বিবিসির সাবেক মহাপরিচালক টিম ডেভি
বিবিসির সাবেক মহাপরিচালক টিম ডেভি

মতামত

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণের মুখে বিবিসি

পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে বিবিসির মহাপরিচালক টিম ডেভির পদত্যাগ করা একটি বড় ধাক্কা। এটি এমন সময়ে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ে শূন্যতা তৈরি করল, যখন নেতৃত্বের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। ডেভি জোর দিয়ে বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত একান্তই তাঁর নিজের; বোর্ড, ডানপন্থী রাজনীতিক ও সংবাদমাধ্যমের সমন্বিত আক্রমণে নেতৃত্ব দেওয়া অনেকেই এটি প্রত্যাশা করেনি। এখন ডেভি ও বিবিসি নিউজের সিইও ডেবোরাহ টারনেস—উভয়ের পদত্যাগ দেখিয়ে দিল, চাপ প্রয়োগ করলে ফল পাওয়া যায়।

সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হলো, এই পুরো ঘটনা শুরু হয়েছিল মাত্র এক সপ্তাহ আগে, যখন টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত হলো মাইকেল প্রেসকটের তৈরি ১৯ পাতার একটি ‘বিধ্বংসী নথি’। প্রেসকট একজন সাবেক রাজনৈতিক সাংবাদিক, যিনি তিন বছর বিবিসির বাহ্যিক উপদেষ্টা ছিলেন। ওই নথিতে অভিযোগ করা হয়, বিবিসি প্যানোরামা ট্রাম্পের এক ভাষণকে এমনভাবে সম্পাদনা করেছে, যেন মনে হয় তিনি ৬ জানুয়ারির দাঙ্গাকারীদের সমর্থন করছেন; বিবিসি আরবি সার্ভিস হামাসপন্থী দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিচ্ছে এবং বিবিসির কিছু এলজিবিটিকিউ কর্মী যৌনতা ও লিঙ্গ–সংশ্লিষ্ট কাভারেজে অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তার করছে।

টেলিগ্রাফ লিখেছে, বিবিসির নীরবতাই ‘গুরুতর সমস্যার প্রমাণ’। এরই মধ্যে বিবিসি সাংবাদিক নিক রবিনসনকে আক্রমণ করে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের দেওয়া ‘বিস্ফোরণধর্মী মন্তব্য’ মেইল অন সানডের শিরোনাম হয় এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেস সেক্রেটারি বিবিসিকে বলেন ‘১০০ শতাংশ ভুয়া সংবাদ’।

বিবিসির নির্দিষ্ট সংবাদ কাভারেজে ভুল বা ব্যর্থতার অভিযোগ ও গত এক সপ্তাহে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরতে বিবিসির অদ্ভুত অক্ষমতা বা অনিচ্ছাকে কিছুটা সরিয়ে রাখা যাক। আসল সমস্যা হলো, এগুলো একটি রাজনৈতিক অভিযানের অংশ, যার লক্ষ্য হলো বিবিসিকে বিভ্রান্ত করা এবং দুর্বল করা; এটি একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ যে কীভাবে সত্য ও নিরপেক্ষতার চেষ্টা করা সাংবাদিকতাকে আক্রমণ করে অচল করা যায়, বিশেষ করে যখন তথ্যবিকৃতি ও প্রচারের সাগরে সবাই ডুবে আছে।

প্রেসকট ভূমিকার শুরুতেই বলেছেন, তিনি কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না এবং তাঁর মতামত ‘কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বহন করে না’। অথচ তাঁর প্রতিটি সমালোচনাই আসে প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে ‘সাংস্কৃতিক যুদ্ধের’ মতো রাজনীতি থেকে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি ‘আশ্চর্য’ হয়েছেন কেন ট্রাম্প ও ৬ জানুয়ারির বিদ্রোহ নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী প্যানোরামা ডকুমেন্টারির পর ট্রাম্পের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে নিয়ে ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ’ আরেকটি অনুষ্ঠান হয়নি। নিরপেক্ষতা নিয়ে বহুদিন কাজ করা একজন আমাকে বলেছেন, এটি নিরপেক্ষতার সম্পূর্ণ ভুল–বোঝাবুঝি, এমন ব্যাখ্যা যেটির কারণে একসময় জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকারকারীদেরও মঞ্চে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

প্রেসকট আরও অভিযোগ করেন যে বিবিসি ‘বর্ণবাদ’ সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে বেশি প্রচার করে। অথচ তিনি নিজেই যেসব উৎস উল্লেখ করেন, সেগুলো তাঁর নিরপেক্ষতার দাবি দুর্বল করে। এটি বলার অর্থ এই নয় যে বিবিসির কোনো ভুল নেই। অন্ততপক্ষে প্যানোরামা ডকুমেন্টারিতে ট্রাম্পের ভাষণের একটি খারাপ এবং বিভ্রান্তিকর সম্পাদনা ছিল, যা অগ্রহণযোগ্য। বিবিসি  এ বিষয়ে ক্ষমা চাইবে বলে জানা গেছে, এটাই যথেষ্ট হওয়া উচিত ছিল।

কঠিন সময় চলছে বিবিসির জন্য। দশকের বেশি সময় ধরে লাইসেন্স ফি কমানোর পর এখন তারা চার্টার নবায়নের আলোচনায় যাচ্ছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপও বাড়ছে। বিবিসির বিরুদ্ধে ট্রাম্পের মামলার হুমকি আসে এমন এক প্রেক্ষাপটে, যখন যুক্তরাষ্ট্রে তিনি বড় বড় বাণিজ্যিক সম্প্রচারমাধ্যমকে সামান্য অভিযোগের ভিত্তিতে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করেছেন। বিবিসিকে অবশ্যই সরকারের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে স্বাধীন থাকতে হবে—কিন্তু তা করতে হলে তাদের প্রয়োজন সবার আস্থা বজায় রাখা। ডেভি তাঁর পদত্যাগপত্রে বিবিসিকে রক্ষা করার আবেদন জানান। মনে হচ্ছে, এই আবেদন ইতিমধ্যে দেরিতে এসেছে।

  • জেন মার্টিনসন সিটি সেন্ট জর্জস–এর ফিন্যান্সিয়াল জার্নালিজমের অধ্যাপক

    গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত