আমার ঘুম হচ্ছে না। কথার কথা না। আক্ষরিক অর্থেই কয়েক দিন ধরে রাতে দুই তিন ঘণ্টার বেশি ঘুম হচ্ছে না। মন ছটফট করছে। তীব্র অস্থিরতায় আছি।
যে আমাকে এই মহা যন্ত্রণায় ফেলে দিয়েছে, সে বারো-তেরো বছরের একটি ছেলে। আমি তার নাম জানি না। জানার উপায়ও নেই। কারণ সে কথা বলতে পারে না।
সে কোত্থেকে এসেছে, তার বাড়ি কোথায়, বাবা-মা আছে কিনা, খেয়েছে কি খায়নি; খেতে চায় নাকি চায় না—এসব ইশারা ইঙ্গিতে যে সে বোঝাবে, তাও সম্ভব না।
কারণ ইশারায় বোঝাতে যে জ্ঞানবুদ্ধি দরকার, তাও তার নেই। সে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। অটিস্টিক।
যেহেতু তার নাম জানার কোনো উপায় নেই, যেহেতু দুনিয়ার কোনো পাপ তাকে স্পর্শ করেনি, সেহেতু মনে মনে তার নাম দিয়েছি ‘ফেরেশতা’।
শিশুটিকে প্রথম দেখি দিন দশেক আগে। কমলাপুর স্টেশনের ওপর দিয়ে যাওয়া যে লোহার ওভারব্রিজ কমলাপুর এলাকার সঙ্গে মুগদা বা সবুজবাগের সংযোগ ঘটিয়েছে, তার ওপর। তার গায়ে তখন সুঁতোটিও ছিল না। হালকা পাতলা গড়নের দেহ। গায়ে ধুলোর আস্তরণ তখন খুব বেশি ছিল না।
কমলাপুর স্টেশনের আশপাশে বহু পথশিশু পথে থাকে। পথেই ঘুমায়। সারা গায়ে কালিঝুলি থাকে। তারা সাধারণত একা থাকে না। জোট বেঁধে থাকে। বিড়ি টানে বেধড়ক; পলিথিনে ভরা আঠা জাতীয় নেশার ‘ড্যান্ডি’ খায়। তাঁদের খবর রাখার সময় কারও নেই।
কিন্তু এই শিশুটির সঙ্গে কেউ ছিল না। সে একা দাঁড়িয়ে ছিল। যেতে যেতে তার মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম। তার দৃষ্টি ছিল ফাঁকা। আমার সঙ্গে আই-কন্টাক্ট হলো না।
ওর চেহারার সঙ্গে আমার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বড় ছেলের চেহারায় যেন অদ্ভুত মিল থাকায় হাঁটতে হাঁটতে তাকে চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম।
দিন দুই বাদে রাত দশটার দিকে একই পথে যাচ্ছি। দেখি একটা ছোট্ট গোলাকার ভিড়। দেখি ধুলোয় শিশুটি পড়ে আছে। এক ভদ্রমহিলা তাকে জাগানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
মনে হলো, সে মারা গেছে। আমি তাঁর হাত ধরে নাড়ি পরীক্ষা করলাম। দেখলাম, সে বেঁচে আছে। বেশ কিছুক্ষণ পর তার জ্ঞান ফিরল। সে চোখ মেলল।
পাশ দিয়ে যাওয়া কেউ একজন বললেন, ‘ভাই, বাদ দেন। ওর কিচ্ছু হয় নাই, নেশা করে পড়ে আছে। ওরা মরে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
তখন একজন জানালেন, ছেলেটা প্রতিবন্ধী। সে কথা বলতে পারে না। মনে হয় আত্মীয়স্বজন এখানে ফেলে দিয়ে গেছে।
তখন মনে হলো, দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার কারণে সম্ভবত সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সামান্য পানি আর একটু রুটি খাওয়ানোর পর সে কিছুটা সুস্থ হলো বলে মনে হলো।
এরপর রাস্তার ‘ফেরেশতা’কে রাস্তায় রেখে বাসায় এলাম। সারা রাত ঘুম হলো না।
দুই তিন দিন পর এক সকালে দেখি সে মুগদা হাসপাতালের কাছে রাস্তায় দাঁড়ানো। যথারীতি গায়ে কাপড় নেই। তার সারা গায়ে পুরু ধুলোর আস্তরণ। ময়লা কালিতে মুখও ছাইয়ের মতো হয়ে গেছে।
তাকে বাসায় নিয়ে এলাম। আমার স্ত্রী পোশাক পরিয়ে প্লেটে ভাত মেখে দিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ সে ভাত নাড়াচাড়া করল। কিন্তু খেতে পারল না। তবে হাতে তুলে খাইয়ে দিলে সে ভাত খেতে পারে।
আমাদের দুজন অটিস্টিক সন্তান আছে। দুই প্রতিবন্ধী সন্তান লালনপালনের অভিজ্ঞতা থেকে আমার স্ত্রী আমাকে বললেন, ‘এই ছেলেকে তার বাবা মা ফেলে যায়নি, সে আসলে হারিয়ে গেছে। এতটা বয়স পর্যন্ত ওর বেড়ে উঠতে সার্বক্ষণিক সেবা দরকার হয়েছে। এই সেবা দিয়ে যে তাকে এত বড় করেছে, সে তাকে ফেলে যাবে, তা হওয়ার কথা না। সম্ভবত ট্রেনে স্টেশনে নামার পর বাবা মায়ের কাছ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।’
শিশুটির খাওয়ার ধরন ও শরীরী ভাষা থেকে আমার স্ত্রী বুঝতে পেরেছেন, সে তার মা বা অন্য কারও হাতে খেতে অভ্যস্ত।
এখন যেহেতু কেউ পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে সে দিক ভোলা হরিণশিশুর মতো এদিকে ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে।
সেদিন তাকে মিনিট খানিকের জন্য কোলে তুলেছি। সে কোলে উঠে আমাকে হতভম্ব করে অস্পষ্টভাবে বলেছে, ‘আ...ব...বা!’ এরপর স্বাভাবিকভাবে ঘুমানো কঠিন। বিছানায় শুতে গেলে মনে হচ্ছে, বাচ্চাটি কোথায় কোন রাস্তায় ধুলোর মধ্যে এখন নেতিয়ে পড়ে আছে।
গত তিন চার দিনে ‘ফেরেশতা’ আমাকে সম্ভবত কিছুটা চিনতে পেরেছে। কাছে গেলে সে দুই তিন বছরের বাচ্চার মতো আবেগ নিয়ে কোলে উঠতে চায়।
সেদিন তাকে মিনিট খানিকের জন্য কোলে তুলেছি। সে কোলে উঠে আমাকে হতভম্ব করে অস্পষ্টভাবে বলেছে, ‘আ...ব...বা!’
এরপর স্বাভাবিকভাবে ঘুমানো কঠিন। বিছানায় শুতে গেলে মনে হচ্ছে, বাচ্চাটি কোথায় কোন রাস্তায় ধুলোর মধ্যে এখন নেতিয়ে পড়ে আছে।
আমার নিজের ঘরে দুজন ‘ফেরেশতা’ আছে। তাদের দেখাশোনাই কঠিন। সে কারণে তৃতীয় ফেরেশতাকে বাসায় নিয়ে আসার মতো বাস্তবতা নেই।
দেশে কত হাজার নিষ্পাপ বাচ্চা এভাবে রাস্তায় পড়ে আছে জানি না। কিন্তু এই বাচ্চাটিকে তার স্বজনদের কাছে পৌঁছানোর বড় ইচ্ছে হচ্ছে। হয়তো তার মা বাবা তাকে হারিয়ে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেছে।
বাচ্চাটিকে জামা প্যান্ট পরিয়ে দিলেও সে এক সময় খুলে ফেলে। সম্ভবত বাথরুম পাওয়ার পর সে সব খুলে ফেলে। আর পরতে পারে না।
কয়েক দিনের মধ্যে রাতে শীত পড়া শুরু হবে। তখন তার ক্রমশ হাড়সর্বস্ব হতে থাকা উলঙ্গ শরীর সেই শীত সইতে পারবে না। তার আগেই তার পরিবারের কাছে পৌঁছানো দরকার। তা পারা না গেলে তার একটি নিরাপদ আশ্রয় দরকার।
বাস্তবতা হলো, এই দুটো ব্যবস্থাই আমার সাধ্যের বাইরে। কিন্তু ইচ্ছেটা আছে। পাঠকের দিক থেকে এই লেখাটির সর্বোচ্চ শেয়ার ও আন্তরিক দোয়া সেই ইচ্ছে পূরণে হয়তো সহায়ক হবে।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ইমেইল: sarfuddin2003@gmail.com