জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর আঁকা গ্রাফিতিতে মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর আঁকা গ্রাফিতিতে মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ

আলতাফ পারভেজের কলাম

জুলাই সনদে ‘জুলাই’ কোথায়

‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষরিত হয়েছে ১৭ অক্টোবর। এখন তার বাস্তবায়নের পথ খোঁজা হচ্ছে। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, বর্বর অতীত থেকে সনদে সই করে বাংলাদেশ ‘সভ্য জগতে’ হাঁটতে শুরু করেছে।

ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বাংলা নিঃসন্দেহে নানানভাবে নিপীড়িত ছিল, উপনিবেশিত ছিল, বঞ্চনার শিকার ছিল। এবার বিস্ময়করভাবে জানা হলো, আমরা বর্বর জগতেও ছিলাম! কিন্তু এই ‘বর্বর’ কারা ছিল? শাসকশ্রেণি, নাকি শোষিত নিম্নবর্গ? ‘সভ্য জগতে’ কি উভয়ে ঢুকতে পারছে?

কী আছে আলোচিত সনদে, যা বাংলাদেশের সভ্য-ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে যাচ্ছে? আদৌ সে রকম কিছু আছে কি না? সনদের অভিভাবকেরা ‘সভ্যতা’র সংজ্ঞা বা মানদণ্ড হিসেবে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন? আগামী বাংলাদেশ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে অবশ্যই সনদের বিষয়বস্তুতে, এর কারিগর বা স্বাক্ষরকারীদের ভাষণে নয়।

বহুল আলোচিত জুলাই সনদের পটভূমি তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের ‘লাল জুলাই’ এবং তার আগের নানা শ্রেণি-পেশার অসংখ্য আন্দোলন-আকাঙ্ক্ষায়। প্রায় এক হাজার শহীদের আত্মদান যে পরিবর্তন ঘটিয়েছে, যাকে শহীদদের জীবিত সহযোদ্ধারা বলেছেন, ‘বৈষম্যবিরোধী’ গণ–অভ্যুত্থান, সেটিই ২০২৫–এর অক্টোবরের স্বাক্ষরানুষ্ঠানের নৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি।

জুলাই সনদের ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ বা কার্যপরিধি অবশ্যই ২০২৪ ও তার আগের গণ–আন্দোলনগুলোর মূল চাওয়াগুলো। যে চাওয়া একটি শব্দের ভেতর ঘনীভূত করে রেখে গেছে শহীদদের কাফেলা, সেই শব্দ হলো ‘বৈষম্য’।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নৈতিক ও নীতিগত কোনো বাধ্যবাধকতা যদি থাকে, তাহলে সেটি অবশ্যই এ-ই যে তাকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে পদক্ষেপ নিতেই হবে। জুলাই সনদকেও কেবল সে আলোকেই দেখতে হবে।

সংগত কারণে, কথিত সভ্যতা-অসভ্যতার মানদণ্ড হতে হবে ‘বৈষম্য’। জনগণের সম্মিলিত যৌথ সাধারণ ইচ্ছার আলোকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে সর্বতোভাবে একটি বৈধ সরকার, সেটি বহুবার বহুজন বলেছেন এবং সেটিই সত্য। তবে এটা একই সঙ্গে কোনো স্বাভাবিক সরকার নয়। এ সরকারের কাঁধে শহীদদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের আবশ্যক দায় রয়েছে।

সরকারের অন্য যাবতীয় ম্যান্ডেটের (বিচার ও নির্বাচন) চেয়েও বৈষম্যের প্রশ্নটি সে কারণেই অগ্রাধিকারমূলক কর্তব্য। ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হওয়া সনদ সেই অগ্রাধিকারমূলক দায়েরই ফসল। সেভাবেই কেবল এটা ‘ঐতিহাসিক’। কিন্তু সেখানে ‘জুলাই’–এর চাওয়া কতটা ঠাঁই ফেলল?

জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫–এ স্বাক্ষরের পর সনদের কপি তুলে ধরেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। ১৭ অক্টোবর শুক্রবার বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায়

২০২৪ সালের জুলাইয়ের কেন্দ্রীয় আকাঙ্ক্ষা যদি হয় সমাজ ও রাষ্ট্রের সব স্তর থেকে বৈষম্য দূর করা, তাহলে প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে বাংলাদেশে সবচেয়ে বৈষম্যপীড়িত জনগোষ্ঠী কারা?

এ রকম তালিকার সিরিয়াল বা ক্রম নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে; কিন্তু এটা বোধ হয় সবাই মানবেন—শ্রমিক, চাষি, দলিত, ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠীর মানুষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং বিশেষভাবে নারী সমাজ এ দেশে বৈষম্যের শিকার বেশি। কোনো কোনো কৃষক, কোনো কোনো নারী বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ কেউ আর্থিকভাবে ভালো আছেন; কিন্তু এ রকম সব জনগোষ্ঠী সাধারণভাবে সমাজের মূলধারা থেকে পিছিয়ে আছেন; সম্প্রদায়গতভাবে অসম অবস্থার শিকার তাঁরা।

জনগোষ্ঠীগতভাবে না দেখে এ দেশের বৈষম্যের সমস্যাকে অর্থনীতির আলোকেও দেখা যায়। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীরা প্রথমে কর্মসংস্থানের বঞ্চনার কথা বলছিলেন। তখন এবং এখনো বেকারত্ব দেশের প্রধান এক সমস্যা। বাজার সিন্ডিকেটও আগে-পরে চিরস্থায়ী ধারালো তলোয়ার হয়ে আছে এ দেশে। আর রয়েছে দারিদ্র্য।

বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ২১ শতাংশ। সরকারি হিসাবে সেটি ১৯ শতাংশ। বেসরকারি সংস্থা পিপিআরসি বড় স্যাম্পল সাইজ বা নমুনা নিয়ে গবেষণা করে এ বছর ২৮ শতাংশ মানুষকে দরিদ্র দেখেছে। ওপরের তিনটি ফলকে গড় করলে দারিদ্র্যের হার দাঁড়ায় প্রায় ২৩ শতাংশ।

সবাই ভেবেছেন, প্রতিটি কমিশনের কিছু কিছু সুপারিশ নিশ্চয়ই বৈষম্যবিরোধী সরকার বাস্তবায়ন করে যাবে এবং বাকিটা পরের নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে যাবে। এ পথেই কেবল লাল জুলাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব। এটিই ছিল প্রত্যাশিত সুশাসন ও সভ্যতার পথ। কিন্তু জুলাই সনদে কী পেলাম আমরা। সেখানে কি আদৌ প্রত্যাশার ‘জুলাই’ আছে?

১৭ কোটি মানুষের দেশে ২৩ শতাংশ মানে ৪ থেকে ৫ কোটি মানুষ। যে মানুষেরা মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকার কম আয় করতে পারেন। এর মধ্যে আবার সরকারি হিসাবেই ২৬ লাখের বেশি মানুষ বেকার। এই বেকার মানুষেরা সপ্তাহে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টা কাজের সুযোগ পাচ্ছেন না। এই যে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য—এসবও ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানের বড় একটি পটভূমি। ওপরে যে শ্রমিক, কৃষক, দলিত, নারী ও সংখ্যালঘুদের কথা উল্লেখ করা হলো, তঁারাই সংখ্যায় বেশি দরিদ্র ও বঞ্চনার বলি। এ রকম জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে বঞ্চনাভুক্ত আরেক জনগোষ্ঠী।

আবার এদের পাশাপাশি খানিকটা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা জনসমাজের বাকি অংশেরও বড় এক সমস্যা বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও পুলিশি ব্যবস্থার হয়রানি-নিপীড়ন। ‘লাল জুলাই’–এ সেসবের বদলও বড় দাবি ছিল। এ রকম সব দাবি নিশ্চয়ই জুলাই–পরবর্তী গ্রাফিতিগুলোতে আমরা দেখেছি। সে সবই জুলাই-অভ্যুত্থানের অলঙ্ঘনীয় ইশতেহার। ফলে স্বাভাবিকভাবে বৈষম্যবিরোধী অভ্যুত্থানের সরকার ও শক্তিগুলোর প্রধান কর্তব্য ছিল ওপরে উল্লিখিত জনগোষ্ঠীর জীবনের জরুরি বিষয়গুলোতে উদ্ধারমূলক কিছু পরিবর্তন সাধন।

সরকার শুরুতে সঠিক পথেই এগিয়েছে। বিভিন্ন খাত ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমস্যা শনাক্ত করতে অনেক কমিশন ও টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এ প্রসঙ্গে শ্রম কমিশন, নারী কমিশন, পুলিশ ও প্রশাসন সংস্কার কমিশন, স্থানীয় সরকার কমিশন ইত্যাদি উল্লেখ করা যায়।

যদিও বিস্ময়করভাবে শিক্ষা ও কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো সংস্কার কমিশন গঠিত হয়নি। কেন এ রকম দুটি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে সংস্কারের আয়োজন থেকে বাদ দেওয়া হলো, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তারপরও মানুষ গঠিত হওয়া সংস্কার কমিশনগুলোর দিকে একবুক আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন। কমিশনগুলোর সদস্যরাও বেশ পরিশ্রম করে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক অনেক সুপারিশ হাজির করলেন।

সবাই ভেবেছেন, প্রতিটি কমিশনের কিছু কিছু সুপারিশ নিশ্চয়ই বৈষম্যবিরোধী সরকার বাস্তবায়ন করে যাবে এবং বাকিটা পরের নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে যাবে। এ পথেই কেবল লাল জুলাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব। এটিই ছিল প্রত্যাশিত সুশাসন ও সভ্যতার পথ।

কিন্তু জুলাই সনদে কী পেলাম আমরা। সেখানে কি আদৌ প্রত্যাশার ‘জুলাই’ আছে? ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবসংবলিত জুলাই সনদ সবার পড়া উচিত। নিশ্চয়ই অনেকে সেটি পড়েছেনও। এই সনদে সর্বসম্মত অংশে কৃষক, শ্রমিক, দলিত, সংখ্যালঘুদের জীবনযাপনের প্রাত্যহিক বৈষম্য কমানোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত কোন সংস্কার প্রস্তাব আছে কি? না থাকলে কেন নেই?

স্বাক্ষরিত সনদে নারীদের জন্য কেবল একটা প্রস্তাব রয়েছে, সংসদে তাঁদের বর্তমান সংরক্ষিত আসন ক্রমে যেন ১০০ করা হয়। অথচ নারীদের প্রাণের দাবি হলো সংরক্ষিত আসন বাড়িয়ে তাতে সরাসরি নির্বাচন। তাহলে বৈষম্যবিরোধী গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এই সনদ কীভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ? কীভাবে এই সনদ লাল জুলাইয়ের চাওয়াকে ধারণ করল?

পুলিশ ও প্রশাসনিক সংস্কার বিষয়ে আবার স্থায়ী কমিশন গঠনের জন্য বলা হয়েছে। অথচ এই দুই খাতের সংস্কার বিষয়ে বিপুল সুপারিশসহ এবারই দুটি প্রতিবেদন তৈরি হয়ে পড়ে আছে। তাহলে আবারও কেন নতুন কমিশন গঠনের কথা বলা হচ্ছে?

এবারের কমিশনের সুপারিশগুলো থেকে প্রধান কয়েকটি বাস্তবায়নে বাধা কোথায় ছিল, তার কিছুই জানা হলো না জনগণের। জুলাই সনদ সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছে অর্থনীতি ও উৎপাদন সম্পর্কের সংস্কার বিষয়ে। কর্মসংস্থান বাড়িয়ে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য কমাতে করব্যবস্থার প্রগতিশীল সংস্কারসহ জরুরি বিষয়গুলোর কোনো সংস্কার প্রস্তাব নেই সেখানে।

জনসংখ্যার সংশ্লিষ্টতা বিচারে কৃষি দেশের সবচেয়ে বড় খাত। সেখানে ভূমি বিষয়ে, বাজার বিষয়ে বহু ধরনের সংস্কার এজেন্ডা ছিল। সনদ সেসব এড়িয়ে গেছে। শ্রমিকদের মজুরি বোর্ড, শোভন কাজের পরিবেশ, আবাসন-রেশন ইত্যাদি বিষয়ও পরিত্যাজ্য থেকেছে সনদে। তাহলে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা চার-পাঁচ কোটি থেকে কমাতে এবং তাঁদের জীবনের প্রাত্যহিক বঞ্চনা কমাতে এই সনদের কী ধরনের ভূমিকা থাকছে?

বাস্তবতা যদি এ রকমই হয়, তাহলে ‘সভ্য জগতে’ ঢুকেও আমরা আরেকটা ‘জুলাই’–এর অপেক্ষাতেই কি থাকব?

  • আলতাফ পারভেজ লেখক ও গবেষক

* মতামত লেখকের নিজস্ব