পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির

মতামত

পাকিস্তান কি আরও স্বৈরশাসনের পথে হাঁটছে

তিন বছরের বেশি সময় ধরে পাকিস্তান স্বৈরাচারের পথে এগোচ্ছে—এটা এখন সবার চোখে স্পষ্ট। এবার নতুন এক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে, যা সেই গণতন্ত্রহীনতার পথকে আরও পোক্ত করে তুলছে।

উদ্যোগটি হলো সংবিধানের নতুন সংশোধনী। এটি ২৭তম সংশোধনী। পার্লামেন্টে ইতিমধ্যেই এটি পেশ করা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যাচ্ছে, ২৭তম সংশোধনী পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থার কাঠামোয় বড় পরিবর্তন আনবে। আর সেই বদল দেশটির শাসনব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে।

গত বছর ২৬তম সংশোধনী গৃহীত হয়েছিল রাতের আঁধারে। ওই সময় প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ ভোট নিশ্চিত করতে সরকার যে চাপ প্রয়োগ করেছিল, তা প্রক্রিয়াটির বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে বিতর্কিত সংশোধনীটি পাস হয়। এর মাধ্যমে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের অধীন হয় এবং তা আইনের শাসনকে দুর্বল করে ফেলে। এর ফলে সাংবিধানিক ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত প্রতিটি মামলায় সরকার জয়লাভ করে।

মনে হচ্ছে প্রস্তাবিত ২৭তম সংশোধনী একই পথে হাঁটছে। সংবিধানবিশেষজ্ঞরা এটিকে ‘বিচার বিভাগের ওপর রাষ্ট্রীয় দখল’ বলে আখ্যায়িত করছেন। বিরোধী নেতারা একে ‘প্রতিষ্ঠান পরিচালিত ক্ষমতা দখলের পদক্ষেপ’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। অনেকে একে গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি ও ‘বিচার ও রাজনীতির পৃথকতার নীতির ওপর আঘাত’ বলে মন্তব্য করেছেন।

সিনেটে উপস্থাপিত ২৭তম সংশোধনীতে তিনটি প্রধান বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১. একটি ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত প্রতিষ্ঠা; ২. উচ্চ আদালতের বিচারকদের এক আদালত থেকে অন্য আদালতে স্থানান্তরের ক্ষমতা এবং ৩. সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্ব–সংক্রান্ত সংবিধানের ২৪৩ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন।

২৬তম সংশোধনীর সময়ও সরকার একটি ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত গঠনের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তীব্র বিরোধিতার মুখে সেটি সম্ভব হয়নি। এর বদলে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টে সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন করা হয়। তবে সেটিও সমালোচিত হয়। কারণ, বেঞ্চের সদস্য কারা হবেন, তা নির্ধারণে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব ছিল। এতে সরকার ইচ্ছেমতো বিচারক বেছে নিয়ে নিজেদের স্বার্থসম্পর্কিত সাংবিধানিক মামলা নির্দিষ্ট বিচারকদের মাধ্যমে শুনানি করাতে পারে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানে যে গণতন্ত্রের ক্ষয় ও দুর্বলতা দেখা দিয়েছে, তার পটভূমিতে ২৭তম সংশোধনী গণতন্ত্রের ওপর আরও একটি আঘাত হিসেবে এসেছে। এটি একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে দেবে।

একটি সাংবিধানিক আদালত গঠনের বিরোধিতা করার যথেষ্ট যুক্তি আছে। কারণ, এতে সরকারের বেছে নেওয়া বিচারকদের দিয়ে এমন একটি আদালত তৈরি হবে, যা কার্যত সরকারের অধীনই কাজ করবে। এতে সুপ্রিম কোর্ট সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত মামলার এখতিয়ার হারাবে।

অন্যদিকে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, হাইকোর্টের বিচারকদের এক আদালত থেকে অন্য আদালতে তাঁদের সম্মতি ছাড়াই স্থানান্তর করা যাবে। এতে সরকার বিচার কমিশনের ওপর প্রভাব খাটিয়ে স্বাধীনচেতা বিচারকদের সরিয়ে দিতে পারবে।

সংবিধানের যে ২৪৩ অনুচ্ছেদ সরকারের হাতে সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্বের ক্ষমতা দেয়, নতুন সংশোধনীতে তাতেও পরিবর্তন আনার প্রস্তাব রয়েছে। সরকারের যুক্তি হলো, আধুনিক যুদ্ধের ধরন পাল্টে গেছে, তাই প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কাঠামোতেও পরিবর্তন দরকার এবং ‘ফিল্ড মার্শাল’ পদটির সাংবিধানিক স্বীকৃতি জরুরি।

এই সংশোধনীর ফলে সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্ব আরও বেশি সাংবিধানিক ক্ষমতা ও সুবিধা পাবেন। এখন পর্যন্ত সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তারা পর্যায়ক্রমে যে জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির প্রধানের দায়িত্ব নিতেন, তা বাতিল করা হবে। এর বদলে সৃষ্টি হবে চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস নামের পদ। আর এর নিয়ন্ত্রণ থাকবে সেনাপ্রধানের হাতে।

এ ছাড়া ফিল্ড মার্শাল, মার্শাল অব দ্য এয়ারফোর্স এবং অ্যাডমিরাল অব দ্য ফ্লিট—এই তিনজনকেই রাষ্ট্রপতির মতো আইনি দায়মুক্তি দেওয়া হবে। তাঁদের কেবল ইমপিচমেন্টের মাধ্যমে অপসারণ করা যাবে। তাঁরা আজীবন ইউনিফর্ম পরার অধিকার রাখবেন এবং একই মর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করবেন। সব মিলিয়ে এই সংশোধনীর লক্ষ্য হলো, বেসামরিক ব্যবস্থার হাত থেকে ক্ষমতা আরও বেশি করে সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানে যে গণতন্ত্রের ক্ষয় ও দুর্বলতা দেখা দিয়েছে, তার পটভূমিতে ২৭তম সংশোধনী গণতন্ত্রের ওপর আরও একটি আঘাত হিসেবে এসেছে। এটি একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে দেবে।

আসলে পাকিস্তানে ‘পার্লামেন্ট আজ রাবার স্ট্যাম্পে’ পরিণত হয়েছে, জনসমাবেশের স্বাধীনতা সীমিত করা হয়েছে, বিরোধী দলগুলোকে দমন করা হয়েছে, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে এবং বেসামরিক-সামরিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে তা পুরোপুরি সেনাবাহিনীর পক্ষে ঝুঁকে গেছে। এসব কিছু হয়েছে এমন একটি শাসক জোটের মাধ্যমে, যারা নিজেরাই সামরিক প্রতিষ্ঠানের অধীন ‘অংশীদার’ হয়ে থাকতে বেশি পছন্দ করে।

  • মালিহা লোধি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত

    ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত