মতামত

মানি লন্ডারিং: যে কারণে সিআইডির নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট প্রয়োজন

২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০১৫ জারি হয়। ওই সংশোধনীতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ২ ধারা সংশোধন করে ‘তদন্তকারী সংস্থা’ হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) যুক্ত করা হয়। সংশোধনীতে বলা হয়, পুলিশ কর্তৃক তদন্তযোগ্য ‘সম্পৃক্ত অপরাধ’ বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ কর্তৃক তদন্ত করতে হবে। ওই অধ্যাদেশ ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর আইনে রূপান্তরিত হয়। এর প্রায় তিন বছর দুই মাস পর ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা, ২০১৯’ প্রণীত হয়। অধ্যাদেশটি জারি হওয়ার তারিখ থেকেই সিআইডি মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত অপরাধসমূহের অনুসন্ধান এবং তদন্ত করে আসছে। সিআইডি কর্তৃক দায়েরকৃত শতাধিক মামলার বিচার, তদন্ত এবং অনুসন্ধান এখনো চলছে। এর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

সাধারণত বিশেষ জজ আদালতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলাগুলো হয়। কমিশনের নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট আছে। বর্তমানে মানি লন্ডারিং মামলায় বিচারিক আদালতে দুদকের সাফল্য প্রায় শতভাগ। যেহেতু আইনে বলে দেওয়া আছে, তাই সিআইডির মামলাগুলোরও বিচার হয় বিশেষ জজ আদালতে। কিন্তু সিআইডি কর্তৃক মামলাগুলোর অনুসন্ধান ও তদন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হলেও বিচারে গিয়ে বিলম্ব হচ্ছে অথবা অদক্ষতার প্রশ্ন উঠছে। কয়েক দিন আগে সিআইডি কর্তৃক একটি গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রা পাচারের মামলার বিচার চলাকালে আদালত পুনঃতদন্তে পাঠিয়েছেন। 

সিআইডির নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট না থাকায় মামলার অভিযোগপত্র দায়েরের পর তা পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। সিআইডির যদি নিজস্ব একটি প্রসিকিউশন ইউনিট থাকত, তাহলে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা পাওয়া যেত। তার মানে সিআইডি কর্তৃক তদন্তকৃত এবং বিশেষ জজ আদালত কর্তৃক বিচারযোগ্য মামলাসমূহ পরিচালনার জন্য একটি নিজস্ব স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিটকে বোঝানো হচ্ছে। ওই প্রসিকিউটর বা আইনজীবীদের নিয়োগ ও মামলা পরিচালনার শর্তাবলি আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে। এর জন্য প্রয়োজন হলে আইন এবং বিধি সংশোধন করতে হবে।

মানি লন্ডারিং মামলায় যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, তাঁরা আর্থিকভাবে শক্তিশালী এবং অনেক ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে মর্যাদাবান ব্যক্তি হন। তাঁরা উচ্চ আদালতে মামলার কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ করেন। এটাকে আইনগতভাবে মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট

  মানি লন্ডারিং কী?

অবৈধ অর্থ বা সম্পত্তিকে বৈধ রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়াই হচ্ছে মানি লন্ডারিং। বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে মানি লন্ডারিংকে সংজ্ঞায়িত করেছে। বাংলাদেশে অনেকভাবে মানি লন্ডারিং হয়ে থাকে, যেমন বাণিজ্য কারসাজি, হুন্ডি, অনলাইন জুয়া। ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড সহজলভ্য হওয়ায় জুয়ার আগ্রহ বাড়ছে দিন দিন। ফেসবুক পেজ, গ্রুপ, ওয়েবসাইট ও মোবাইলভিত্তিক এনক্রিপ্টেড অ্যাপ দিয়ে চলছে এই জুয়ার সাইটগুলো। বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়াতে হুন্ডির দৌরাত্ম্য ঠেকাতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে অনেক ছাড় দিতে হবে। কারণ, হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে। এমনও দেখা গেছে, এলসি না খুলে হুন্ডির মাধ্যম পণ্য আমদানির ফলে সরকার প্রচুর রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হওয়া মানেই বৈধ পথে রেমিট্যান্স কমে যাওয়া।

 মূলত আমদানির ক্ষেত্রে ‘ওভার ইনভয়েসিং’ এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ হয়। পণ্য রদবদল, ভার্চ্যুয়াল মুদ্রার মাধ্যমে অর্থ লেনদেন, নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত মানি চেঞ্জারের মাধ্যমে রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না পাঠিয়ে সেটা দিয়ে বিদেশে বাড়ি করা, রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ডের অর্থ বিভিন্ন কারসাজির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা মানি লন্ডারিংয়ের অন্তর্ভুক্ত। ব্যাংকের সঙ্গে মিলে ও ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে কারসাজি করে মোটা অঙ্কের রপ্তানি বিল দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা হাতিয়ে নেওয়া হয়। বাস্তবে হয়তো এর বিপরীতে কোনো পণ্যই রপ্তানি হয়নি। 

নানা উপায়ে বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে দেশি-বিদেশি আমদানি-রপ্তানি প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তা, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, এমনকি ব্যাংকও জড়িত থাকে। এসব নানামুখী অপরাধের ধরন অনেক ক্ষেত্রে একজন পুলিশ কর্মকর্তার জন্য তদন্তের সময় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। সে ক্ষেত্রে একজন পাবলিক প্রসিকিউটরের দিকনির্দেশনা তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এসব ক্ষেত্রে আইনের সঠিক ব্যবহার না হলে তদন্তটি দীর্ঘায়িত এবং আইনি জটিলতার সম্মুখীন হতে পারে। দক্ষ প্রসিকিউটরের আইনি পরামর্শ নিয়ে সিআইডির একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা নির্ভুলভাবে একটি মামলার তদন্ত করতে পারে। 

পাবলিক প্রসিকিউটরদের সীমাবদ্ধতা

সরকারের হয়ে যেসব আইনজীবী মামলা পরিচালনা করে থাকেন, তাঁদের পাবলিক প্রসিকিউটর বলা হয়। একজন পাবলিক প্রসিকিউটর অনেক ধরনের মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন। যেমন হত্যা মামলা, ডাকাতি মামলা, অস্ত্র মামলা, মাদক মামলা ইত্যাদি। কাজেই মানি লন্ডারিংয়ের মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে যে সময় ব্যয় করা উচিত, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যৌক্তিক কারণেই তা সম্ভব হয় না। উপরন্তু মানি লন্ডারিং মামলার ধরনগুলো ভিন্ন। বর্তমানে অনলাইন জুয়া মানি লন্ডারিং তদন্তে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বেড়েছে হুন্ডির ধরন। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি নজরদারি অনেক বাড়াতে হচ্ছে। সন্দেহজনক লেনদেন এর পরিধি অনেক বেড়েছে।

বিচারিক আদালতই শেষ নয়, মানি লন্ডারিংয়ের মামলা পরে হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপিল বিভাগে যায়। মানি লন্ডারিং মামলায় যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, তাঁরা আর্থিকভাবে শক্তিশালী এবং অনেক ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে মর্যাদাবান ব্যক্তি হন। তাঁরা উচ্চ আদালতে মামলার কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ করেন। এটাকে আইনগতভাবে মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট। বিষয়গুলো আশা করি সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারক মহল অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখবে এবং ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেবে। 

খুরশীদ আলম খান সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী