
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মধ্য এশিয়ায় রাশিয়া তার প্রভাবের বড় অংশটি হারিয়েছে। আসন্ন মাস ও বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি বাড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু চীন যেহেতু মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, সে ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বেইজিং কীভাবে দেখছে?
কাকতালীয়ভাবে হোক আর যা–ই হোক, ৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয় দেশই মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছে। ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের প্রেসিডেন্টদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। একই দিনে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের রাজধানী উরুমচিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে ১২তম চীন-মধ্য এশিয়া সহযোগিতা ফোরামের বৈঠক।
যদিও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত সম্মেলনকে বেশি গুরুত্ব দেয়। তবে জিনজিয়াং প্রদেশের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত সম্মেলন এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে মধ্য এশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বাড়ালেও হাল ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা নেই চীনের। উরুমচির সম্মেলনের পর মন্ত্রী পর্যায়ের বেইজিংয়ে চীন-মধ্য এশিয়া অবকাঠামো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন ইঙ্গিত দেয় যে চীনের নেতারা ইউরেশিয়ায় সড়ক, সেতু ও রেল নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে আসবে না।
বিআরআইয়ের (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে মধ্য এশিয়ার শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার ও প্রধান বিনিয়োগকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে চীন। ট্রাম্প যখন মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে ওয়াশিংটনের প্রভাববলয়ে আনার চেষ্টা করছেন, তখন চীন অবশ্যই অলস বসে থাকবে না।
যদিও উরুমচি ও বেইজিংয়ের সম্মেলনগুলো আগে থেকেই নির্ধারণ করা হয়েছিল, কিন্তু যে সময়ে তা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে একটি পরিষ্কার বার্তা আছে। সেটি হলো চীন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং মধ্য এশিয়ায় নিজেকে প্রধান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
মধ্য এশিয়ার জ্বালানি সম্পদ ওয়াশিংটনের মতো বেইজিংয়ের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। চীন জ্বালানির জন্য শুধু একক সরবরাহকারী বা রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল থাকতে চায় না। সে কারণে জ্বালানি আমদানির বৈচিত্র্যময় উৎস নিশ্চিত করতে চায় দেশটি। চীনের জ্বালানিকৌশল নির্ধারণে তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ কাজাখস্তান ও তুর্কমেনিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
চীনের জন্য আরেকটি সমস্যা হলো মধ্য এশিয়ার জ্বালানি সম্পদ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও একই রকম উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। রাশিয়ার ওপর জ্বালানিনির্ভরতা সীমিত করার প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে তাদের তেল ও গ্যাসের প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে দেখছে।
এই খেলায় প্রশ্নাতীতভাবে সবচেয়ে বড় পরাজয় হবে রাশিয়ার। যে অঞ্চলটি ঐতিহ্যগতভাবে রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রভাবক্ষেত্র ছিল, সেটি এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নতুন প্রতিযোগিতার মঞ্চে রূপান্তরিত হচ্ছে। যদিও ওয়াশিংটন ও বেইজিং মধ্য এশিয়ায় ভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করছে, তবু দুইয়ের মধ্যে অন্তত একটি বিষয় মিল রয়েছে।
একই সঙ্গে বিরল খনিজের উৎস হিসেবেও বিবেচনা করছে। ট্রাম্পও যখন একই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছেন, তখন চীনের জন্য ঝুঁকি বাড়ছে। কেননা ট্রাম্প মধ্য এশিয়া সম্মেলনে ঘোষণা করেন, ‘আমাদের এই কর্মসূচির অন্যতম প্রধান বিষয় হলো বিরল খনিজ পদার্থ।’
অন্যদিকে চীনও বিরল খনিজের দিকে নজর রাখছে এবং জ্বালানি রূপান্তরে এর কৌশলগত গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আসন্ন দিনগুলোতে এই গুরুত্বপূর্ণ বিরল খনিজ সম্পদ নিয়ে ভূরাজনৈতিক যুদ্ধ শুরু হবে বলে মনে করা হচ্ছে। মধ্য এশিয়া এই প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে থাকবে।
এই খেলায় প্রশ্নাতীতভাবে সবচেয়ে বড় পরাজয় হবে রাশিয়ার। যে অঞ্চলটি ঐতিহ্যগতভাবে রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রভাবক্ষেত্র ছিল, সেটি এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নতুন প্রতিযোগিতার মঞ্চে রূপান্তরিত হচ্ছে। যদিও ওয়াশিংটন ও বেইজিং মধ্য এশিয়ায় ভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করছে, তবু দুইয়ের মধ্যে অন্তত একটি বিষয় মিল রয়েছে।
দুই শক্তির জন্যই ট্রান্স-কাস্পিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট রুটটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিডল করিডর নামে পরিচিত এই পথটি রাশিয়াকে পাশ কাটিয়ে মধ্য এশিয়া, কাস্পিয়ান সাগর ও দক্ষিণ ককেশাশ হয়ে চীন থেকে ইউরোপে যাতায়াত ও বাণিজ্যের পথ। এই পথটি রাশিয়াকে পাশ কাটিয়ে পণ্য, জ্বালানি ও খনিজ পরিবহনের বিকল্প পথ। যোগাযোগব্যবস্থায় আধুনিকায়নে সহায়তা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন কার্যত মধ্য এশিয়ায় রাশিয়াকে কার্যকরভাবে প্রান্তিক করেছে, একই সঙ্গে নিজেদেরকে অঞ্চলটির প্রভাবশালী বাইরের শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে, মধ্য এশিয়ার বেশির ভাগ দেশই বহুমুখী কূটনৈতিক নীতি অনুসরণ করেছে। দেশগুলো রাশিয়া, চীন ও পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে। বর্তমান বিশ্ব যখন খুব দ্রুত নতুন ধরনের শীতল যুদ্ধের যুগে প্রবেশ করছে, তখন এ ধরনের রাজনৈতিক কৌশলের জায়গা যথেষ্ট সীমিত হয়ে পড়েছে।
মধ্য এশিয়ার দেশগুলো এখন পর্যন্ত নিজেদের ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি চালিয়ে যেতে পারছে। কিন্তু ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবে বলছে, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি মেনে তারা বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে চায়। ফলে এই দেশগুলো দীর্ঘ মেয়াদে বেইজিং অথবা ওয়াশিংটন যেকোনো একটি পক্ষকে বেছে নিতে বাধ্য হবে। এ সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে না।
নিকোলা মিকোভিচ সার্বিয়ায় বসবাসকারী ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, গবেষক ও বিশ্লেষক
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত