‘মাতৃবৎ পরদারেষু, পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ’। সরলার্থ হলো—পরস্ত্রীকে মা মনে করতে হয় (যাতে পরস্ত্রীকে নিয়ে মনে কুচিন্তা না আসে) ; আর পরের দ্রব্য বা পরধনকে লোস্ট্র (‘লোস্ট্র’ মানে মাটির ঢেলা) ভাবতে হয় (যাতে নিতে ইচ্ছা না হয়)।
চাণক্যের শ্লোকের পরস্ত্রী–সংক্রান্ত গোড়ার অংশ বাদ দিয়ে ‘পরের ধন’সংক্রান্ত আগার অংশের আলোচনায় ঢুকলে অবধারিতভাবে ‘পোদ্দার’ নামক এক শ্রেণির পেশাজীবীর প্রসঙ্গ আসবে। প্রশ্ন উঠতে পারে পোদ্দার কারা? অভিধান বলছে, সোনা-রুপার বিশুদ্ধতা পরীক্ষক ও জিনিসপত্র বন্ধক রেখে ধার দেওয়া মহাজনরা হলেন পোদ্দার। এই নিখিল বঙ্গে পোদ্দারি পেশা লোপ পায়নি। তবে ধরনে বদলেছে।
ঐতিহ্যবাহী আদি পোদ্দাররা পরের ধন বন্ধকির মাধ্যমে নিজের কবজায় নিতে চড়া সুদে ধার দেওয়া বাবদ নিজের কিছু ধন বিনিয়োগ করতেন; সম্ভবত এখনো করেন। অর্থাৎ তাঁদের সেই পোদ্দারির পুরোটাই পরের ধনে না; তাতে তাঁদের নিজেদেরও কিছু পুঁজি-পাট্টা থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নতুন প্রজন্মের পোদ্দারের উদ্গমন হয়েছে। তাদের পোদ্দারির গোড়া থেকে মাথার পুরোটাই চলে পরের ধনে।
এই পোদ্দারি শুধু পরের ধন হরণ করে ক্ষান্ত হওয়ার পাঠ শেখায় না; একই সঙ্গে প্রবঞ্চিত পরের মাথায় এই চিন্তাও ঢুকিয়ে দেয় যে, তাঁর ধন মোটেও হরণ করা হয়নি বরং পোদ্দার মহোদয় উপযাচক হয়ে পরকে আপজনের মতো ধন দান করে গেছেন। ধন হারানো সেই ‘পর’ তখন পোদ্দারকে শাপশাপান্ত করার বদলে উল্টো ‘প্রাণের বন্ধু’ বলে গলা জড়িয়ে ‘আপন’ হয়ে উঠতে চান।
অর্থাৎ আধুনিক পোদ্দারি তত্ত্বের ভাষ্য হলো, ধন এবং মান—দুটোই আসতে হবে; আর মাঝখান থেকে যার ধন ছিনিয়ে নেওয়া হবে, সে টেরটিও পাবে না। ধরুন আপনি খুব পাওয়ারফুল একজন লোক। আপনার পরের ধন হাতিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি এলাকার মানুষের কাছে সমাজসেবক টাইপের একটা পোদ্দারি মার্কা ভাব ধরার খায়েশ জেগেছে। এই দুটি খায়েশ একসঙ্গে পূরণের জন্য আপনি হাইব্রিড পোদ্দারি রেসিপি অনুসরণ করতে পারেন।
এই রেসিপি অনুযায়ী, আপনাকে একজন মন্ত্রী কিংবা সচিব কিংবা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কিংবা সিনেমার নায়ক-নায়িকা-ভিলেন টাইপের পরিচিত মুখের প্রভাবশালী লোক হতে হবে। প্রথমে আপনাকে একটি এনজিও (বেসরকারি সংস্থা) খুলতে হবে। তারপর আপনার বাবার নামে, দাদার নামে, পরদাদার নামে তথা চৌদ্দগুষ্টির যে কারও নামে হাসপাতাল-বৃদ্ধাশ্রম-এতিমখানার মতো সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরে আবেদন করতে হবে।
ধরুন আপনার নানাশ্বশুরের খালাশাশুড়ির নামে আপনার নিজের গ্রামে একটি হাসপাতাল বানানোর জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করল। এর মধ্যে ৮০ কোটি টাকা আসবে সরকারি তহবিল তথা জনগণের তহবিল তথা পরের ধন থেকে। বাকি ২০ কোটি টাকা আপনাকে দিতে হবে। ২০ কোটি টাকা দেওয়ার শর্ত পূরণ করতে আপনি হাসপাতাল বানাতে একটি জমি আপনার গৃহপালিত এনজিওর নামে লিখে দিলেন। ৫০ লাখ টাকা দামের জমিকে ১৮ কোটি টাকায় দেখিয়ে দিলেন। এরপর সরকারি টাকায়, মানে পাবলিকের টাকায়, মানে পরের ধনে হাসপাতালের ভবন তৈরির কাজ শুরু হলো। কাজটা পেলেন যে ঠিকাদার, দেখা গেল সেই লোক আপনার মায়ের পেটের ছোট ভাই। কইয়ের তেলে কই ভাজা চলতে লাগল।
পরের ধনে হাসপাতালের কাজ শেষ হলো। ঠিকাদারির মধ্য দিয়ে পরের ধন ঘরে এল। হাসপাতালের মূল ফটকের সাইনবোর্ডে আপনার নানাশ্বশুরের খালাশাশুড়ির নাম জ্বলজ্বল করতে লাগল। আপনার নিজের এবং শ্বশুরবাড়ির এলাকায় আপনার নামে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। তবে সমস্যা একটু থেকে গেল। আপনার গৃহপালিত যে এনজিওর এই হাসপাতাল চালানোর কথা ছিল, দেখা গেল সেই এনজিও বলল, পকেটে টাকা নাই, হাসপাতাল চালাতে পারব না। তবে সেই সমস্যা কোনো সমস্যাই না; কারণ তত দিনে পরের ধনে যতটা পোদ্দারি করার দরকার আপনার ছিল, তা হয়ে গেছে।
প্রথম আলোতে ছাপা হওয়া ‘সমাজসেবা অধিদপ্তরের “খাতিরের” প্রকল্প; করের টাকায় মন্ত্রী-সচিবের মা-বাবার নামে প্রতিষ্ঠান’ এবং ‘ “খাতিরের” প্রকল্প, ইচ্ছেমতো অনিয়ম: বিধবাদের তালিকায় পুরুষ, টাকা নয়ছয়, কাজে লাগেনি প্রশিক্ষণ’ শিরোনামের দুটি প্রতিবেদনে পরের ধনে পোদ্দারির নিখুঁত কায়দা কানুন উদাহরণসহ দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এসব প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মা-বাবা, নানা-নানি, দাদা; এমনকি নিজের বাড়ির নামে হাসপাতালের মতো স্থাপনা করতে ৯ জন ব্যক্তি পরের ধন তথা সরকারি তহবিল থেকে নিয়েছেন ২৮৬ কোটি টাকা। আবার দুস্থ ও পিছিয়ে পড়া লোকজনকে প্রশিক্ষণের নামে বানানো ‘খাতিরের’ প্রকল্পে খরচ করা হয়েছে ৫০৩ কোটি টাকা। সেখানে সুবিধাভোগীদের তালিকায় পুরুষ মানুষকে আমরা বিধবা নারী হিসেবেও দেখতে পেয়েছি।
প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, খোদ সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের গ্রামে তাঁর মায়ের নামে ‘করিমপুর নূরজাহান-সামসুন্নাহার মা ও শিশু বিশেষায়িত হাসপাতাল’ বানানো হচ্ছে ৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে। পাঁচতলা ভবন বানানোর খরচের ৩৫ কোটি টাকা দিচ্ছে তাঁরই মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সমাজসেবা অধিদপ্তর। হাসপাতালটি বানাচ্ছে মন্ত্রীর মায়ের নামের এনজিও করিমপুর নূরজাহান-সামসুন্নাহার উন্নয়ন সংস্থা। নির্মাণকাজ পেয়েছে মন্ত্রীর ভাইয়ের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। নির্মাণে মোট ব্যয়ের ২০ শতাংশ (প্রায় ৯ কোটি টাকা) এনজিওর দেওয়ার কথা। এনজিওর অংশ বাবদ মন্ত্রীর পরিবার যে এক একর জমি দিয়েছে তার দাম দেখানো হয়েছে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। কিন্তু স্থানীয় সাবরেজিস্ট্রি কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে স্থানীয় মৌজা মূল্য (রেট) অনুযায়ী এই জমির দাম বড়জোর ৫২ লাখ টাকা।
এই ধরনের অনেকগুলো গল্প প্রতিবেদন দুটিতে সুলভে পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি’র মধ্যে জন্ম নেওয়া এসব গল্পের থিম এক, চরিত্রগুলোও একই ধরনের।
চরিত্রগুলো একদিকে মিথ্যা ভুয়া তথ্যে ভর করে দাতব্য প্রতিষ্ঠানটির মতো প্রকল্প থেকে জনগণের ধন হরণ করছে, অন্যদিকে সেই অকার্যকর প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে প্রয়াত বাপ–দাদার নাম জুড়ে দিয়ে এলাকাবাসীর কাছে মহান হওয়ার চেষ্টা করছে। পরের ধনকে ‘লোস্ট্র’ বা মাটির ঢেলার বদলে নিজের ধন মনে করা এই পোদ্দারদের কে বোঝাবে ‘মিথ্যে দিয়ে মহৎ কিছুই হয় না সাধন’!
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ইমেইল: sarfuddin2003@gmail.com