
রাজনৈতিক নেতাদের সংগ্রাম, আত্মত্যাগ এবং কোনো কোনো সময় তাঁদের নির্বাসিত হওয়ার গল্পগুলো আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, রাজনৈতিক নেতাদের নির্বাসন ও তাঁদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন তৃতীয় বিশ্বের দেশ, বিশেষ করে যেখানে দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের উপস্থিতি থাকে, তেমন দেশগুলোতেই বেশি দেখা যায়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে যখনই কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে একটি দেশ ঝুঁকতে থাকে, তখন থেকে বিরোধী দলের প্রতি দমন-পীড়নের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে, যার মধ্য দিয়ে অনেক সময় একজন রাজনৈতিক নেতাকে নির্বাসনের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। আবার অনেকে নির্বাসনের চাপ ও ভীতি ছাপিয়ে দেশে থেকেই রাজনীতি চালিয়ে যান, যেখানে বঞ্চনা ও নিগ্রহের মাত্রা অনেক বেশি থাকে, যা আমরা বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ করেছি।
আবার কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের সময় অনেক ক্ষেত্রে স্বৈরাচারী শাসককেও দেশ থেকে বিতাড়িত বা নির্বাসিত হতে হয়, যা আমরা জুলাই-পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে দেখতে পাই। নির্বাসন যেমন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা, দেশে ফেরা বা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনও ঠিক তেমন।
কোনো রাজনৈতিক নেতা যখন এক দীর্ঘ নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে আসেন, তখন অনেক সময় তাঁকে একজন ‘নায়ক’ মনে করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে একটি মহোৎসবের মাধ্যমে বরণ করে নেওয়া হয়। যাঁরা ‘নায়কের মতো’ দেশে ফেরেন, তাঁদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকে। জনগণের কাছে তখন তিনি আশা-আকাঙ্ক্ষার এক নতুন প্রতীকে পরিণত হন।
তবে দীর্ঘ নির্বাসন থেকে ফিরে আসা ও দেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে খাপ খাওয়ানোর পথটি অতটা সহজ নয়; বরং এটি সম্পূর্ণই একটি কণ্টকাকীর্ণ প্রক্রিয়া। যেমন প্রথমেই তাঁকে জাতীয় রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর অবস্থানের পুনর্নির্মাণ ও পুনর্নির্ধারণ করতে হয়। দেশে যদি শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকে, যেমন সুশাসন, স্বাধীন বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো, তাহলে একজন নেতার প্রত্যাবর্তন গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পারে। কিন্তু দুর্বল বা অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশে প্রত্যাবর্তন অতটা সহজ না–ও হতে পারে। বিশেষ করে নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়টা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বাংলাদেশের নির্বাসিত রাজনৈতিক নেতাদের পটভূমি ভিন্ন হলেও তাঁদের প্রত্যাবর্তনের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথমেই বলা যায় ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের কথা। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন প্রথাগত নির্বাসনের কারণে না হলেও মানুষ তাঁর দেশে ফেরার বিষয়টি নিয়ে এতটাই উদ্গ্রীব ছিল যে একটি উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রত্যাবর্তন ঘটে। স্বভাবতই একটি নবীন রাষ্ট্র হিসেবে তখন বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল না। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তর করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এতটাই বেড়ে যায়, যার অবসান ঘটে ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যার ট্র্যাজেডির মাধ্যমে। এর ফলস্বরূপ শেখ হাসিনাকে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়।
তাই ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনকে দেখা হয় ’৭৫-পরবর্তী রাজনৈতিক পটভূমিতে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের পুনর্জাগরণ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলনে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তরের পথ সুগম হলেও আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে।
বাংলাদেশের স্বল্প সময়ের গণতান্ত্রিক যাত্রার পর আমাদের দেখতে হয় ১/১১-এর ঘটনাবলি, যা দেশের গণতান্ত্রিক ধারায় একটি বড় বিচ্যুতি ও মোড়বদলের মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত। সেই সরকারের সময় তারেক রহমান ৭ মার্চ ২০০৭-এ ১/১১-এর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গ্রেপ্তার হন এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। তিনি ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে গেলেও তাঁর স্বদেশে ফেরার মতো পরিবেশ ও পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, যার গঞ্জনা তিনি পরবর্তী দেড় দশকের অধিক সময় ধরে বয়ে বেড়িয়েছেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবারও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা আবারও ফিরে যাই সেই ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের দিকে, যা আমাদের ‘উপহার’ দেয় আমাদের ইতিহাসের চরম কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থার, যার অবসান ঘটে ২০২৪–এর জুলাইয়ে শিক্ষার্থী-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে।
সেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সুযোগ করে দেয় স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের। তারেক রহমানের মতো এত দীর্ঘ নির্বাসিত জীবন শেখ মুজিব কিংবা শেখ হাসিনার ছিল না। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী এমন একটি সংকটময় সময়ে তারেক রহমান দেশে আসছেন, যখন দেশের প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বলা চলে ভঙ্গুর, দুর্বল এবং রাজনৈতিক পরিবেশও অনেকটা বৈরী। দেশের মানুষ এখন রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বিভাজিত, যেটি আমাদের জন্য একটি বড় সংকট। বহুত্ববাদী সহাবস্থান এখন বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের শক্তি একক ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। এর মূল শক্তি হলো দেশের জনগণ আর সেই জনগণকে কেন্দ্র করেই সব পরিকল্পনা গড়ে তুলতে হবে। এর মধ্যে থাকতে হবে পরিবর্তনকে গ্রহণ করা এবং অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি এড়ানোর ক্ষমতা।
তবু আমরা প্রত্যাশা করব, তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন দেশ গঠন এবং একটি শক্তিশালী ও স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলনের একটি সুযোগ নিয়ে আসবে। সংকটকালীন একজন নেতা যদি তাঁর ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের গুণে দেশকে একটি সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে পারেন, তবেই তিনি দেশের মানুষের মণিকোঠায় স্থান পাবেন। তিনি কতটা অর্জন করতে পারবেন, সেটা সময়ই বলে দেবে।
যুক্তরাজ্যের মতো একটি দেশে লম্বা সময় বসবাসের মাধ্যমে তাঁর মধ্যে যে একটু সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহ ও টেকসই উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষার নানাবিধ প্রভাব পড়েছে, আমরা তার প্রতিফলন দেখি বিএনপির গবেষণাধর্মী ও তথ্য-উপাত্তভিত্তিক নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের মাধ্যমে। তবে এটাও সত্য যে রাজনৈতিক দলগুলো ইশতেহারে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে, তার যথাযথ বাস্তবায়ন আমরা খুব কমই দেখি।
তারপরও আমরা চাইব, তারেক রহমান তাঁর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বগুণে এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য ভবিষ্যতে আন্তরিক থাকবেন। একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন আমাদের সবার মনে আছে, জনগণের সেই স্বপ্ন যেন তিনি ধারণ করতে পারেন, সেদিকে তিনি ও তাঁর দল নজর রাখবে বলে আশা রাখছি।
যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, জবাবদিহি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি নিয়ে জনমনে আশা ও আগ্রহ তৈরি হয়েছে, তার বাস্তবায়নের মাধ্যমে যদি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণ করা যায়, তাহলে জনমানুষের মুখে হাসি ফুটবে। যেসব প্রথাগত রাজনৈতিক সমস্যা বিগত সময়ে আমরা সমাধান করতে পারিনি, যেমন রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, প্রতিহিংসার রাজনীতি, দুর্নীতি, লুটপাটসহ অন্যান্য অনিয়ম দূর করার ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারেন, তাহলেই হয়তো তারেক রহমান তাঁর ঘরে ফেরাকে স্মরণীয় করে রাখতে পারবেন।
আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের শক্তি একক ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। এর মূল শক্তি হলো দেশের জনগণ আর সেই জনগণকে কেন্দ্র করেই সব পরিকল্পনা গড়ে তুলতে হবে। এর মধ্যে থাকতে হবে পরিবর্তনকে গ্রহণ করা এবং অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি এড়ানোর ক্ষমতা।
সংকটের সময়ের নেতৃত্ব যেমন কঠিন, আবার এমন সময়ই একটি দেশকে বদলে দিতে গিয়ে একজন বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতার জন্ম হয়। এমন উদাহরণ বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে রয়েছে। আর তা করতে পারলেই একজন সত্যিকারের জনগণের নেতা হয়ে উঠতে পারেন। দেশকে বদলে দেওয়ার সুযোগ খুব কম নেতার জীবনেই ঘটে, তারেক রহমান নিশ্চয় সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবেন না।
বুলবুল সিদ্দিকী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
*মতামত লেখকের নিজস্ব