
বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি অসুস্থ, কিন্তু এবারের অসুস্থতা যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বর্তমানে তাঁর শারীরিক অবস্থা খুব সংকটাপন্ন। দীর্ঘদিন তাঁর অসুস্থতার কারণে তাঁর পুত্র তারেক রহমান কার্যত দলের প্রধান হলেও তিনি এখনো দলের চেয়ারপারসন। খালেদা জিয়ার বর্তমান অসুস্থতা এক অসাধারণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির নজির তৈরি করেছে।
শেখ হাসিনার পতনের পর তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করা রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে বিতর্কে নেমেছে। বর্তমান পটভূমিতে সবাই চায় তার রাজনৈতিক বয়ান যতটা সম্ভব প্রতিষ্ঠিত করতে। দীর্ঘদিন একটা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের অধীন থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা–কর্মীদের মধ্যেও একধরনের স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা দেখা গেছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই দলগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক বিতর্ক গণতান্ত্রিক পরিবেশের সীমা ছাড়িয়ে রীতিমতো কলহে রূপ নিয়েছে। একে অপরের প্রতি প্রতিদ্বন্দ্বীর মতো আচরণ না করে ক্ষেত্রবিশেষে শত্রুর মতো আচরণ করছে।
কিন্তু এমন রাজনৈতিক পটভূমিতেও প্রতিটি রাজনৈতিক দল বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি তাদের সম্মান দ্ব্যর্থহীনভাবে দেখিয়েছে। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হওয়ার পরও এমন জাতীয় অভিভাবকত্বের জায়গা অর্জন করতে পারা বাংলাদেশের মতো দেশে এক অভাবনীয় ঘটনা। সেটি হওয়ারই কথা।
শেখ হাসিনার প্রতিষ্ঠিত স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর লড়াই করেছে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন দলটি। এর মাশুল দলের অসংখ্য নেতা–কর্মীর মতো দিয়েছেন খালেদা জিয়া স্বয়ং। অত্যন্ত খারাপ শারীরিক অবস্থায়ও দীর্ঘদিন তিনি অন্যায়ভাবে জেলে আটক ছিলেন। যে অসুস্থতার কারণে তিনি আজ মৃত্যুর মুখোমুখি, সেটি বেড়ে যাওয়ার পেছনে হাসিনা সরকারের ষড়যন্ত্র ক্রিয়াশীল ছিল—এ অভিযোগও আছে।
অথচ সরকারের সঙ্গে কিছু সমঝোতা মেনে নিলে অনেক আগেই বিদেশে গিয়ে সুচিকিৎসা নিয়ে জীবিত একমাত্র সন্তানের সঙ্গে বাকি জীবন সুন্দরভাবে কাটাতে পারতেন। কিন্তু সেই পথে না গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে ভয়ংকর মাশুল দিয়েছেন তিনি, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁর এ আপসহীনতা এখন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নিয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতার পটভূমিতে আলোচনায় এসেছে তাঁর বেঁচে থাকা একমাত্র সন্তান তারেক রহমান কেন দেশে ফিরছেন না। একটি রাষ্ট্রে, সমাজে ঘটে চলা প্রতিটি বিষয়ই রাজনৈতিক। আর সেটি যদি হয় দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল, যে দলটি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে আগামী নির্বাচনে বিজয় লাভ করবে বলেই ধারণা করা হয়, সেই দলটির প্রধান নেতৃত্বের অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে তাঁর সন্তানের ফিরে আসা নিয়ে প্রশ্ন ঘিরে, রাজনীতি হওয়াটা স্বাভাবিক।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে অনেকের বক্তব্য ‘হেইট স্পিচের’ (ঘৃণা সৃষ্টিকারী বক্তব্য) পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, যা আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য অনিবার্যভাবেই ক্ষতিকর হবে।
কেন তারেক রহমান দেশে আসছেন না? কবে তিনি দেশে আসবেন?— চব্বিশের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময় থেকে প্রশ্নগুলো দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ক্রমাগত আলোচিত হয়েছে। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে মানুষ এটা ধারণা করেছিল, দীর্ঘকাল দেশের বাইরে থাকা মানুষটির জন্য এবার অনুকূল সময়ে এসেছে, তাই তিনি দেশে এসে দলের হাল ধরবেন। তাই তারেক রহমান দেশে ফেরা নিয়ে মানুষের কৌতূহল খুব স্বাভাবিক।
কিন্তু মায়ের সাংঘাতিক অসুস্থতার সময়েও দেশে ফিরে না আসাকে কেন্দ্র করে রীতিমতো তারেক রহমানের মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও কর্তব্যপরায়ণতাকেই প্রশ্ন করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি নিয়ে এতটাই হইচই তৈরি হয়েছে যে এ মুহুর্তে নিজের দেশে না ফেরার কারণ নিয়ে তারেক রহমানকে কিছু কথা বলতে হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন,“...কিন্তু অন্য আর সকলের মতো এটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমার একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। স্পর্শকাতর এই বিষয়টি বিস্তারিত বর্ণনার অবকাশও সীমিত। রাজনৈতিক বাস্তবতার এই পরিস্থিতি প্রত্যাশিত পর্যায়ে উপনীত হওয়ামাত্রই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আমার সুদীর্ঘ উদ্বিগ্ন প্রতীক্ষার অবসান ঘটবে বলেই আমাদের পরিবার আশাবাদী।”
নির্বাচন সামনে রেখে দেশে ফেরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বোঝার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিশ্চয়ই আছে তারেক রহমানের। তাঁর দেশে না ফেরা নিয়ে ওঠা প্রশ্ন তাঁকে রাজনৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, এটিও তাঁর না বোঝার কারণ নেই। এসব বিতর্ক–সমালোচনার পরও তাঁর ফিরে না আসা প্রমাণ করে, সমস্যা সমাধান করা ছাড়া তাঁর ফেরাটা বিপজ্জনক হতে পারে।
এর আগে তারেক রহমান নানা সময়ে ‘দ্রুতই দেশে ফিরবেন’ ধরনের বক্তব্য দিলেও এই প্রথম কিছুটা স্পষ্ট করলেন, তিনি কেন দেশে ফিরে আসছেন না। বলা বাহুল্য তাঁর এ বক্তব্যেও বেশ অস্পষ্টতা আছে এবং এটি আরও নতুন কিছু প্রশ্ন তৈরি করেছে। মানুষ খোঁজার চেষ্টা করছে, ‘অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়’ এমন একটা সিদ্ধান্তের পেছনে আসলে কে আছে।
প্রশ্ন এসেছে, তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ‘অপর নিয়ন্ত্রক’ কারা? তারা কি দেশি, নাকি বিদেশি? যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এর মধ্যেই প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছেন, সরকারের দিক থেকে তারেক রহমানের ফেরার পথে কোনো বাধা নেই। তাহলে এ ক্ষেত্রে কি বিদেশি কোনো শক্তি ক্রিয়াশীল, যারা তাকে বাধা দেওয়ার মাধ্যমে কোনো দর–কষাকষি করছে?
নির্বাচন সামনে রেখে দেশে ফেরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বোঝার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিশ্চয়ই আছে তারেক রহমানের। তাঁর দেশে না ফেরা নিয়ে ওঠা প্রশ্ন তাঁকে রাজনৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, এটিও তাঁর না বোঝার কারণ নেই। এসব বিতর্ক–সমালোচনার পরও তাঁর ফিরে না আসা প্রমাণ করে, সমস্যা সমাধান করা ছাড়া তাঁর ফেরাটা বিপজ্জনক হতে পারে।
তারেক রহমানের দেশে ফেরার প্রশ্নে তাঁর নিরাপত্তার ইস্যু দীর্ঘদিন থেকে আলোচিত হচ্ছে। এটা সত্যি, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভালো নয়। তিনি দেশে ফিরলে একটি দলের প্রধান হিসেবে যে নিরাপত্তা পাবেন, সরকারের পক্ষ থেকে সেটি কি যথেষ্ট হবে? দেশে ও দেশের বাইরে অনেকেই আছে, যারা তাঁর নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, বাংলাদেশের মতো দেশে নিরাপত্তাঝুঁকি থাকবেই। এ দেশে রাজনীতি করতে হলে এ ঝুঁকি মাথায় নিয়েই করতে হবে। এই সরলীকরণের বাইরে গিয়ে আমরা এটা বলতে পারি, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তিশালী হয়ে ওঠার বিপরীতে একটা মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপির অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। সেই দলের প্রধান যদি এমন কোনো পরিস্থিতিতে বড় নিরাপত্তাঝুঁকিতে পড়েন, সেটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনার ওপরে বড় আঘাত তৈরি করবে। এমনকি বাংলাদেশ খুবই দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতার মধ্যে প্রবেশ করবে—এ শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তাই এমন শঙ্কা যদি সত্যিই থেকে থাকে, সেটি বিবেচনায় নেওয়া ভুল হবে না।
দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার প্রশ্নে বিএনপি যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, সেখানে খালেদা জিয়ার বড় গুরুত্ব আছে শুধু দলের প্রধান হিসেবেই নয়, দলের ঊর্ধ্বে উঠেও। আমাদের এই গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে (নির্বাচনের আগে কিংবা পরে) যদি কোথাও কোনো শঙ্কা তৈরি হয়, কোথাও যদি সরকার, রাজনৈতিক দল কিংবা শক্তির অন্যান্য ভরকেন্দ্রের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়, সে ক্ষেত্রে জাতির অভিভাবকে পরিণত হওয়া খালেদা জিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবেন; সমঝোতার জন্য মধ্যস্থতা করতে পারবেন।
রাজনৈতিক জীবনে কিংবা সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার ছোট-বড় ভুল আছে। কিন্তু শেষ বিচারে তিনি আমাদের গণতন্ত্রের লড়াইয়ের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। তাঁর আরও বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকা এই জাতি এবং রাষ্ট্রের স্বার্থেই জরুরি। আমি নিশ্চিত, এই জাতির প্রার্থনা তাঁর সঙ্গে আছে।
জাহেদ উর রহমান শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব