ডোনাল্ড ট্রাম্প, হোজ্জার মিথ্যা এবং ভয়ের ঘোড়া

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় আক্ষরিকভাবেই এক কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারকে বাড়ি ছাড়তে হবে। সেই পরিবারের প্রধানের নাম বারাক ওবামা। সাদা বাড়িটার ২০০ বছরের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে সেখানে বসবাসের সুযোগ পেয়েছিলেন। সাদা বাড়িটায় আবার সাদা পরিবার আসবে। এই পরিবারের প্রধানের নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প। (অবশ্য হিলারি ক্লিনটন জিতলেও হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা বদল ঘটতোই।) তাস খেলায় ট্রাম্প করে চমক দিয়ে জেতা যায়। ডোনাল্ড সাহেব ভয়, ঘৃণা, দম্ভের তাস ফেলে ট্রাম্প করেছেন।

ট্রাম্প শব্দের আরেকটা অর্থ হলো প্রলয়ের শিঙ্গার শব্দ। ট্রাম্পের বিজয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশের অনেক মানুষ সত্যি সত্যি বিপর্যয়ের ভয় পাচ্ছে। পুরো নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি শুধু ‘আমি’ ‘আমি’ করেছেন। ‘আমি’ এসে এই করব, ‘আমি’ এসে ওই করব, ‘আমি’ সব ঠিক করে দেব। এই ‘আমি’র মধ্যে শুনতে পাওয়া যায় একনায়কের কণ্ঠ।

ট্রাম্পের প্রধান পুঁজি হলো ‘ভয়’। তিনি অভিবাসীদের বিতাড়নের ভয় দেখিয়েছেন, মুসলমানদের নিষিদ্ধ করতে চেয়েছেন, মেক্সিকো সীমান্তে মেক্সিকোর খরচে দেয়াল তুলে মেক্সিকানদের ঠেকাতে চেয়েছেন ইত্যাদি। এগুলো ভয়ের কথা। হয়তো এসবই শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের মন জয়ের জন্য বানানো কথা। হয়তো বাস্তবে এতটা উগ্র তিনি হতে পারবেন না। এখানেও নামকরণের সার্থকতা তাঁরই। ট্রাম্প করার আরেকটা অর্থ ঠকানোর উদ্দেশ্যে বানোয়াট কথা বলা।

ভয়ের ঘোড়ায় চড়ে তিনি নির্বাচনী মাঠে প্রথম হয়েছেন। কিন্তু আসল ভয়টা তিনি দেখিয়েছেন শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান মার্কিনদের। তিনি বুঝিয়েছেন, আমেরিকা অশ্বেতাঙ্গদের হাতে চলে যাচ্ছে।

অভিবাসী ও মুসলমানরা আসতে থাকলে আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গরা আবার সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। (ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গরা আদিতে তো মূল অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের তুলনায় সংখ্যালঘুই ছিল) যুক্তরাষ্ট্রের সেন্সাস ব্যুরো ২০০৮ সালেই জানিয়েছে, ২০৪২ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে খাঁটি শ্বেতাঙ্গদের ছাপিয়ে যাবে এশীয়, আফ্রিকীয়, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপবাসী এবং আরব ও ভারতীয়রা। ২০২৩ সালের মধ্যে ১৮ বছরের নিচের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসবে আজকের সংখ্যালঘু জাতিগুলো থেকে (নিউইয়র্ক টাইমস, ১৪ আগস্ট, ২০০৮)। ২০২৪ সালের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান ভোটারদের ছাপিয়ে যাবে অশ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান, মুসলমান, ইহুদি, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসী ভোটাররা (ওয়াশিংটন পোস্ট, ১৫ আগস্ট, ২০১৬)। বর্তমানে আমেরিকায় অ-হিস্পানিক শ্বেতাঙ্গ জনসংখ্যা ৬৩.৭ শতাংশ।

ট্রাম্পের অবিশ্বাস্য বিজয়ের পেছনে কাজ করেছে এই বর্ণবাদী ভয়। আর এই ভয়ের পরিসংখ্যান ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গণমাধ্যমে, টেলিভিশনে, রেডিও ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

এই ভয়ের জুজু খাড়া করা হয়েছে আসল ভয়টা ঢাকতে। বড় বড় করপোরেশন, ওয়াল স্ট্রিটের জুয়াড়ি, অস্ত্র ও তেল কোম্পনি, প্রতাপশালী ইহুদি লবি, রিয়েল এস্টেট কোম্পানি এবং বড় বড় ব্যাংকের গণবিরোধী নীতির খেসারত দিয়েছে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক শ্রেণিসহ জনগণের বড় অংশ। ২০০৮-এর অর্থনৈতিক ধসের জন্য দায়ী ছিল ওয়াল স্ট্রিটের বণিকেরা, যার ধাক্কায় অনেকেই বাড়ি-গাড়ি সহায় হারিয়েছিলেন। সেই ধাক্কা এখনো অনেকে কাটাতে পারেননি। কিন্তু হিলারি বা ট্রাম্প কেউ এদের সরাসরি দায়ী করেননি। যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা আমেরিকার অর্থনীতি ও সমাজে অস্থিরতা তৈরি করেছে, তা বদলানোর কথা তোলেননি। বার্নি স্যান্ডার্স চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু শক্তিশালী পুঁজিবাদী লবি তাঁকে সরিয়ে এনেছে হিলারি ক্লিনটনকে।

এই অবস্থায় শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী একটা সমাধান চেয়েছিল। তারা জানতে চেয়েছিল শত্রু কে? চাতুরী ও মিথ্যাচার দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকৃত শত্রুকে আড়াল করে তৈরি করলেন এক ‘অপর’—যারা আমাদের মতো না। যুদ্ধবাজ জর্জ বুশ যেমন বলেছিলেন, ‘ওরা আমাদের জীবনধারা ধ্বংস করতে চায়’। ট্রাম্পও সেই ‘ওরা’কে নিশানা করলেন। সেই ‘ওরা’ অভিবাসী, মুসলমান, তাদের গায়ের রং কালো বা হলুদ। এভাবে ‘আমরা’র বিপরীতে ‘অপর’ বানিয়ে সেই অপরকে সব সমস্যার কারণ বানিয়ে হিটলারও ক্ষমতা দখল করেছিলেন। দুনিয়াজুড়ে আমরা যে ডানপন্থার উত্থান দেখছি, তাদের সবার কৌশল এই সাম্প্রদায়িক বর্ণবাদী কায়দায় ‘শত্রু’ নির্মাণ। অপরের বিপরীতে তারা একটা ‘আমরা’র দুর্গ তৈরি করতে চায়। সেই দুর্গের ভেতরে ‘আমরা’ নিরাপদ থাকব বলে জনগণের অধিকার কাটা হয়, আরও আরও কর বসানো হয়, দেশে দেশে যুদ্ধ চাপানো হয়। আগ্রাসী পুঁজিবাদের আবরণে নিজেকে ঢাকতে অপরকে শত্রু বানানোর খেলা খেলতেই হয়। এই খেলায় ঢাকা পড়ে যায় সিভিকো-মিলিটারি-করপোরেট ত্রিভুজ—দুনিয়ার দারিদ্র্য, যুদ্ধ, জলবায়ু ধ্বংসের সত্যিকার হুমকি।

অভিবাসী ও ভিনধর্মী ‘অপর’ ইস্যুতে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, উত্থান ঘটল বর্ণবাদী নেতা নাইজেল ফারাজের। ফ্রান্সের উগ্র ডানপন্থী নেত্রী ম্যারি লো পেন ট্রাম্পের জয়ের খুশিতে বলেছেন, ‘ওদের শেষ আমাদের শুরু’। ওরা বলতে তিনি বর্ণবাদবিরোধী গণতন্ত্রীদের বুঝিয়েছেন। ট্রাম্পের বিজয়ে বিশ্বব্যাপী ডানপন্থী নেতাদের উত্থানের ট্রাম্পেটই বেজে উঠল।

প্রথম বুশ প্রশাসনের আমলেই ‘আমরা’ আর ‘ওরা’র যুদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। বলা হয়েছিল যারা আমাদের সঙ্গে নেই তারা আমাদের শত্রু। এই আমরা হলো শ্বেত খ্রিষ্টান পশ্চিমা শক্তি।

পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমেও ছলাকলায় সভ্যতার শত্রু হিসেবে মুসলমানদের দেখাতে থাকল। তাদেরই তৈরি আল-কায়েদা/আইসিস খেলাটাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলল। ওয়ার অন টেররের নামে যে ঘৃণার সংস্কৃতি ও যুদ্ধের অর্থনীতি তারা তৈরি করেছে, সেটা এখন বৈশ্বিক রণাঙ্গনের পাশাপাশি হোম ফ্রন্টেও খেপে উঠেছে। মিয়ানমার থেকে ভারত, রাশিয়া থেকে ফ্রান্স এবং পূর্ব ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত সত্যিকার সংখ্যালঘুরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি।

রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলই বিভেদের যে আবাদ মার্কিন সমাজে করেছে, তারই ফসল তুললেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অবস্থাটা দেখে হোজ্জা নাসিরুদ্দিনের একটা গল্প মনে পড়ে যায়। হোজ্জা একবার পাড়ার যুবকদের ঠকাতে তাদের ডেকে বললেন, ‘আমিরের বাড়িতে মেজবান হচ্ছে, তোরা জানিস না?’

শুনে একদল রওনা হলো। তাদের দেখে আরেক গ্রুপও ছুটল। শেষে দেখা গেল সবাই আমিরের বাড়ির দিকে ছুটছে, যদি রাজভোগ হাতছাড়া হয়ে যায়?

হোজ্জা তখন ভাবলেন, এত লোক যখন যাচ্ছে তখন ঘটনা তো মিথ্যা হতে পারে না!

অতএব তিনিও ছুটলেন।

শত্রুকে নিজের বাইরে দেখানোর যে প্রতারণা, সেই প্রতারণায় মার্কিন শ্বেতাঙ্গ রক্ষণশীল খ্রিষ্টান ভোটাররা বিশ্বাস করেছেন। এখন আর কপাল চাপড়ে কী হবে?

ভয় হলো অন্ধকারের পথ। ভয় জন্ম দেয় ক্রোধের। ক্রোধ জন্ম দেয় ঘৃণার। আর ঘৃণা জন্ম দেয় একজন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে।