একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কিংবা মৌলিক বদলের পেছনে রাজনৈতিক নেতৃত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। নেতৃত্ব হতে হবে এমন, যা দলকে ছাপিয়ে দেশের স্বার্থ বাস্তবায়নের অগ্রাধিকার নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা সেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছি, যা বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে রূপান্তরিত করতে পারে।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে ক্যারিশম্যাটিক গুণাবলির যে ধারণা বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ম্যাক্স ওয়েবার তুলে ধরেছেন, সেটি বিশ্লেষণ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ওয়েবার বলেন, যেকোনো একটি সংকট–পরবর্তী সময়ে ক্যারিশম্যাটিক চারিত্রিক গুণাবলি নিয়ে যিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বে আসবেন, তিনি দেশের মানুষের আস্থা এবং জনপ্রিয়তা অর্জনে অধিক কার্যকর হবেন।
বাংলাদেশের সংকটের সময়ে নেতৃত্ব নিয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার সুযোগ বেশ কয়েকবারই রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে এলেও তার সঠিক প্রতিদান তাঁরা দিতে পারেননি। জুলাই–পরবর্তী সময়কে আমরা সাম্প্রতিক সময়ের এক বড় উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারি।
ইতিহাসের দিকে তাকালে ’৭৫–পরবর্তী সংকট মোকাবিলায় ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের আবির্ভাব হতে দেখি জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে। বিশেষ করে দেশ পুনর্গঠন এবং দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে একটি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সব জনগোষ্ঠীকে একটি জাতীয় আকাঙ্ক্ষার পতাকাতলে নিয়ে এসে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন তিনি দেশের মানুষকে দেখাতে পেরেছিলেন।
ওয়েবেরিয়ান ধারণা অনুযায়ী, ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার পেছনে যেসব গুণ থাকা প্রয়োজন, তার অনেকটাই জিয়াউর রহমানের মধ্যে দৃশ্যমান। যেমন সততার ভিত্তিতে গড়ে তোলা নির্মোহ জীবন, ব্যক্তিক জীবনে নিয়মানুবর্তিতা এবং রাজনৈতিক আদর্শ ও দেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বাগ্রে রেখে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা ইত্যাদি।
জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সাহসিকতা এবং জেমস বার্নসের রূপান্তরমূলক নেতৃত্বের ধারণার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, যা জিয়াউর রহমানকে একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেলেও তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে সেই নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয় আমাদের দেশ।
যেকোনো সময়েই ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের উপযোগিতা অনস্বীকার্য; কিন্তু সংকটের সময়ে এ ধরনের নেতৃত্ব আমাদের দেশের জন্য অধিক জরুরি, যা আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম জুলাই গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে।
আমরা ভেবেছিলাম যে বাংলাদেশ হয়তো শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই নেতৃত্ব অর্গানিকভাবে গড়ে উঠবে, যার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশ যখন একটি ক্রান্তিকাল পার করছে, আমাদের সেই প্রত্যাশা এখনো অধরাই রয়ে গেছে।
যদিও আমরা জানি যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নেতৃত্ব কিংবা নতুন রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা পাওয়া এবং রাষ্ট্রকাঠামোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা খুব সহজ নয়। সেটি তখনই সম্ভব, যখন কোনো নেতার মধ্যে আমরা সেই ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের উত্থান কিংবা দূরদর্শী চিন্তার সমন্বয় দেখি। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, জুলাই–পরবর্তী সময়ে তেমন নেতার আবির্ভাব আমরা দেখতে পাইনি। তাই হয়তো নতুন রাজনৈতিক দলগুলো জনতার আস্থা এবং বিশ্বাস অর্জনে পিছিয়ে আছে।
আমরা যদি জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতার দিকে তাকাই, তাহলে বড় দল হিসেবে বিএনপির কথা বলতে পারি এবং একটা সময় আওয়ামী লীগের কেমন দাপট ছিল, তা আমরা জানি। তবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল হলেও দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যে একেবারে হারিয়ে গেল, সেই উপসংহারে পৌঁছানোর সময় বোধকরি এখনো আসেনি। এ দুটি দলের বাইরে তাৎপর্যপূর্ণ তৃতীয় একটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থান আমরা এখনো দেখতে পাইনি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা জাতীয় পার্টি এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কথা উল্লেখ করতে পারি।
বিএনপির রয়েছে জিয়াউর রহমানের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের ঐতিহ্য এবং খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মতো দুই প্রজন্মের নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা। বিএনপির সামনে গণপরিসরে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা চ্যালেঞ্জিং হলেও অসম্ভব কাজ নয়। সে জন্য প্রয়োজন ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে এনসিপি একটি প্রত্যাশা তৈরি করলেও, জনপ্রিয়তা এবং ভোটের রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে এনসিপির ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা আগামী জাতীয় নির্বাচনই বলে দেবে। তবে এনসিপির জনপ্রিয়তা পরিমাপের মানদণ্ড আমাদের হাতে না থাকলেও একটি নির্দিষ্ট বয়সের তরুণদের মধ্যেই তাদের অধিক জনপ্রিয়তা দেখা যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে এবং যারা তুলনামূলকভাবে শহুরে শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠীর অংশ। তাদের নেতৃত্বের মধ্যে ওয়েবেরিয়ান কিংবা কার্লাইলের নেতৃত্বের সেই গুণাবলির ছাপ জুলাই গণ-আন্দোলনের সময় দেখা গেলেও, পরবর্তী সময়ে তা ফিকে হতে শুরু করে। তবে তাদের মধ্যে সেই সম্ভাবনা যে রয়েছে, তা এখনই অস্বীকার করা যাবে না।
ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের উত্থান না হলে বাংলাদেশের প্রথাগত রাজনৈতিক ঐতিহ্য ভাঙা যে একটি কঠিন বিষয় হবে, তা বলাই বাহুল্য। আমরা অতীতে দেখেছি, নানাবিধ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে কী করে নির্বাচনের আগের দিন ভোটের সব হিসাব উল্টে যায়। এ ছাড়া রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিবারভিত্তিক রাজনীতির যে ঐতিহ্য আমরা যুগ যুগ ধরে দেখে আসছে, এখনো তাকে কেন্দ্র করেই স্থানীয় জনগণ ভোট দিয়ে থাকেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠী তাদের সেই পরিবারের বা তার পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে নিজেদের একধরনের কল্পিত এবং বর্ধিত জ্ঞাতি সম্পর্কের ভিত্তিতে যুক্ত করে দেখে। ফলে ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বকে এই ঐতিহ্য মেনে নিয়েই বেড়ে উঠতে হবে।
কাঠখোট্টা তত্ত্বীয় কাঠামোর ভেতরে দাঁড়ানো নতুন দলগুলো মূলত শহরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির তরুণদের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পেরেছে, যা একই সঙ্গে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি করে দেয়। তাদের মধ্যে তাত্ত্বিক আলাপ–আলোচনার প্রভাব বেশি থাকে, যেখানে নানা ধরনের জার্গন ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষণীয়, যা আদতে দেশের নিম্নবিত্ত কিংবা গ্রামের মানুষের মধ্যে আবেদন তৈরি করতে খুব একটা সহায়ক নয়। ফলে তাদের জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দল হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়, যা গণপরিসরে জনপ্রিয়তা তৈরি করতে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।
অপর দিকে বিএনপির রয়েছে জিয়াউর রহমানের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের ঐতিহ্য এবং খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মতো দুই প্রজন্মের নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা। বিএনপির সামনে গণপরিসরে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা চ্যালেঞ্জিং হলেও অসম্ভব কাজ নয়। সে জন্য প্রয়োজন ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব।
বুলবুল সিদ্দিকী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
*মতামত লেখকের নিজস্ব