
১৭ নভেম্বর প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠার একটি খবরের শিরোনাম হলো, ‘লিবিয়ার ভূমধ্যসাগর উপকূলে নৌকা ডুবে ৪ বাংলাদেশির মৃত্যু’। আল–জাজিরার সূত্রে খবর থেকে জানা যাচ্ছে, ১৩ নভেম্বর রাতে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপের উদ্দেশে পাড়ি দিতে যাওয়া দুটি নৌকা লিবিয়ার উপকূলে ডুবে যায়। এর মধ্যে একটি নৌকায় বাংলাদেশ থেকে আসা ২৬ জন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে চারজন মারা যান। অন্যদের উদ্ধার করা হয়।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুজনের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের লাওখণ্ডা গ্রামে। দুজনেই তরুণ। এনামুল শেখের বয়স ২৭ আর আনিস শেখের বয়স ২৫। গত ১০ অক্টোবর তাঁরা বাংলাদেশ ছাড়েন। চার ভাইয়ের মধ্যে এনামুল ছিলেন সবার ছোট। পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতেই তাঁর এই অগস্ত্যযাত্রা। আর ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন নার্সের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আনিসের। তাঁদের সংসারে সাড়ে তিন বছরের একটি কন্যাসন্তান আছে।
ভাগ্য ফেরাতে ইতালি যাওয়ার জন্য তাঁরা মাদারীপুরের একজন দালালকে ২১ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। লিবীয় রেড ক্রিসেন্টের প্রকাশিত ছবিতে দেখা যাচ্ছে, প্লাস্টিকের ব্যাগে মোড়ানো মৃতদেহ গাড়িতে তোলা হচ্ছে। প্রিয়জনদের লাশ দেশে কবে ফিরবে, শেষ দেখাটা দেখতে পাবেন কি না, সেটাই এখন স্বজনদের একমাত্র আর্তনাদ।
মাদারীপুরের টগবগে তরুণ মুন্না তালুকদার। মাত্র ১৯ বছরে থেমে গেছে তাঁর জীবন। সাড়ে ২২ লাখ টাকায় বডি কন্ট্রাক্ট বা শরীর চুক্তি করে ইতালি পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু সেই বডিটাই এখন মায়ের কাছে ফিরবে কি না, সেটাই বড় সংশয়। দালালেরা বলেছে, জলদস্যুদের গুলিতে রাজৈর উপজেলার বায়েজিদ শেখ নামের আরেক তরুণের সঙ্গে মুন্না গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
ছেলের মৃত্যুসংবাদ শুনে মুন্নার মা রাবেয়া বেগমের সেই আর্তিই শোনা যাচ্ছে: ‘দালাল আমার বাবারে বডি কন্ট্রাক্ট (শরীর চুক্তি) কইরা নিছে। বলছে, য্যামনে হোক, ইতালি লইয়া যাইবে। সাড়ে ২২ লাখ টাকা লইয়া ভাগছে। ওরা আমার বাবারে খারাপ নৌকায় দিয়া মাইরা ফালাইছে। দয়া কইরা আমার বাবার বডি (শরীর) আম্মেরা আইনা দেন। আম্মেগো পায় ধরি, আমার বাবার লাশটা আইনা দেন।’ (আম্মেগো পায় ধরি, আমার বাবার লাশটা আইনা দেন’ ১৯ নভেম্বর, ২০২৫)
সাড়ে ১৫ বছর বলি, আর ৫৪ বছর বলি, এতগুলো বছরের জঞ্জাল দেড় বছরে ধুয়ে–মুছে ফেলা অসম্ভব। যে তরুণদের কর্মসংস্থানের বঞ্চনা নিয়ে চব্বিশের অভ্যুত্থানের সূচনা, তাঁদের কর্মসংস্থান, জীবনমান পাল্টানোর দৃশ্যমান কোনো প্রচেষ্টা, উদ্যোগ কোথাও দেখা যায়নি। বরং নতুন সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর আবির্ভাব হতে দেখছি। আর ধীরে ধীরে বাদ পড়ে গেছেন শ্রেণি–পেশা–জাতি–লিঙ্গ নির্বিশেষে অভ্যুত্থানের অংশগ্রহণকারীরা।
প্রথম আলোর মাদারীপুর প্রতিনিধি অজয় কুণ্ডুর একই প্রতিবেদনে, বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে ইতালিযাত্রার একটা পথরেখা জানা যায়। ১২ অক্টোবর ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে ঘর ছাড়েন মুন্না। প্রথমে তাঁকে সৌদি আরবে নেওয়া হয়। পরে ওমরাহ হজ করতে যান মুন্না। হজ শেষে তাঁকে কুয়েত নেওয়া হয়। সেখানে কয়েক দিন রেখে নেওয়া হয় মিসরে। তারপর উড়োজাহাজে লিবিয়ার বেনগাজিতে নেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে লিবিয়ার মিসরাতা শহরের নেওয়া হয়। ১ নভেম্বর মুন্নাকে লিবিয়ার উপকূল থেকে নৌকায় ইতালির উদ্দেশে পাঠানো হয়। একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় অন্য অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মুন্নাকে তুলে দেয় দালাল চক্র। মুন্নাকে বহন করার নৌকাটি ভূমধ্যসাগরের কিছু দূর যাওয়ার পরই মাফিয়াদের (জলদস্যুদের) হামলার শিকার হয়।’
ভাগ্য বদলাতে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগরের বিপজ্জনক পথে বাংলাদেশি তরুণদের এই আত্মহনন নতুন নয়। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে নৌকা ডুবে ৮ বাংলাদেশি মারা যান। ২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা জোটের হস্তক্ষেপে মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন হয়। এর পর থেকে দেশটি দারিদ্র্য ও গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে লিবিয়া হয়ে ওঠে বিশ্বের সংঘাতকবলিত ও দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলো থেকে ইউরোপমুখী অভিবাসী ও আশ্রয়প্রার্থীদের অন্যতম ট্রানজিট রুট।
আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার বরাতে ২০২৪ সালের মে মাসে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ২০১৪-২০২৪ সালের প্রথম ভাগ পর্যন্ত অন্তত ২৮৩ জন বাংলাদেশি লিবিয়া হয়ে ইউরোপ পাড়ি দিতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে জীবন হারিয়েছেন। লিবিয়ায় অভিবাসী ও শরণার্থীদের আটকে নির্যাতন, মুক্তিপণ আদায়, হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও নিয়মিত। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশি তরুণেরা কেন এমন মরিয়া হয়ে বডি কন্ট্রাক্ট করছেন। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপযাত্রা সবচেয়ে বিপজ্জনক রুটগুলোর একটি। ২০১৪-২০২৪—এই ১০ বছরে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এই পথে পাড়ি দিতে গিয়ে মারা গেছেন অথবা নিখোঁজ হয়েছেন।
বাংলাদেশি তরুণদের জীবন বাজি রেখে ভাগ্য ফেরানোর এই তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্র। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের ২৫ বছরের যুবক আকরাম হোসেন ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে মিসাইলের আঘাতে নিহত হওয়ার পর সবার নজরে আসে। ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শিখে তিনি রাশিয়ায় যান। কিন্তু দালালেরা তাঁকে রুশ সেনাবাহিনীতে ‘চুক্তিভিত্তিক যোদ্ধা’ হিসেবে নিয়োগ করে। ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে পাঠানো হয় ইউক্রেনে। গত ১৪ এপ্রিল সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। ধারদেনা করে সাত লাখ টাকা জোগাড় করে পরিবার তাঁকে পাঠিয়েছিল রাশিয়ায়।
ময়মনসিংহের গৌরীপুরের ২২ বছরের তরুণ ইয়াসিন মিয়াও এ বছরের এপ্রিলে রাশিয়ার গিয়ে ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে গিয়ে মিসাইল হামলায় নিহত হন। চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ঠিক কতজন বাংলাদেশি এখন রাশিয়ার হয়ে ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন, কতজন হতাহত হয়েছেন তার সঠিক তথ্য জানা যায় না।
মিসাইলের আঘাতে আকরাম ও ইয়াসিনের মৃত্যুর পর অন্তত ১০টি পরিবার তাদের স্বজনদের ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন করেছে। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, কীভাবে দালালেরা উচ্চ বেতনে কাজের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রমিকদের প্রলুব্ধ করে। অনেকে তেল, নির্মাণ বা লজিস্টিকস খাতে কাজের আশায় রাশিয়া গেছেন। রাশিয়ায় পৌঁছানোর পর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে সর্বাত্মক সামরিক হামলার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতি মূলত যুদ্ধ অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই যুদ্ধে রাশিয়া বিপুলসংখ্যক জনবল খুইয়েছে। সেই সংকট মেটাতে উত্তর কোরিয়া, আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো, সিরিয়া থেকে ভাড়াটে সেনা নিজেদের সেনাবাহিনীতে যুক্ত করছে। বিপুল অঙ্কের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে আড়কাঠিরা (দালালেরা) তাদের রাশিয়ার হয়ে বিপজ্জনক যুদ্ধে পাঠাচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্যকে রাশিয়া যুদ্ধের হাতিয়ার করেছে। ফলে পুতিনের এ যুদ্ধ শুধু ইউক্রেনের বিরুদ্ধেই নয়, তৃতীয় বিশ্বের বিরুদ্ধেও।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সরাসরি যুদ্ধের কথা বলে নিয়োগ হয়তো হচ্ছে না। কিন্তু দালালেরা উচ্চ বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে তরুণদের রাশিয়ায় পাঠাচ্ছে। সেখানে গিয়ে তাঁরা যে কাজ পাচ্ছেন তাতে ভিটেমাটি বন্ধক রেখে ঋণ করে রাশিয়া পাড়ি দিয়ে ভাগ্য বদলের স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। কয়েক গুণ বেশি বেতন ও সুবিধা পাওয়ায় তাঁরা সেনাবাহিনীতে ভাড়াটে সেনা হিসাবে নাম লেখাচ্ছেন। মাত্র ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে অত্যাধুনিক ড্রোন, মিসাইল আর তীব্র শীতের মুখে তাঁদের ঠেলে পাঠানো হচ্ছে। উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, রাশিয়ার হয়ে ভাড়াটে সেনার জীবন বেছে নেওয়া কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাশিয়ায় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করলে কী কী সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, তা নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন।
ভূমধ্যসাগরে ডুবে, ইউক্রেনের বরফে মোড়া যুদ্ধক্ষেত্রে মিসাইলের আঘাতে আমাদের তরুণদের এই আত্মহনন কি চলতেই থাকবে? হাসিনা সরকারের আমলে উন্নয়নের বয়ানে রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ীদের নিয়ে যে গোষ্ঠীতন্ত্র গড়ে উঠেছিল, তাঁরা হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে দেশের বাইরে পাচার করে দিয়েছেন। তরুণদের নিয়ে তাঁরা ভাবেননি। কর্মসংস্থান নাই, সম্মানজনক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা নাই—হাজার হাজার তরুণ সর্বস্ব বাজি রেখে মরিয়া হয়ে দেশ ছাড়ছেন। ভাবা যায়, একটা দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১৭ ভাগের ১ ভাগ প্রবাসে। প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ প্রবাসীর পাঠানো রেমিট্যান্সে দিব্যি চালু থাকছে অর্থনীতির চাকা। ফলে একের পর এক মেগা প্রকল্প নিতে, বেতন–ভাতা খাতে ব্যয় বাড়াতে সরকারগুলোর সমস্যায় পড়তে হয় না।
সাড়ে ১৫ বছর বলি, আর ৫৪ বছর বলি, এতগুলো বছরের জঞ্জাল দেড় বছরে ধুয়ে–মুছে ফেলা অসম্ভব। যে তরুণদের কর্মসংস্থানের বঞ্চনা নিয়ে চব্বিশের অভ্যুত্থানের সূচনা, তাঁদের কর্মসংস্থান, জীবনমান পাল্টানোর দৃশ্যমান কোনো প্রচেষ্টা, উদ্যোগ কোথাও দেখা যায়নি। বরং নতুন সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর আবির্ভাব হতে দেখছি। আর ধীরে ধীরে বাদ পড়ে গেছেন শ্রেণি–পেশা–জাতি–লিঙ্গ নির্বিশেষে অভ্যুত্থানের অংশগ্রহণকারীরা।
সরকারি চাকরির সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক না থাকার পরও ইয়াসিনের মতো যে তরুণেরা চব্বিশের অভ্যুত্থানে বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরাই কেন জীবন বাজি রেখে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেবেন, ইউক্রেনের মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মিসাইল আর ড্রোনের আঘাতে মরতে হবে? আর কিছু না হোক অন্তত আমাদের তরুণদের এই আত্মহনন ঠেকাতে কিছু উদ্যোগ কি নেওয়া যেত না?
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী
*মতামত লেখকের নিজস্ব