয়েছে। কিন্তু এটি আসলে ঠিক নয়। তিস্তার পানির বিষয়ে ভারতের সংবিধান অনুসারে মমতাকে অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করার সুযোগ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের রয়েছে (দেখুন মিজানুর রহমান খান, প্রথম আলো, ১৫ মার্চ, ২০১৭)। আমার ধারণা, ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকার গঠনে উচ্চাভিলাষী বিজেপি এই চুক্তি করতে উদ্যমী হচ্ছে না নিজের স্বার্থে। বিজেপি সরকারের কাছে বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য অধিকারের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভোটারের সমর্থন হয়তো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটি না হলে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের জন্য এত কিছু করার পর এক তিস্তা চুক্তিই বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখার কোনো যুক্তি নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, তিস্তা চুক্তি হলেই কি আমাদের অসম বাণিজ্য, অসম ট্রানজিট চুক্তি বা কোনো সম্ভাব্য অসম প্রতিরক্ষা সমঝোতা মেনে
নিতে হবে? না। কারণ তিস্তা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক নদীতে পানি পাওয়া আন্তর্জাতিক নদী ও পরিবেশ আইন এবং ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তি অনুসারে আমাদের ন্যায্য অধিকার। একইভাবে সীমান্ত বাংলাদেশের নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তার গ্যারান্টি পাওয়া জাতিসংঘ সনদ অনুসারে আমাদের ন্যায্য অধিকার। আর ভারত ট্রানজিট, নৌ ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার, কানেকটিভিটি বা প্রতিরক্ষা সহযোগিতার যেসব বিষয়ে আগ্রহী, তা কোনো বিচারেই অধিকার নয়। এসব অন্য দেশের সঙ্গে বড়জোর সমঝোতার শর্তে প্রত্যাশিত সুবিধা মাত্র।
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ভারত বন্ধুত্বের কথা বলে বিভিন্ন সুবিধা নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার দেয়নি অনেক ক্ষেত্রে। এসব অধিকারের প্রতি যুগের পর যুগ ধরে কর্ণপাত না করা একটি দেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা বা নতুন নতুন আরও বিভিন্ন সমঝোতায় উদ্বিগ্ন হওয়া তাই অন্ধ ভারতবিরোধিতা নয়, যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া মাত্র।
বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার বহন করা আমাদের প্রধানমন্ত্রী কি ভারতকে এটি বোঝাতে পারবেন তাঁর আগামী সফরে? পারবেন ভারতের সঙ্গে একটি ভারসাম্যমূলক স্বার্থসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পথে এগোতে? যদি পারেন তাহলে বাংলাদেশের আরও বহু মানুষের কাছে তিনি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হবেন।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।