ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো

মতামত

মাদুরোকে সরাতে সিআইএ কেন রাখঢাক করছে না

গত শনিবার (২২ নভেম্বর) রয়টার্স একটি এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র খুব শিগগির ভেনেজুয়েলাকে কেন্দ্র করে নতুন ধরনের অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে। চারজন মার্কিন কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তাঁরা সবাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে এ কথা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন জানান, প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোর বিরুদ্ধে এই ‘নতুন পদক্ষেপের’ প্রথম ধাপ হবে গোপন অভিযান।

খবরটি খুব একটা বিস্ময়কর কিছু নয়। কারণ, এর প্রায় এক মাস আগেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই ঘোষণা করেছিলেন, তিনি সিআইএকে ভেনেজুয়েলায় গোপন অভিযান চালানোর অনুমতি দিয়েছেন। সাধারণত গোপন অভিযানের কথা প্রকাশ্যে বলা হয় না। তাই বিষয়টি বেশ অস্বাভাবিক। এদিকে এটা আর কোনো গোপন খবর নয় যে যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে পুরো অঞ্চলে বড় ধরনের সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে।

‘নার্কোটেররিজম’ দমনের অজুহাতে সেখানে এখন ১৫ হাজারের মতো মার্কিন সেনা মোতায়েন আছে। গত সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে ট্রাম্প ক্যারিবিয়ান সাগরে বিচারবহির্ভূত হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি দাবি করেছেন, এসব নৌকা মাদক পাচার করছিল। তিনি বারবার ওই নৌকাগুলোয় বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। এই হামলাগুলো আন্তর্জাতিক আইন ও মার্কিন আইন—উভয় আইনেরই লঙ্ঘন। তবে বাস্তবে এগুলো কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি; বরং তা স্থানীয় জেলেদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে।

আসল কথা হলো, যুক্তরাষ্ট্র কখনো এমন ‘মাদকবিরোধী যুদ্ধ’ দেখেনি, যেটাকে তারা ভালোবাসে না। কারণ, এই ‘ড্রাগ-ওয়ার’-এর গল্পকে ব্যবহার করে তারা বিশ্বজুড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে, লাতিন আমেরিকা-ক্যারিবিয়ান অঞ্চলকে সামরিকীকরণ করতে পারে, দরিদ্র মার্কিন নাগরিকদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। এ ধরনের যুদ্ধ থেকে তারা আরও অনেক সুবিধা পায়।

মজার ব্যাপার হলো, মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসা থেকে লাভ করে আসছে। আর দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর একটি প্রতিবেদনে সরাসরি বলা হয়েছে, ‘সিআইএর সঙ্গে মাদকের সম্পর্ক এজেন্সি প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই চলে আসছে।’ তাই এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, যে প্রেসিডেন্ট তাঁর নির্বাচনী প্রচারে বলেছিলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে জড়াবেন না, সেই তিনি ক্ষমতায় এসে ইরানে বোমা হামলা চালিয়েছেন এবং এখন আবার নতুন এক সংঘাতে দেশটিকে জড়িয়ে ফেলছেন।

ভেনেজুয়েলাকে লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্র যে যুক্তিগুলো দিচ্ছে, সেগুলোর ভিত্তিও দুর্বল। উদাহরণ হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের ফেন্টানিল সংকটের জন্য মাদুরোকে দায়ী করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভেনেজুয়েলা ফেন্টানিল উৎপাদনই করে না। এনবিসি নিউজসহ মূলধারার বেশ কিছু গণমাধ্যম জানিয়েছে, ভেনেজুয়েলার মাদক চক্রগুলো ইউরোপে কোকেন পাঠাতেই ব্যস্ত; তারা যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিল পাচার করে না।

মাদুরো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওরও বিশেষ টার্গেট। ধারণা করা হয়, ভেনেজুয়েলায় মার্কিন যুদ্ধ-পরিকল্পনার মূল নকশাকার রুবিও। তিন বছর পর যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাতে রুবিও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। তাই তিনি ফ্লোরিডার ভোটারদের (যেখানে ভেনেজুয়েলা ও কিউবা থেকে আসা অভিবাসী কট্টর ডানপন্থীরা রয়েছেন) খুশি করার চেষ্টা করছেন।

এরপরও ১৩ নভেম্বর মার্কিন প্রতিরক্ষাসচিব পিট হেগসেথ (সরকারি ভাষায় তাঁকে এখন ‘ওয়ার সেক্রেটারি’ বা ‘যুদ্ধমন্ত্রী’ বলা হয়) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ভেনেজুয়েলা উপকূলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মিশনের অংশ। তাঁর দাবি, এটি ‘আমাদের স্বদেশ রক্ষা করে, আমাদের গোলার্ধ থেকে নার্কো-টেররিস্ট সরিয়ে দেয় এবং যে মাদক আমাদের জনগণকে হত্যা করছে, তা থেকে দেশকে সুরক্ষা দেয়।’

এই যে ট্রাম্প প্রশাসন ভেনেজুয়েলা নিয়ে বড় বড় কথা বলছে, তারাই আবার কিছুদিন আগে দারিদ্র্যপীড়িত মার্কিন নাগরিকদের খাদ্য সাহায্য বন্ধ করার হুমকি দিয়েছিল। এতে বোঝা যায়, ‘আমাদের জনগণের কল্যাণ’-এ তাদের তেমন আগ্রহ নেই।

মাদুরো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওরও বিশেষ টার্গেট। ধারণা করা হয়, ভেনেজুয়েলায় মার্কিন যুদ্ধ-পরিকল্পনার মূল নকশাকার রুবিও। তিন বছর পর যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাতে রুবিও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। তাই তিনি ফ্লোরিডার ভোটারদের (যেখানে ভেনেজুয়েলা ও কিউবা থেকে আসা অভিবাসী কট্টর ডানপন্থীরা রয়েছেন) খুশি করার চেষ্টা করছেন।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মাদুরোকে উৎখাত করা’ যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচিত বিকল্পগুলোর একটি। যদি সত্যিই এমন পরিকল্পনা সফল হয়, তাহলে রুবিও–ও সেই দীর্ঘ মার্কিন রাজনীতিকদের তালিকায় যুক্ত হবেন, যাঁরা দেশে রাজনৈতিক সুবিধা পেতে বিদেশে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন।

সব মিলিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ভেনেজুয়েলাকে লক্ষ্য করে যে গোপন না হওয়া গোপন পরিকল্পনা চালিয়ে যাচ্ছে, তা শুধু পুরো আমেরিকা মহাদেশে অস্থিতিশীলতাই বাড়াবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্য কোনো দেশই নিরাপদ হবে না।

  • বেলেন ফার্নান্দেজ আল–জাজিরার কলাম লেখক

    আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ : সারফুদ্দিন আহমেদ