আমি জ্যোতিষী নই। নিশ্চিত করে বলতে পারি না, কাল কিংবা পরশু কী ঘটবে। ছয় মাস বা এক বছর পর কী হতে পারে, তা আন্দাজ করা তো দূরের কথা। কারণ, আমাদের দেশ, সমাজ, জীবন কোনোটাই সরলরেখায় চলে না। সেখানে নানান বাঁক, খানাখন্দ। যেকোনো সময় ছন্দপতন হতে পারে।
তারপরও আমরা অভিজ্ঞতা আর কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে ভবিষ্যতের কথা বলি। কাঙ্ক্ষিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত যা-ই আসুক না কেন, তার জন্য আগাম প্রস্তুতি নিই। কিন্তু যেখানে আমি একা নই, আমার চারপাশে আছে হাজারো মানুষ ও প্রতিষ্ঠান, সেখানে আমার ব্যক্তিগত অনুমাননির্ভরতা এবং ভবিষ্যৎকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি কোনো কাজে আসে না, যদি না সেটি সম্মিলিত প্রয়াস হয়। এ রকম ঘটনা ঘটে প্রায়ই।
যা চাই না, যা প্রত্যাশিত নয়, তাকে আমরা বলি অঘটন। এ রকম কিছু ঘটে গেলে আমরা অবাক হই। আমাদের মন ভাঙে। হতাশা জেঁকে বসে।
সম্প্রতি কিছু ঘটে গেছে, যা আমাদের অনেকের কাছে ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু ঘটনা তো আপনা–আপনি ঘটে না। এটি ঘটানো হয়। তার পেছনে থাকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত প্রয়াস। এর জন্য থাকে পরিকল্পনা। অনুঘটকেরা তো আটঘাট বেঁধেই নামেন। তিনিই ভালো পরিকল্পনাকারী, যিনি অন্য পক্ষকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় রেখে পদক্ষেপ নেন। সামরিক পরিভাষায় এটাকে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ বলা যেতে পারে। এ ধরনের পদক্ষেপের একটা উদ্দেশ্য থাকে—হুঁশিয়ার হয়ে যাও; আমরা আসছি বিপুল বিক্রমে।
আপাতত দেখছি, দুটি জনপ্রিয় দৈনিক আর দুটি সাংস্কৃতিক সংগঠনে হামলা হয়েছে। এটা কি হুট করে হলো? মোটেই না। অনেক দিন ধরেই এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার হচ্ছিল। ফেসবুক ও ইউটিউব ঘাঁটলেই জানা যাবে, কে কখন কীভাবে উসকানি দিয়েছে। জানাই ছিল, অনেকেই এসব প্রতিষ্ঠান চালু থাকার ঘোর বিরোধী। কিন্তু এভাবে আক্রমণ, লুটপাট এবং আগুন দেওয়া হবে, তা আন্দাজ করা যায়নি।
এ দেশে একদল লোক যখন-তখন যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাউকে শত্রু বানায়, নিমেষেই তার বিচার করে ফেলে এবং বিচারের রায় বাস্তবায়ন করতে একমুহূর্ত অপেক্ষা করে না। এটাকে ‘মব জাস্টিস’ বলে গৌরবান্বিত করার চেষ্টা হয়। আদতে এটা জাস্টিস, নাকি ভায়োলেন্স। এ ধরনের সংঘবদ্ধ আচরণের পেছনে একটা উদ্দেশ্য থাকে। সেখানে ন্যায়বিচারের প্রশ্ন যেমন আছে, তেমনি আছে বদমতলব থেকে ভিন্নমত ও পথের লোককে শায়েস্তা করার ফন্দি।
একটা সমাজে যখন বিচারব্যবস্থা বলে কিছু থাকে না, কাঠামোগত যে ব্যবস্থা আছে, সেটি খুব সময় নেয় এবং অনেক খরচ হয়। ভুক্তভোগীকে বিচার পেতে অপেক্ষা করতে হয় বছরের পর বছর। আদালত আর উকিলের খরচ জোগাতে তাকে সর্বস্বান্ত হতে হয়। সে জন্য অনেকেই নিজের হাতে আইন তুলে নেয়। আইনের শাসন নিয়ে আমরা যতই আহাজারি করি না কেন, সহজে, কম খরচে এবং অতি দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে এ রকম মব জাস্টিস বা ভায়োলেন্স বন্ধ করা যাবে না। আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার অবস্থানে যেতে আর কত শতাব্দী লাগবে, কেউ বলতে পারে না।
একশ্রেণির লোক সব সময় তক্কে তক্কে থাকে, কখন কোথায় লুটপাট করতে পারবে। সুযোগ পেলেই তারা অন্যের ওপর চড়াও হয়। ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখন তো লুটের মচ্ছব চলছে। তার মধ্যে হাতে গোনা দু-একজন পণ্ডিতকে বলতে শুনি, এদের মব বলা যাবে না। এরা হচ্ছে প্রেশার গ্রুপ। যারা মব বলে, তারা হচ্ছে স্বৈরাচারের দোসর। লুটপাটকে ন্যায্যতা দেওয়ার কী ভয়ংকর চেষ্টা!
এ তো গেল বিচার না পাওয়ার কারণে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আইন হাতে তুলে নেওয়ার ব্যাপার। কিন্তু এর বাইরেও কিছু আছে। আমাদের সমাজটা এখনো পশ্চাৎপদ। পশ্চিমের শিল্পোন্নত সমাজের ভাষায় বলা যেতে পারে, আমরা মধ্যযুগীয় ‘ট্রাইবাল’ কালচারে আছি। এখানে নানান মতের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে গোত্র বা গোষ্ঠী।
প্রতিটি গোত্র বা গোষ্ঠী মনে করে, সে-ই সঠিক। বাকি সবাই ভ্রান্ত এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর। তার চোখে যে খারাপ, তাকে শায়েস্তা করার দায়িত্ব বর্তেছে গোত্রপতির ঘাড়ে। এখানে তিনি নিছক নেতা নন, একজন ‘ত্রাতা’। তাঁর কাজ হলো বাকি সবাইকে নির্দশ দেওয়া। তিনি স্লোগান দেন—জ্বালো জ্বালো, আগুন জ্বালো। অমনি তাঁর অনুসারীরা আগুন হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো আছে মধ্যযুগে, যেখানে চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, জানের বদলে জান—এই হচ্ছে ন্যায়বিচার। আমাদের স্লোগানগুলোও তেমন—একটা-দুইটা ‘অমুক’ ধর, ধরে ধরে জবাই কর। চাষাভুষা, জেলে-তাঁতি, মুটে-মজুরেরা এসব স্লোগান দেয় না। এসব স্লোগান আমরা শুনি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা রাজনৈতিক দলের মিছিলে-সমাবেশে।
প্রবল পরাক্রান্ত মোগল বাদশাহ জালালুদ্দিন আকবর ‘অপরাধীর’ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে একটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। একটা হাতিকে মদ খাইয়ে মত্ত করা হতো। তারপর দণ্ডিতকে হাত-পা বেঁধে ওই হাতির পায়ের নিচে ছুড়ে ফেলা হতো। বাদশাহ তাঁর সভাসদদের নিয়ে এটা দেখতেন, আমোদ পেতেন। তাঁর ছেলে নুরউদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরও কম যান না। তিনি দণ্ডিত ব্যক্তিকে জীবিত অবস্থায় গাধার সদ্য ছাড়ানো চামড়ায় মুড়ে সেলাই করিয়ে দিতেন। চামড়া যতই শুকায়, সেটি আঁটসাঁট হয়ে ভেতরের মানুষটির ওপর চেপে বসে। তার হাড়গোড় ভেঙে যায়। একসময় সে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। যন্ত্রণা দিয়ে তিলে তিলে মারা।
প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আমাদের স্লোগানগুলো অনেকটা সে রকম। আমরা রাস্তায় নেমে যে কারও বিরুদ্ধে ফাঁসি দাবি করি। আমরা অনেকেই বলি, অমুককে প্রকাশ্যে ফাঁসি বা ফায়ারিং স্কোয়াডে দেওয়া হোক, যাতে আশপাশের লোকেরা এটা দেখে বিনোদন পায়। আমাদের স্লোগানে, বক্তৃতায়, বিবৃতিতে আমরা কল্পিত শত্রুর বিরুদ্ধে এমন সব কথা উচ্চারণ করি, যা হাজার বছর আগের সমাজ-সংস্কৃতিকে মনে করিয়ে দেয়।
আজকাল বক্তৃতায় উত্তেজক কথাবার্তা এবং স্ল্যাং যে যত বেশি ব্যবহার করে, তার জনপ্রিয়তার পারদ ততই ওপরে উঠতে থাকে। হেরে মাইরা ফালামু, তোরে ছিঁড়া ফালামু, ওইডা ভাইঙা ফালামু—এ রকম হুংকার দিলে হাততালি পাওয়া যায়। একশ্রেণির মানুষ তাদের পেছনে ছোটে পঙ্গপালের মতো।
আমি গানবাজনা করি। এতে আমি আনন্দ পাই। আপনার ভালো লাগে না। আপনি গাইবেন না। তাই বলে আপনি আমার ওপর চড়াও হবেন? আপনি রায় দিয়ে দিলেন, এটা ইসলামবিরোধী এবং এর বিরুদ্ধে জিহাদ করা কর্তব্য। আপনি গিয়ে আমার বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে হামলা করলেন, আগুন দিলেন, বাদ্যযন্ত্র লুট করলেন।
এ দেশে পত্রিকার পাঠক হচ্ছে মধ্যবিত্ত। তাদের একটা ভগ্নাংশ পত্রিকা পড়ে। আমার ধারণা, দেশের সব ছাপা পত্রিকার মোট সার্কুলেশন হবে বড়জোর ১০ লাখ। এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি মানুষ নগদ টাকা দিয়ে কেনে। বাকিগুলোর তেমন বাজার নেই। আপনি বলছেন, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকাটি জনগণের দুশমন, অমুকের দালাল, গাদ্দার। তো জনগণ আপনার পছন্দের পত্রিকা পড়ে না কেন—এটা কখনো ভেবে দেখেছেন? আপনি কোন জনগণের কথা বলছেন?
পাঠকের রায়ে তো আপনার অপছন্দের পত্রিকাটিই বেশি জনপ্রিয়। আর আপনি যাদের মধ্যে জনপ্রিয়, তারা তো পত্রিকাই পড়ে না। অথচ আপনি বা আপনারা দলবল উসকে দিয়ে আপনার অপছন্দের পত্রিকার ওপর হামলা চালালেন। সঙ্গে কাকে পেলেন? সমাজের যত চোর-ছেঁচড়-লুটেরা। তারা কম্পিউটার, চেয়ার-টেবিল, টাকাপয়সা লুট করে নিয়ে গেল। তারপর আগুন দিল।
একশ্রেণির লোক সব সময় তক্কে তক্কে থাকে, কখন কোথায় লুটপাট করতে পারবে। সুযোগ পেলেই তারা অন্যের ওপর চড়াও হয়। ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখন তো লুটের মচ্ছব চলছে। তার মধ্যে হাতে গোনা দু-একজন পণ্ডিতকে বলতে শুনি, এদের মব বলা যাবে না। এরা হচ্ছে প্রেশার গ্রুপ। যারা মব বলে, তারা হচ্ছে স্বৈরাচারের দোসর। লুটপাটকে ন্যায্যতা দেওয়ার কী ভয়ংকর চেষ্টা!
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব