
ভারত তার পররাষ্ট্রনীতিতে সম্প্রতি নাটকীয় পরিবর্তন এনে আফগানিস্তানের তালেবানের সঙ্গে তার গোপন যোগাযোগের কথা রাখঢাক না রেখেই স্বীকার করেছে।
জুনের শুরুতে ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সেনা সরানোর প্রক্রিয়া শুরু করতেই দিল্লি তালেবানের কিছু উপদলের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছে। এর কয়েক দিন পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব প্রতিবেদনের সত্যতা স্বীকার করে একটি বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আফগানিস্তানে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ও পুনর্গঠনকাজের বিষয়ে ভারতের যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা পূরণের স্বার্থে দিল্লি আফগানিস্তানের বিভিন্ন অংশীদারের সঙ্গে যোগাযোগ ঠিক রাখছে।’
তালেবানের কোয়েটাভিত্তিক নেতৃত্ব ও কাতারে থাকা তাদের কর্মকর্তারাও এ যোগাযোগের কথা নিশ্চিত করেছেন। তালেবানের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক থাকার কথা সামনে এলে তা কাবুল-দিল্লি সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অঙ্গনে দিল্লির ভাবমূর্তি খর্ব হতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকে অল্প কিছুদিন আগেও ভারত এ খবর সবার সামনে আনতে গররাজি ছিল।
২০১১ সালে আফগানিস্তানে কয়েকজন ভারতীয় প্রকৌশলী অপহৃত হওয়ার পর তাঁদের মুক্তির বিষয় নিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দারা তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছিলেন। মূলত তখন থেকেই তালেবানের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দাদের যোগাযোগ শুরু হয়। তবে দিল্লি তালেবানের সঙ্গে কখনোই স্থায়ী সম্পর্কে জড়াতে চায়নি।
আগে ভারত তালেবানকে পাকিস্তানের ‘প্রক্সি’ ছাড়া আর কিছুই ভাবেনি। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে খুব সুবিধা পাওয়া যাবে, এমনটাও দিল্লি কখনো মনে করেনি। দিল্লি মনে করে এসেছে, তালেবানের সঙ্গে যেকোনো যোগাযোগ জঙ্গি গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে ভারতের আপসহীন অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
কিন্তু গত কয়েক বছরে দৃশ্যপটে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ইসলামিক স্টেট অব খোরাসান (আইএসকে) নামের একটি নব্য সশস্ত্র সংগঠনকে আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারে বাধা দিতে ২০১৫ সালে রাশিয়া ও ইরান তালেবানকে সহায়তা দিতে শুরু করে। তখন থেকেই তালেবান আফগানিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে শুরু করে এবং এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তারা বৈঠক করে। তালেবান যে আফগানিস্তানের একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে, তা এখন সবাই মানছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে যে তালেবান কাবুল দখল করতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আপাতত ভারত চাইছে তালেবানের যে অংশগুলো আফগানিস্তানে পাকিস্তান ও ইরানের হস্তক্ষেপকে পছন্দ করে না, সেই গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে দোহায় একটি আন্ত–আফগান শান্তি বৈঠক হয়েছিল। সেই ভিডিও কনফারেন্সে আফগান কর্মকর্তাদের পাশাপাশি তালেবানের প্রতিনিধিরা ছিলেন। সেখানে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করসহ বেশ কয়েকজন ভারতীয় কূটনীতিকও যোগ দিয়েছিলেন। তালেবানের প্রতিনিধিরা আছেন, এমন কোনো বৈঠকে ভারতের এ ধরনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অংশগ্রহণ সেটিই ছিল প্রথম। আসলে সেই বৈঠকের পর থেকেই পাকিস্তান ও ইরানবিরোধী ‘জাতীয়তাবাদী’ তালেবান গোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা যোগাযোগ বাড়াতে থাকেন।
পেছনের দরজা দিয়ে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করায় ভারতের লাভ অনেক। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের মাটি ছাড়ার পর সেখানে ভারতের বিনিয়োগ ও স্বার্থ যাতে সুরক্ষিত থাকে, তা নিশ্চিত করতে চাইবে দিল্লি।
এই পেছনের দরজা দিয়ে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করায় ভারতের লাভ অনেক। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের মাটি ছাড়ার পর সেখানে ভারতের বিনিয়োগ ও স্বার্থ যাতে সুরক্ষিত থাকে, তা নিশ্চিত করতে চাইবে দিল্লি। বিশেষ করে কাশ্মীর ইস্যু সামনে রেখে লস্কর-ই-তাইয়েবা এবং জয়শ-ই-মুহাম্মাদের মতো যে গোষ্ঠীগুলো ভারতবিরোধী তৎপরতা চালায়, সেই গোষ্ঠীগুলো যাতে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হামলা চালানোর ক্ষেত্রে তালেবানের মদদ না পায়, সেটি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
এ ধরনের যোগাযোগে তালেবানের লাভ আরও বেশি। ভারত সরকারের দিক থেকে তারা সমর্থন বাগাতে পারলে তাদের পক্ষে সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা মুছে রাজনৈতিক পরিচয় সামনে আনার বিরাট সুযোগ হবে। এতে তালেবানকে শুধু পাকিস্তানের সহায়তার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না।
তবে তালেবানের সঙ্গে ভারতের এ সম্পর্ক গড়ার চেষ্টাকে পাকিস্তান কীভাবে গ্রহণ করবে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান যদি সবচেয়ে ভালো আচরণ দেখায়, তাহলে তারা নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকবে। দিল্লি ও তালেবানের সম্পর্ককে তারা উৎসাহও দেবে না, নিরুৎসাহিতও করবে না। আর যদি তার উল্টো অবস্থানে যায়, তাহলে ইসলামাবাদ তালেবানকে ভারতের হাতছানি থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।
এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, পাকিস্তান বাগড়া দিলেও তালেবান ভারতের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা জারি রাখবে। কিন্তু সেই আলাপ–আলোচনা শেষ পর্যন্ত কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা দেখার বিষয়।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
আবদুল বাসিত, সিঙ্গাপুরের এস রাজারত্নম স্কুল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের একজন রিসার্চ ফেলো