উদয়ের পথে শুনি কার বাণী-৯২

এ কে লুৎফর রহমান

শহীদ বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, শিক্ষানুরাগী, ক্রীড়া অনুরাগী ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম

এ কে লুৎফর রহমান
এ কে লুৎফর রহমান

ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের (বর্তমানে সরকারি) হিসাববিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন এ কে লুৎফর রহমান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের নিয়াজ পার্কসংলগ্ন কাউতলী মহল্লার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।

পরবর্তীকালে স্কুলটি তাঁর নামেই নামকরণ করা হয়। শুধু শিক্ষানুরাগীই নন, ক্রীড়া অনুরাগীও ছিলেন।

নিয়মিত ক্রিকেটের ধারাভাষ্য শুনতেন, খেলার খবরাখবরও রাখতেন বিস্তর। কলেজের শিক্ষার্থীদেরও প্রিয় ছিলেন।


তাঁর দুর্বলতা ও ভালোবাসা ছিল ছয় দফা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি। পরোপকারে ছিলেন অকুণ্ঠ।

প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে কতজনকে যে তিনি কত সাহায্য করেছেন, তা কেউ জানে না। বন্ধুবৎসল হিসেবেও তিনি ছিলেন সমধিক পরিচিত।

আড্ডায় তুলনাহীন। আড্ডা দিতে দিতে কারও সঙ্গে মতানৈক্য বা বিবাদ হয়ে গেলে, তাঁকে বাসায় নিয়ে গিয়ে না খাইয়ে ছাড়তেন না।

ধর্মপ্রাণ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। প্রতিদিন নামাজ আদায় করতেন নিয়মিত।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এ কে লুৎফর রহমান ভারতে গিয়েছিলেন।

কিন্তু কিছুদিন পর আবার দেশে ফিরে এসেছিলেন। ২৬ নভেম্বর পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে তাঁর বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়।

৮ ডিসেম্বর সেনারা তাঁকে হত্যা করে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত হওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করে।
এ কে লুৎফর রহমানের সহকর্মী কবি আসাদ চৌধুরীর ‘আমার সহকর্মী’ রচনা থেকে এ ঘটনা ও তাঁর সম্পর্কে জানা যায়।

তিনি লিখেছেন, ‘আমি ১৯৬৪ সালের ১ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি।

সে সময় তিনি ছিলেন বাণিজ্য বিভাগের প্রধান। অত্যন্ত হাসি-খুশি আমুদে মেজাজের মানুষটি ছিলেন সত্যি দিলখোলা, পরোপকারী।

চাঁদার জন্য তাঁর কাছে গিয়ে কেউ খালি হাতে ফিরে এসেছেন, এ রকম ঘটনা আমার জানা নেই।

ভালো-মন্দ খেতে ভালোবাসতেন, খাওয়াতে বোধ হয় আরও বেশি ভালোবাসতেন।
‘কথা বলতেন বেশ জোরে জোরে।

হাসতেন আরও জোরে। গুছিয়ে ইংরেজি বলতে ভালোবাসতেন। আসর জমিয়ে রাখতেন। এমনি ব্যক্তিত্ব কিছুক্ষণের মধ্যে সহজেই বিশিষ্ট হয়ে পড়তেন।

বিত্ত ছিল, চিত্ত ছিল, প্রতিপত্তি ছিল—মানুষটি ছিলেন নিতান্ত সাদাসিধে। তিনি আমার কাছে বিভিন্ন ধরনের বই চাইতেন।

এসব তিনি ছাত্রদের দিয়ে দিতেন। মাঝেমধ্যে পরীক্ষার ফি দিতে পারছে না, সেসব ক্ষেত্রেও তাঁকে চাঁদা দিতে হতো।

এই দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ বোধ হয় বিরল হয়ে আসছে।


‘মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আগরতলা চলে গিয়েছিলেন। তাঁর বাবা-মা, পরিবারের অন্যান্য সদস্য বাড়িতে—ছাত্রদের, নেতাদের, মুক্তিযোদ্ধাদের অনুরোধ উপেক্ষা করে, না বলেই তিনি ফিরে এসেছিলেন।

তবু মুক্তিযোদ্ধারা, স্থানীয় প্রতিরোধকারীরা তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। উৎসাহ ও প্রয়োজনীয় আশ্রয় তাঁরা পেতেন।


‘তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলাম কলকাতায়। তারিখ মনে নেই, তবে ভারত, ভুটানের স্বীকৃতি দেওয়ার পরের ঘটনা।

আমি সে সময় গাফ্ফার ভাইয়ের (আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী) বাসায় ছিলাম।

তিনি রাতে এসে বললেন, “তোমাদের কলেজের কয়েকজন অধ্যাপককে পাকিস্তানি আর্মি গুলি করে মেরেছে।”

আমি হুমড়ি খেয়ে পড়লাম আনন্দবাজার পত্রিকার ওপর। যদি চেনা যায়। পরে ব্রজেনদার (ব্রজেন্দ্র কুমার দাস) কাছে শুনেছি, ২৬ নভেম্বর পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়।

জেলখানা থেকে ৬ ডিসেম্বর তাঁকে মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ৮ ডিসেম্বর হত্যা করার উদ্দেশ্যে বন্দীদের গাড়িতে তুলে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়।

গাড়িটি তাঁর বাড়ির কাছে আসতেই তিনি চেঁচিয়ে বলেছিলেন। “আম্মাগো, আমি দেশের জন্যে প্রাণ দিলাম।

আমার জন্য দুঃখ করবেন না।” বাক্য শেষ হয়নি—এক সৈন্য রাইফেল দিয়ে আঘাত করল। যখন গাড়ি থেকে নামছেন, তখন হাতের বাঁধন খুলে গিয়েছিল।

তাঁর সঙ্গী বললেন, “চলুন, পালাই।” সেই সঙ্গী পালিয়ে বাঁচলেন। তিনি সে চেষ্টা করেননি।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, প্রথম খণ্ড, সম্পাদনা রশীদ হায়দার, প্রকাশ ১৯৮৮)।


এ কে লুৎফর রহমানের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১১ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের নিয়াজ পার্ক রোডের (মহল্লা কাউতলী) বাসায়।

বাবা খানবাহাদুর কাজী আবু জামান, মা মেহেরুননেছা। ১৯৫৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক, ১৯৫৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইকম পাস করেন।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকম (অনার্স) ও এমএ পাস করেন। অবিবাহিত ছিলেন।
স্বাধীনতার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ তাঁর নামে নামাঙ্কিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। পরে বিজ্ঞান ভবন তাঁর নামে নামকরণ করা হয়।

প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (পঞ্চম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৬) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।
rashedtr@prothom-alo.info