Thank you for trying Sticky AMP!!

খাবি খা, তাই বলে কাবিখা?

রকারের নীতিনির্ধারকদের বলব, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এই কাবিখা, কাবিটা, টেস্ট রিলিফসমেত আমাদের সেফটিনেটের যত কর্মসূচি আছে, সব কটিতে নজরদারি বাড়ান

বাংলাদেশ লুৎফর রহমান রিটনের বিখ্যাত ছড়া ‘খিদে’র আবদুল হাইয়ে ভরে গেছে। সেই এরশাদ আমলে রিটন ছড়ায় লিখেছিলেন:

আবদুল হাই
করে খাই খাই
এক্ষুনি খেয়ে বলে
কিছু খাই নাই।

এই দেশে আবদুল হাইয়েরা রব তুলছে: খাই খাই। কত ধরনের খেকোতে দেশটা ভরে গেছে। বনখেকো, বালুখেকো, নদীখেকো, মাটিখেকো, ব্যাংকখেকো! কী খায় না এরা! আমরা কত কাহিনি পড়ছি, কত খবর পড়ছি, কত খবর শুনছি, আর দেখছি!
ঠিকানাবিহীন সংস্থা ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে, এবং তারপর পালিয়ে যাচ্ছে বিদেশে, খাঁচাও নেই, পাখিও নেই। টাকা তো সবার আগে উড়ে গেছে দূর দেশে। এই দেশে বালিশ আর পর্দা কেনার বিল হয়েছে কয়েক হাজার থেকে কয়েক লাখ টাকা, প্রতিটার জন্য; আর সেই বালিশ নিচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত তোলার জন্য আবার বালিশপ্রতি বরাদ্দ হয়েছে শত শত টাকা। এই দেশে করোনা টেস্ট না করে হাসপাতাল থেকে ইচ্ছেমতো পজিটিভ-নেগেটিভ রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে করোনা-অতিমারির সেই ভয়াল দিনগুলোতে।

বছর দুয়েক আগে টেলিভিশনে খবরে দেখলাম, উত্তরার একটি ফ্ল্যাটবাড়িতে মেঝেতে বসে পরিচারিকারা ক্যাপসুলের ক্যাপে মাটি ভরছেন, সুন্দর প্যাকেটে সুন্দর কৌটায় সেগুলো পোরা হচ্ছে, সেগুলো চলে যাচ্ছে শহরের সবচেয়ে নামী ওষুধের দোকানে, বিক্রি হচ্ছে বিদেশ থেকে আমদানি করা ভিটামিন হিসেবে। কী সর্বনাশের কথা! বাংলার আবদুল হাইদের হাতজোড় করে বলি, আপনারা নকল করবেন, করুন; কিন্তু দয়া করে এমন সব পণ্য নকল করবেন না, যা আমাদের প্রাণ বাঁচায়, বা যে নকলটা ব্যবহার করলে আমাদের প্রাণ যায়।

উদাহরণ দিয়ে বলি। আপনারা যদি বড় কোম্পানির জুতা-স্যান্ডেল নকল করেন তাতে আমরা দাম দিয়ে জুতা-স্যান্ডেল কিনে প্রতারিত হব, কিন্তু মারা যাব না। আপনি যদি কলম-পেনসিল নকল করেন, কাপ-পিরিচ নকল করেন, সে আঘাত হয়তো সহ্য হবে; কিন্তু যে অ্যান্টিবায়োটিক মানুষ সেবন করে জীবন বাঁচাতে, তা নকল করে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবেন না। শিশুদের প্যারাসিটামল সিরাপ নকল করে শত শিশুর মৃত্যু ঘটাবেন না।

Also Read: কাজ হয়নি কিছুই, টাকা তোলা শেষ

আবদুল হাইয়েরা সব খাচ্ছে। তারা ট্যাংক খাচ্ছে, ব্যাংক খাচ্ছে; আলু খাচ্ছে, বালু খাচ্ছে; গদি খাচ্ছে, নদী খাচ্ছে; রেল খাচ্ছে, তেল খাচ্ছে; খাচ্ছে তো, আমরা তো প্রতিবাদও করছি না। চিঁচিঁ করি কেউ কেউ। মৃদু গলায়। শালিক পাখির ছানার মতো। তাতে তো আবদুল হাইদের কোনো অসুবিধা হয় না। তারা আরামেই থাকেন। আরামেই ঘুমান।

কিন্তু তাই বলে কাবিখা! কাবিটা! টিআর! কাজের বিনিময়ে খাদ্য, কাজের বিনিময়ে টাকা, টেস্ট রিলিফ। প্রথমে একটা খবর পড়ুন: ‘কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের গোড়াই পাঁচপীর মিয়াজিপাড়া কবরস্থান সংস্কারের জন্য সরকারি বরাদ্দ দেখানো হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। প্রকল্পের বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে গোড়াই পাঁচপীর মিয়াজিপাড়া মসজিদ কমিটির হিসাবরক্ষক আবদুর রহিম বলেন, ‘কবরস্থান সংস্কারের কোনো বাজেট আমরা পাইনি। গত এক বছরে কবরস্থানের কোনো সংস্কারকাজও হয়নি।’

‘উলিপুর উপজেলা ঘুরে এই প্রকল্পের মতো এমন কিছু প্রকল্প পাওয়া গেছে, যেগুলোর কাজ কাগজে-কলমে সমাপ্ত। গত জুন মাসের মধ্যে এসব প্রকল্পের জন্য বরাদ্দের টাকাও তুলে নেওয়া হয়েছে। অথচ বাস্তবে এসব প্রকল্পের কোনো কাজই শুরু হয়নি।’ (কুড়িগ্রামে টিআর, কাবিখা: কাজ হয়নি কিছুই, টাকা তোলা শেষ, প্রথম আলো, ২২ ডিসেম্বর, ২০২২)।

এ ধরনের খবর সহযোগী গণমাধ্যমগুলোতে আরও অনেকগুলোই দেখতে পাওয়া যাবে। আপনারা বলতে পারেন, শতকোটি টাকা লোপাট হচ্ছে, হাজারকোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে দেশ থেকে পালাচ্ছে বিখ্যাত দুর্বৃত্তরা। অপ্রয়োজনীয় সেতু, ভবন, স্টেডিয়াম, সুইমিংপুল বানিয়ে শত শত কোটি টাকা অপচয় করা হচ্ছে। আমাদের পরিবেশ নষ্ট, শ্রমঘণ্টা নষ্ট, রাস্তায় যানজট, বাতাসে ধূলিকণা, ডিজেল-পেট্রল পোড়া কার্বন—এসবের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি শত শত অনাবশ্যক, অহেতুক, অব্যবহার্য কাঠামো। সেসব নিয়ে চিৎকার না করে এই কয়েক লাখ টাকার কাজের বিনিময়ে খাদ্য বা কাজের বিনিময়ে টাকা কিংবা টেস্ট রিলিফ নিয়ে কেন আমি মাতম করছি! কেন বলছি, ও আবদুল হাই, খাবি খা, তাই বলে কাবিখা?

কারণটা হলো, এই কর্মসূচিগুলো শুধু এলাকায় কতগুলো উন্নয়নকাজের জন্যই দেওয়া হয় না। একটা রাস্তায় মাটি ফেলা, একটা পুকুর বা খাল পুনর্খনন করা, কবরস্থান উঁচু করা, কচুরিপানা পরিষ্কার করার মতো কাজগুলো সম্পন্ন করার পাশাপাশি এই প্রকল্প/কর্মসূচির পেছনে আসল উদ্দেশ্য আকালের দিনে গরিব, বেশি গরিব মানুষদের পাশে থাকা।

Also Read: আমরা কেবল দুর্নীতিবাজ নই, আমরা অদক্ষও

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার সরকারি ওয়েবসাইটে এই কর্মসূচিগুলোর উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে বলা আছে: ‘গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের মাধ্যমে আয়বৃদ্ধি, খাদ্যনিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সেই সাথে এলাকার উন্নয়ন এ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য। উপজেলা কমিটি প্রাপ্ত বরাদ্দ অনুযায়ী পরিপত্র মোতাবেক ইউনিয়ন কমিটির মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। সেই সাথে মাননীয় সংসদ সদস্যদের অনুকূলে বরাদ্দ প্রাপ্ত খাদ্যশস্য/টাকা সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়।’

আমি সরকারি ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি দিচ্ছি: ‘বাংলাদেশে নদী ভাঙন, চরাঞ্চল, মঙ্গাপীড়িত এলাকার অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অধিক। তারা বছরের অধিকাংশ সময়ে বেকার থাকে এবং তাদের উপার্জনের সুযোগ থাকে না। তারা অক্টোবর হতে ডিসেম্বর এবং মার্চ হতে এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৫ মাস সময়ে বেকার/কর্মহীন থাকে। তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, সেই সাথে সংশ্লিষ্ট এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা এ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য।...... এ কর্মসূচির আওতায় গৃহীত প্রকল্পসমূহ প্রকল্প কমিটির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। প্রতিটি শ্রমিক দৈনিক ৭ (সাত) ঘণ্টা কাজের বিনিময়ে ১৭৫ টাকা মজুরি পেয়ে থাকেন। প্রতিটি শ্রমিকের সংশ্লিষ্ট এলাকার ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে তাদের পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। শ্রমিকগণ সপ্তাহে ৫ দিন কাজ করে প্রতি বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হতে মজুরি গ্রহণ করেন।’

সরকারের নীতিনির্ধারকদের বলব, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এই কাবিখা, কাবিটা, টেস্ট রিলিফসমেত আমাদের সেফটিনেটের যত কর্মসূচি আছে, সব কটিতে নজরদারি বাড়ান, তদন্ত করুন। আত্মসাৎ, চুরি, অনিয়মের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন। গরিবের চাল-গম যারা খায়, তাদের করুণা দেখানোও ভয়াবহ পাপ।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে কোন এলাকায় কত বরাদ্দ হয়েছে, তা বিস্তারিতভাবে দেওয়া আছে। এখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার সরেজমিন প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, যেসব কাজের জন্য এই বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেসব কাজ অনেক ক্ষেত্রে একেবারেই করা হয় না। কাজটা করা হচ্ছে না বলে আমি চুল ছিঁড়ছি না, আমার দুঃখ এই যে এলাকাগুলোর দরিদ্র মানুষ, অতিদরিদ্র মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে খাওয়া হচ্ছে। মঙ্গার সময়ে, বেকারির সময়ে মানুষ কাজ পাবে, পারিশ্রমিক পাবে, খাবার পাবে, এর ফলে অঞ্চলবিশেষে খাদ্য-সংকট দূর হবে, মানুষের কর্মসংস্থান হবে—সেই আসল উদ্দেশ্যটাই মাঠে মারা যায়; যখন একেবারেই কাজ হয় না। যাদের জন্য এই খাদ্য বরাদ্দ, টাকা বরাদ্দ, তারাই যদি এই খাদ্য বা টাকা না পান; তাহলে এই মহৎ কর্মসূচির পুরোটাই জলে যায়! অথচ সরকার কেন্দ্রে বসে ভাবেন, আমরা তো ব্যবস্থা নিচ্ছি; আমরা তো এলাকায় এলাকায় চাল, গম, টাকা পাঠিয়েছি!

তা-ই সরকারের নীতিনির্ধারকদের বলব, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এই কাবিখা, কাবিটা, টেস্ট রিলিফসমেত আমাদের সেফটিনেটের যত কর্মসূচি আছে, সব কটিতে নজরদারি বাড়ান, তদন্ত করুন। আত্মসাৎ, চুরি, অনিয়মের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন। গরিবের চাল-গম যারা খায়, তাদের করুণা দেখানোও ভয়াবহ পাপ। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া মহাপাপ বলে গণ্য হওয়া উচিত। কেবল দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই পারে এই অন্যায়-দুর্নীতির পুরোনো আচারটি বন্ধ করতে।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক