যানজট হচ্ছে রাস্তার এমন এক অবস্থা, যেখানে যানবাহনের গতি কমে যায়, যাতায়াতের সময় অযাচিতভাবে বেড়ে যায় এবং যানবাহনের ‘কিউ’ বেড়ে যায় অর্থাৎ সমগ্র রাস্তা অপেক্ষমাণ অথবা ধীরগতিসম্পন্ন যানবাহনে ঠাসা থাকে। যানজট গাড়িচালকদের হতাশা এবং ‘রোড রেজ’-এ আক্রান্ত করে। রোড রেজ হচ্ছে গাড়িচালকদের রাগান্বিত আচরণ বা উদ্ধত আচরণ। রাস্তায় দুর্ঘটনার মূলত এটি অন্যতম কারণ।
সমগ্র বিশ্বে দেশ হিসেবে আমেরিকায় যানজট সব থেকে বেশি। গ্লোবাল ট্রাফিক ইনডেক্স রিপোর্ট (যা টম টম ট্রাফিক ইনডেক্স রিপোর্ট হিসেবে পরিচিত) অনুযায়ী সর্বাধিক যানজটসম্পন্ন শহর হলো তুরস্কের ইস্তানবুল শহর। টম টম প্রতিবেদন প্রধানত চারটি প্যারামিটারের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত হয়। এক. মর্নিং পিকের শতাংশ, দুই, ইভনিং পিকের শতাংশ, তিন, হাইওয়ের শতাংশ এবং চার. নন-হাইওয়ের শতাংশ। ইস্তানবুলের যানজটের মাত্রা ৫৮%, মর্নিং পিক ৭৬%, ইভনিং পিক ১০৯%, হাইওয়ে ৭৯% এবং নন–হাইওয়ে ৫০%। শহরের র্যাঙ্কিংয়ে মেক্সিকো সিটি দ্বিতীয় এবং মস্কো চতুর্থ স্থানের অধিকারী। ১৪৬টি শহরের ওপর যানজটকে কেন্দ্র করে যে বিশ্ব র্যাঙ্কিং করা হয়েছে, তাতে দেখা যায়, ৫০টিরও বেশি শহর শুধু আমেরিকাতেই অবস্থিত। তাই আমেরিকা হচ্ছে বিশ্বে সর্বোচ্চ যানজটে আক্রান্ত দেশ।
সৌভাগ্যক্রমে বলা যায়, এই ১৪৬টি শহরের মধ্যে ঢাকার নাম নেই। তাই বলে ঢাকাকে যানজটমুক্ত বলা যাবে না। তবে যানজটের জন্য অচল শহর হিসেবেও পরিগণিত করা ঠিক হবে না। যানজট সম্পর্কে আমাদের বৈশ্বিক তথ্য জানা নেই বলে নিজের দেশকে নিজেরাই ছোট করে দেখি। যানজটের নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই আছে। ২০১০ সালে মিসরের কায়রো শহরের যানজটের ওপর বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষায় দেখা যায়, কায়রোর যানজটের কারণে মিসরের ৪% জিডিপি হ্রাস পায় অথচ ঘনবসতিপূর্ণ জাকার্তায় যানজটের কারণে ইন্দোনেশিয়ার মাত্র ০.৬% জিডিপি হ্রাস পায়। বিশ্ব সমীক্ষা থেকে আরও জানা যায়, আমেরিকার সব থেকে নিকৃষ্ট যানজটের সঙ্গে আমেরিকার বৃহৎ অর্থনীতির কোরিলেশন অনেকটাই পজিটিভ। সবকিছু ছেড়ে যদি এভাবে ধরা
হয় যে ‘প্রচুর যানজট হচ্ছে এমন একটি নিদর্শন যাতে মানুষের বহু কর্মসংস্থান নিহিত’, তবে ঢাকার বাস্তবতা অনেকটা
তাই হবে।
জন নরকুইস্ট এ কারণে যথার্থই বলেছেন, যানজট হচ্ছে কোলেস্টেরলের মতো, না থাকলে আপনি মারা যাবেন আবার থাকলে ভালো অথবা মন্দ দুভাবেই থাকতে পারে। যানজটের অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে ম্যাথিয়াস সুইট যে সমীক্ষা পরিচালনা করেছেন, তাতে তিনি দেখিয়েছেন যে উচ্চতর যানজট প্রাথমিকভাবে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। তিনি দেখিয়েছেন, উচ্চতর যানজট কখনো কখনো কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইতিবাচক হতে পারে।
>যানজট অবশ্যই সামগ্রিকভাবে পরিবহন খরচ বাড়ায়। অন্যদিকে কোনো কোনো শিল্পোদ্যোক্তা যানজটের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য কার্যধারায় পরিবর্তন আনেন, এমনকি সময়সূচি এবং স্থানও পরিবর্তন করে থাকেন
যানজট তাই অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিবন্ধক কি না, সে বিষয়ে সমগ্র বিশ্বে যথেষ্ট অস্বচ্ছতা রয়েছে। এ বিষয়ে বিতর্কেরও অবকাশ আছে। আমেরিকার ৮৮টি মেট্রোপলিটন শহরের প্যানেল ডাটা নিয়ে সুইট যে সমীক্ষাটি করেছেন, তাতে এডিটির (অ্যাভারেজ ডেইলি ট্রাফিক) ভিত্তিতে মুক্ত সড়কে উৎপাদনশীলতা যেখানে হ্রাস পাওয়ার কথা, সেখানে তিনি দেখিয়েছেন যে যানজট উদ্ভূত যাতায়াতের বিলম্ব উৎপাদন বৃদ্ধির অন্তরায় নয়। তিনি আরও বলেছেন, কোনো শহরের প্রোডাকটিভিটিতে যানজটের পুশ ও পুল—দুটি প্রভাবই বিদ্যমান। তিনি অন্যত্র বলেছেন, আঞ্চলিক যানজট বিরক্তিকর কিন্তু স্থানীয় যানজট প্রত্যাশিত। অর্থাৎ আঞ্চলিক যানজট ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ÿক্ষতিকর কিন্তু স্থানীয় যানজট ব্যক্তিগত এবং করপোরেট পর্যায়ের মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি করে।
আমেরিকায় যেহেতু যানজট সর্বোচ্চ, তাই যানজটের ওপর সমীক্ষাও আমেরিকায় বেশি হয়েছে। যানজটে কেউ খুশি হয় না, বরং অসহিষ্ণু আচরণ করে, তথাপি যানজটের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক কিছুটা জটিল। যানজট মানুষের মনে স্ট্রেস সৃষ্টি করে, ডেলিভারি দেরিতে পৌঁছায়, পরিবহন খরচ বাড়িয়ে দেয়। তবু আমেরিকার সর্বোচ্চ যানজটময় শহরের অর্থনীতি অনেক সমৃদ্ধ। তাই ম্যাথিয়াস সুইট বলেছেন, ‘যানজট কোনো কোনো শহরে মন্দের তুলনায় ভালো কিন্তু অন্যান্য শহরে ভালোর তুলনায় মন্দ’—এ বক্তব্যের জটিল অংশটুকু তিনি ‘আরবান স্টাডিজ’-এ সম্প্রতি একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেছেন। তিনি যাতায়াতের বিলম্ব এবং যাতায়াতের ‘ক্যাপাসিটি’ উভয়ই পরিমাপ করেছেন। তঁার মতে, ছোট ছোট যানজট অর্থনীতির জন্য শুভ হতে পারে। আবার অপ্রয়োজনীয় হাইওয়ে অনেক সময় করদাতাদের টাকার অপব্যবহার নিশ্চিত করে।
যানজট অবশ্যই সামগ্রিকভাবে পরিবহন খরচ বাড়ায়। অন্যদিকে কোনো কোনো শিল্পোদ্যোক্তা যানজটের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য কার্যধারায় পরিবর্তন আনেন, এমনকি সময়সূচি এবং স্থানও পরিবর্তন করে থাকেন। তাই অবলীলায় বলা যায়, যানজট নানাভাবে সাপ্লাই চেইনকে প্রভাবিত করে। যেমন গতি কমিয়ে দেয়, অযাচিত বিলম্ব ঘটায়, ট্রাফিক প্যাটার্ন পরিবর্তন করতে বাধ্য করে। এগুলোর প্রতিটি ব্যবসা–বাণিজ্যকে প্রভাবিত করে। যেমন ফ্রেইট ডেলিভারি, ব্যবসার সময়সূচি বদলানো, ব্যবসার কার্যধারায় পরিবর্তন, কর্মীদের যাতায়াত এবং ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা, ব্যবসা স্থানান্তর, নানা ধরনের যোগাযোগ মাধ্যম প্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য কার্যক্রমে স্থানীয় যোগাযোগের ভিত্তিতে কাজ সম্পাদন। যানজটের এ সাতটি ফলাফল অনায়াসে সাপ্লাই চেইনকে প্রভাবিত করে। এগুলো আবার শিল্পভেদে পৃথক হয় এবং স্থানীয় অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতাকেও প্রভাবিত করে। সাপ্লাই চেইনের ওপর এদের প্রভাবকে তখন বিকল্প ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা আবশ্যক হয়ে পড়ে।
সমীক্ষায় জানা যায়, টরন্টো ও হ্যামিলটনে যানজটের বার্ষিক খরচ হচ্ছে প্রায় ৩৩০ কোটি মার্কিন ডলার। এ খরচ বাড়ার কারণ হচ্ছে বিলম্বিত যাতায়াত ও পরিবেশগত চাপ বৃদ্ধি, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি এবং সম্ভাব্য সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কা বৃদ্ধি। এ ছাড়া যে সময় মানুষের যানজটে অতিবাহিত হয়, সে সময় মানুষ উৎপাদনশীল অন্য কিছু করতে পারে। আমেরিকায় ২০০৬ সালে যানজট খরচ ছিল অর্থনীতিতে জিডিপির ২৭০ কোটি ডলার। ২০৩০ সালে এ খরচ ৭২০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
উপসংহারে বলা যায়, উন্নততর পরিবহন প্রযুক্তির বিকাশ ও প্রয়োগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে এবং একটি জাতীয় অভ্যন্তরীণ ট্রাফিক সিস্টেম প্রণয়ন করে যানজট সমস্যা দূর করা সম্ভব।
সালমা নাসরীন: এনডিসি (যুগ্ম সচিব) নির্বাহী সদস্য, বিনিয়োগ বোর্ড, ঢাকা।