বিশ্লেষণ

পশ্চিম পাঞ্জাবের স্কিম এবং পূর্ব বাংলা ও বেলুচিস্তানের সংগ্রাম

পাকিস্তানের অন্যতম বড় প্রদেশ পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকদের লড়াইটা ছিল রাজনৈতিক। সেই রাজনীতির লড়াই নিয়ে লিখেছেন আহমেদ শামীম

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ সালের পাকিস্তান কার্যকর অর্থে কোনো রাষ্ট্র ছিল না, রাষ্ট্র প্রচেষ্টা বা রাষ্ট্র-প্রকল্প ছিল মাত্র, যে প্রচেষ্টা কিংবা প্রকল্প একাত্তরে এসে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। লাহোর প্রস্তাবের সেই পাকিস্তান, যে পাকিস্তান বাঙালি মুসলমানের বড় অংশটি চেয়েছিল, তা কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। যারা সেই প্রস্তাবিত পাকিস্তান গড়ার জন্য সেই চল্লিশের দশক থেকে সংগ্রাম করেছে, তাদের সঙ্গে বেইমানি করে সাতচল্লিশ থেকেই স্বায়ত্তশাসিত পাঁচটি প্রদেশে বিভক্ত পাকিস্তানকে প্রাদেশিক কাঠামোবিহীন কেন্দ্রশাসিত রাষ্ট্র ‘পশ্চিম পাঞ্জাব’ বানানোর স্কিম শুরু হয়। কালক্রমে এই স্কিমের নামকরণ হয় ‘ওয়ান-ইউনিট স্কিম’।

ব্রিটিশোত্তর উপমহাদেশে পশ্চিম পাঞ্জাব, আফগান সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং পূর্ববঙ্গ মিলে একটি প্রদেশপুঞ্জ হওয়ার প্রস্তাব ছিল; এটা ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ হলো অন্য চারটি প্রদেশকে প্রশাসনিক বিভাগে পর্যবসিত করে পশ্চিম পাঞ্জাবের রাষ্ট্র হয়ে ওঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষা। পশ্চিম পাঞ্জাবের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের অবশ্য সেই ব্যর্থতা নিষ্ফল নয়; ফল হিসেবে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, এক. পাকিস্তান এবং দুই. বাংলাদেশ।

একাত্তর ও চব্বিশের চেতনা যে পরস্পরবিরোধী নয়; বরং ধারাবাহিকতামাত্র, তা ধরিয়ে দেওয়ার ঐতিহাসিক জ্ঞানের অভাব রয়েছে। আশা করি, শিগগিরই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ফিরে আসবে এবং বাংলাদেশের ভিত্তি মুক্তিযুদ্ধকে স্বমহিমায় জনগণ রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে একটি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্য নিয়ে।

২.

তৎকালের সব মুসলিম মেজরিটি প্রদেশই যে পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রগঠনে উৎসাহী ছিল, তা কিন্তু নয়। পশ্চিম পাঞ্জাবের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা যে কখনোই লাহোরে প্রস্তাবিত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে দেবে না, সেটি সবচেয়ে আগে আঁচ করতে পেরেছিল বেলুচিস্তানের কালাত নামের ‘প্রিন্সলি স্টেট’। কালাত ছিল বেলুচিস্তানের প্রধান প্রিন্সলি স্টেট এবং বেলুচিস্তানের অন্য প্রিন্সলি স্টেটগুলোর জিম্মাদার। কালাত মূলত বেলুচিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে চেয়েছিল শুরুতে, স্বাধীনতার ঘোষণাও দিয়েছিল।

কিন্তু পাকিস্তান আন্দোলনের চাপে, মুহম্মদ আলী জিন্নাহর সামরিক হুমকির মুখে সেই ঘোষণা ফিরিয়ে নিয়ে স্বায়ত্তশাসনের দিকে এগোয় কালাতের প্রধান নেতারা; কিন্তু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের আরেকটি অংশ তা মানতে পারেনি, তারা কালাতের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়, যা ‘ফার্স্ট বেলুচিস্তান কনফ্লিক্ট’ নামে পরিচিত।

বেলুচিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রের যুদ্ধ থেমে যায়নি। আবার শুধু বেলুচিস্তানই নয়, উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের (বর্তমান খাইবার পাখতুনখাওয়া) নেতারাও পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে চাননি। রেফারেন্ডামে পাকিস্তানের যুক্ত হওয়ার পক্ষ জিতেছে বটে; কিন্তু সেই প্রদেশে সংগঠিত রেফারেন্ডামে রিগিং অভিযোগ আছে এবং সেই রেফারেন্ডামে স্বাধীনতার অপশন ছিল না।

৩.

এদিকে পাকিস্তানের অন্যতম বড় প্রদেশ পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তৎকালের পাকিস্তানি শাসকদের লড়াইটা ছিল রাজনৈতিক। যদিও দুই বঙ্গ নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের একটা অনুচ্চ আকাঙ্ক্ষা ছিল কিছু চিন্তক-রাজনীতিকের। কিন্তু তার জন্য কোনো তৎপরতা ছিল না। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গের প্রভাবশালী নেতৃত্ব লাহোরের প্রস্তাবিত পাকিস্তানের প্রতি ‘ইমান’ এনেছিল এবং সেই ফেডারেল গণতন্ত্রে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হিসেবে যুক্ত থাকতে চেয়েছিল।

লক্ষণীয় যে পশ্চিমের চারটি প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব (পি), আফগান সীমান্ত প্রদেশ (অ্যা), সিন্ধু (করাচি, কে) এবং বেলুচিস্তানের (স্তান) নামের আদ্যক্ষর নিয়ে প্রস্তাবিত রাষ্ট্রের নাম হয় পাকিস্তান (ই স্বরটি শব্দ গঠনের সুবিধার্থে যুক্ত করা হয়। এখানে পূর্ববঙ্গের জন্য কোনো বিবেচনা ছিল না।

তবু একদিকে পূর্ববঙ্গের ভবিষ্যৎ নিয়ে দিশারি চিন্তার অভাব এবং অন্যদিকে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের ফেডারেল ও গণতন্ত্রের কাঠামোতে একটি প্রভাবশালী প্রদেশের মর্যাদা নিয়ে যুক্ত হওয়ার প্রতিশ্রুতি—এই দুই তখন পূর্ববঙ্গের নেতাদের প্রভাবিত করেছিল। জনসংখ্যার বিচারে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা, গণতন্ত্রের হিসাবে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ—এসব ছিল; স্থানিক দূরত্বের কারণেও একটা সুরক্ষার দেয়াল ছিল। সব মিলিয়ে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের আদ্যক্ষর ‘পি’কে পাঞ্জাবের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেবে বলে আশা করেছিল।

এরই অংশ হিসেবে শুরু থেকেই উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে তাই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চেয়েছিল পূর্ববঙ্গ। সেদিক থেকে বলতে গেলে পূর্ববঙ্গ ও বেলুচিস্তানের বেশ পার্থক্য আছে। বেলুচিস্তান পাঞ্জাবের সঙ্গে যৌথভাবে পাকিস্তানের শাসনের স্বপ্ন দেখেনি। তবু নির্মীয়মাণ পাকিস্তানের সঙ্গে প্রদেশগুলোর সম্পর্ক কেমন হবে, সেই সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানই বা কেমন রাষ্ট্র হবে—সেসব চিন্তা ও তৎপরতায় পূর্ববঙ্গ এবং বেলুচিস্তানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ড নানা কারণেই তুলনীয়।

এই তুলনা আমাদের একটি দৃষ্টিকোণ দেয়, যা থেকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাব, পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সংগ্রাম সাতচল্লিশ থেকেই শুরু হয়েছে; বেলুচিস্তান একভাবে আমাদের পথ দেখিয়েছে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার দিকে। বস্তুনিষ্ঠ এই ঐতিহাসিক বয়ানটি ইতিহাসের অন্তরালে হারিয়ে যাওয়ার বহু কারণ আছে। এগুলো হলো স্বাধীনতা–উত্তর আওয়ামী চিন্তকদের ১৯৪৭-৭১ পর্যন্ত তৎকালীন পাকিস্তান রেজিমের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার সংগ্রামের ইতিহাসকে আওয়ামীকরণ, জামায়াতে ইসলামীর চিন্তকদের দ্বারা সেই ইতিহাসের প্রতিক্রিয়াবশত জামায়াতীকরণ, বামপন্থী চিন্তকদের জাতিগত লড়াই নিয়ে বয়ান তৈরিতে দ্বিধা এবং বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর তরফে তৎকালীন পাকিস্তান প্রকল্পের বিষয়ে অনাগ্রহ।

ফলে তৎকালীন পাকিস্তান প্রকল্পের পেছনের চিন্তা এবং বাস্তবায়নের পথে বাধা ও ব্যর্থতা নিয়ে যথাযথ পর্যালোচনা হাজির না থাকায় আমরা যতবারই বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ধরে রাখতে হাঁপিয়ে উঠি, বাধার সম্মুখীন হই, ততবারই তৎকালের পাকিস্তান নিয়ে আমাদের একটি অংশ রোমান্টিক হয়ে যায়; নস্টালজিয়াজাত একটি বয়ান হাজির করে, যা আদতে পাঞ্জাবি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অন্য প্রদেশগুলোর লড়াইকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে চায়। এই ফ্যালাসি থেকে দূরে থাকার জন্য এই বোধটুকু মাথায় রাখা জরুরি যে প্রস্তাবিত সেই সাধের পাকিস্তান কখনোই বাস্তবে ছিল না, যা ছিল তা পাঞ্জাবি পাকিস্তান, যা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল।

ঐতিহাসিকভাবে সত্য এই যে দল–মতনির্বিশেষে পূর্ববঙ্গের জনগণ মুক্তিযুদ্ধে গেছে এবং সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের একটি বড় অংশ দলীয় আহ্বানের আগেই ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে।

৪.

সব বিবেচনাতেই ওয়ান-ইউনিট স্কিমের পাকিস্তান ছিল লাহোর প্রস্তাবে প্রস্তাবিত ফেডারেল রিপাবলিক পাকিস্তানের ওপর সরাসরি আক্রমণ। সুখের কথা হলো এই যে ওই ওয়ান-ইউনিট ‘পাকিস্তান’ নামের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব পশ্চিম পাঞ্জাব’ পূর্ববঙ্গের সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াইয়ে পেরে ওঠেনি। কেননা, জনসংখ্যার দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তান ছিল বড়। ফলে আসন সমান সমান করে পশ্চিম এবং পূর্বে ভাগ করতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি রেজিম।

তাদের শেষ ভরসা ছিল ‘পাকিস্তানের স্বাধীনতা এনে দেওয়া দল’ মুসলিম লীগ পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের ভারতের জুজু দেখিয়ে বশে রাখতে পারবে; কিন্তু সেই মুসলিম লীগের সঙ্গে শুরু থেকেই রাজনৈতিক লড়াইয়ে লিপ্ত হয় বাংলার বামপন্থী, মধ্যপন্থী, এমনকি কিছু ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী। এই দলগুলোর রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও কর্মসূচি পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গঠন ও শাসনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। ওই চিন্তাধারা ও কর্মসূচি ছিল পশ্চিম পাঞ্জাবের এলিট এস্টাবলিশমেন্টের চাপিয়ে দেওয়া এককেন্দ্রিক শাসনের বিরুদ্ধে একটি পাকিস্তান ইউনিয়নের, যেখানে প্রদেশগুলো স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে।

এই লড়াই ছিল মূলত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই। তৎকালের রাজনৈতিক ঘটনাধারা দিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগকে হারিয়ে দেশি দলগুলোর জোট যুক্তফ্রন্ট পূর্ববঙ্গের সরকার গঠনের ম্যান্ডেট লাভ করে। সেই গণতান্ত্রিক প্রাদেশিক সরকারকে দুই মাসের মধ্যেই অন্যায্যভাবে বাতিল করে দেওয়া হয়, কেড়ে নেয় পূর্ববঙ্গের প্রদেশ মর্যাদা। পাকিস্তান আন্দোলনের প্রস্তাবিত গণতন্ত্র এবং ফেডারেল কাঠামো গড়ে তোলার আগেই ভেঙে ফেলে, সেখান থেকে পাকিস্তান একটি ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ হিসেবে ১৯৫৬ সালে আত্মপ্রকাশ করে। এর দুই বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান একটি মিলিটারি–শাসিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

১৯৬২ সালে সামরিক শাসক একটি সংবিধান উপহার দিলেও তা ছিল গণতন্ত্রবিরোধী গঠনতন্ত্র। এই গঠনতন্ত্রে সেই ‘ওয়ান ইউনিট’ প্রোগ্রামের আওতায় প্রদেশগুলোর ক্ষমতা খর্ব করাটাকে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পূর্ববঙ্গীয় নেতাদের ডাকে পাকিস্তানের অন্য দলগুলো নিয়ে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) গঠিত হয়।

একই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমে বেলুচিস্তানে তৃতীয়বারের মতো সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়, যা ইতিহাসে ‘থার্ড বেলুচিস্তান কনফ্লিক্ট’ নামে পরিচিত। আইয়ুব খানের সেনাশাসনের বিপরীতে পাকিস্তানব্যাপী একটি গণতান্ত্রিক ফেডারেল পাকিস্তান গঠনের লড়াই তুঙ্গে ওঠে। জাতীয়ভাবে যেমন ফাতেমা জিন্নাহর রাজনৈতিক প্রচেষ্টা চলে পাকিস্তানকে লাহোরের প্রস্তাবের পাকিস্তান হিসেবে পেতে, একইভাবে বেলুচিস্তানের সশস্ত্র সংগ্রাম চলে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ পেতে।

এরই ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ উত্থাপন করে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা। এই ছয় দফা স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশের রাজনৈতিক দাবি। এটা কোনো সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী দাবি না, লাহোর প্রস্তাবের ধারাবাহিকতামাত্র; যেমন দাবি সবার আগে বেলুচিস্তান তুলে ছিল এবং সেই দাবি আদায় সশস্ত্র সংগ্রামেও লিপ্ত হয়েছে। অথচ আওয়ামী চিন্তকেরা মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ইতিহাসের ব্যাপ্তিকে কেটেছেঁটে নিজের স্বার্থসিদ্ধি হয় এমনভাবে সংকীর্ণ করেছে।

কৌতুকের বিষয়, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (জামায়াত) মুক্তিযুদ্ধের সেই খর্বাকৃত ইতিহাসকে গ্রহণ করে বাজারে বয়ান ছেড়েছে যে মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তান বনাম আওয়ামী লীগের গন্ডগোলের ফল, দেশের সাধারণ জনগণের এতে সায় ছিল না। যে কারণে তারা পাকিস্তান রক্ষার জন্য তৎকালীন পাকিস্তান রেজিমের সহযোগী হয়। আরও কৌতুকের বিষয় এই যে আওয়ামী লীগও একভাবে জামায়াতের এই বয়ানকে গ্রহণ করেছে। কেননা, তাতে মুক্তিযুদ্ধের ওপর তাদের একচ্ছত্র দাবির বিষয়টি অন্য বিরোধী পক্ষের দ্বারা সমর্থিত হয়।

৫.

জুলাইয়ের গণ–আন্দোলনের অংশীজনেরা মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ান ভাঙবে, এটা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু নয়। বরং নানা বিবেচনায় সমর্থনযোগ্য। কেননা মুক্তিযুদ্ধের বয়ানকে যথেচ্ছভাবে তৈরি এবং একচ্ছত্রভাবে ভোগ করার আওয়ামীচর্চা জনগণকে ত্যক্তবিরক্ত করে ছেড়েছে। তবে এ কথাও সত্য যে আওয়ামী লীগ কখনোই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের ওপর তাদের একচ্ছত্র দাবির পক্ষে সম্যক সম্মতি আদায় করতে সমর্থ হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগকে সমার্থক করার বাসনা তাদের বাসনাই থেকে গেছে। ঐতিহাসিকভাবে সত্য এই যে দল–মতনির্বিশেষে পূর্ববঙ্গের জনগণ মুক্তিযুদ্ধে গেছে এবং সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের একটি বড় অংশ দলীয় আহ্বানের আগেই ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে; এমনকি দলীয় বিবেচনাতেও দেখা যায় জনযুদ্ধে অগণিত বামপন্থী আলাদা ব্যানারে লড়েছে। স্বাধীনতার পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ অন্য অংশীজনদের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বলয়ে অংশীদার জনগণ সেই চেষ্টার বিরুদ্ধে জারি রেখেছে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তাদের আত্মিক সংযোগ।

এত কাল ধরে আওয়ামী লীগের ছড়ানো বয়ানের বিপরীতে যে মুক্তিযুদ্ধের একটা বস্তুনিষ্ঠ বয়ান তৈরির সংগ্রাম চলে আসছিল, হঠাৎ আওয়ামী লীগের দাপট ‘নাই’ হয়ে যাওয়ায় সেই সংগ্রামে কিছুটা ভাটা পড়েছে। তবে পরিহাস এবং পরিতাপের বিষয় এই যে সেই ক্লান্তির সুযোগে কিছু রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের ন্যায্যতার বিরুদ্ধে বয়ান তৈরিতে অস্বাভাবিকভাবে সক্রিয় হয়েছে।

বিষয়টি পরিহাসের এই জন্য যে আওয়ামী লীগ যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া এবং দেশগঠনে ভূমিকা রাখা অন্য শরিকদের মুক্তিযুদ্ধের শরিকানা থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের ন্যায্যতাবিরোধী এই দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের সেই শরিকদের আবারও মুক্তিযুদ্ধের শরিকানা থেকে আলাদা করে ফেলতে চেষ্টা করছে। আর পরিতাপের ব্যাপার হলো আওয়ামী আবেগের বাইরেও মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা অন্য শরিকদের মধ্যে ভিন্নভাবে দীপ্যমান, সেটি নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছানোর যথেষ্ট উদ্যোগের অভাব দেখা দিয়েছে।

একাত্তর ও চব্বিশের চেতনা যে পরস্পরবিরোধী নয়; বরং ধারাবাহিকতামাত্র, তা ধরিয়ে দেওয়ার ঐতিহাসিক জ্ঞানের অভাব রয়েছে। আশা করি, শিগগিরই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ফিরে আসবে এবং বাংলাদেশের ভিত্তি মুক্তিযুদ্ধকে স্বমহিমায় জনগণ রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে একটি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্য নিয়ে।

  • ড. আহমেদ শামীম  ভাষাবিদ, কর্নেল ভাষাসম্পদ কেন্দ্রের সমন্বয়ক হিসেবে কর্মরত

    মতামত লেখকের নিজস্ব