দুই শর বেশি মাজার ভাঙা, বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাউলগান ও লোকজ সংস্কৃতির ওপর হামলাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি বলে ধীরে ধীরে এই মব সন্ত্রাসীরা আশকারা পেয়েছে এবং মববাজি করাকে তাদের অধিকার হিসেবে ধরে নিয়েছে। তাদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধমূলক কার্যক্রম তারা নৈতিকতা দিয়ে বিচার করছে না, বরং একটি নির্দিষ্ট ভাবাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে তারা তাদের ‘দায়িত্ব’ পালন করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো যে পরিকল্পিতভাবে ভিন্নমতকে ধ্বংস করার আয়োজন, সে বিষয়ে লিখেছেন উম্মে ওয়ারা
দুর্বৃত্তের গুলিতে তরুণ রাজনীতিবিদ ওসমান হাদির অকালমৃত্যুতে পুরো বাংলাদেশের মানুষ শোকার্ত। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে অন্য সবার
মতো আমিও তাঁর মৃত্যুর সঠিক তদন্ত ও অপরাধীর বিচার চাই।
হাদির মৃত্যুর খবর পেয়ে শাহবাগে যখন বিক্ষোভ সমাবেশ হচ্ছিল, তখন একটি স্লোগান ভেসে আসছিল, ‘আমরা সবাই হাদি হব, যুগে যুগে লড়ে যাব।’
কী ভীষণ তারুণ্যে উদ্দীপিত স্লোগান! কিন্তু আসলেই কি একজন হাদি হয়ে ওঠা এত সহজ?
২.
লড়ে যাওয়ার অর্থ কি নিজের আদর্শ প্রতিষ্ঠায় নিরলস সংগ্রাম করে যাওয়া, নাকি প্রতিবাদের নামে দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুট করা?
১৮ ডিসেম্বর মধ্যরাতে প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার–এর কার্যালয় ছাড়াও ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবন, ভারতের সহকারী হাইকমিশনের কার্যালয়েও হামলার ঘটনা ঘটেছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে হামলা করা হয়েছে আরও এক দফায়।
একই রাতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ময়মনসিংহে দীপু দাস নামের এক হিন্দু যুবককে গাছে ঝুলিয়ে পিটিয়ে হত্যা ও পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা ঘটে। পরের দিন উদীচীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
ওসমান হাদির মৃত্যুতে বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন দায়ী করে আক্রমণ করা হয়েছে, তা একেবারেই বোধগম্য নয়। কেননা তাঁর ওপর হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দায়িত্ব সরকারের, বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।
তাই প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেপ্তারের জন্য প্রতিবাদ করতে তাদের সরকারের কাছে জবাবদিহি চাওয়ার প্রয়োজন ছিল। তা না করে সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে ওপর হামলাসহ এখনো বিভিন্ন জায়গায় তাদের আওয়ামী লীগবিরোধী ও ভারতবিরোধী স্লোগান দিতে দেখা যাচ্ছে।
৩.
দুর্বৃত্তের গুলিতে তরুণ রাজনীতিবিদ ওসমান হাদির অকালমৃত্যুতে পুরো বাংলাদেশের মানুষ শোকার্ত। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলা হচ্ছে, তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন।
যদি তা–ই হয়ে থাকে, এখানে তো ব্যর্থতা স্পষ্টতই বাংলাদেশ সরকারের। এমনকি এ বিষয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘ওসমান হাদি ছিলেন পরাজিত শক্তি ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসীদের শত্রু। তাঁর কণ্ঠ স্তব্ধ করে বিপ্লবীদের ভয় দেখানোর অপচেষ্টা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ করে দিন।’
অপরাধীকে গ্রেপ্তার ও বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর আগেই সরকারপ্রধানের পক্ষ থেকে কোনো একটি পক্ষকে অভিযুক্ত করাটাও কতটুকু সমীচীন, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতিতে নানা দেশের সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলার ঘটনা নতুন কিছু নয়। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের জন্য কিংবা নির্বাচনকালীন ক্ষমতার বৈধতা সংকট মোকাবিলা ছাড়াও কখনো কখনো দুর্বল আইনের শাসন ও দায়মুক্তিতে এ ধরনের ঘটনার প্রবণতা দেখা যায়।
৪.
এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি তখনই ঘটে, যখন ইতিহাস ও সত্য নিয়ে লড়াই শুরু হয় অথবা সমাজে ভয় ও মেরুকরণ তৈরি করে রাজনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ার চেষ্টা করে কেউ কেউ। এগুলো মূলত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনের সূচক হিসেবে কাজ করে।
এর প্রথম যুক্তি হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটি বিমূর্ত অধিকার নয়; বরং এটি নির্ভর করে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর ওপর; যার মধ্যে সংবাদমাধ্যম, শিল্পকলা, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি অন্যতম। তাই এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর হামলা মানে হলো ভিন্নমত প্রকাশের কাঠামোকে ধ্বংস করা, যা ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দমন বিস্তারের ইঙ্গিত দেয়।
দ্বিতীয়ত, সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা যেমন নাটক, সাহিত্য, গান, কার্টুন ইত্যাদি সমাজকে ন্যায়-অন্যায় শেখায়, যার ওপর আঘাত আনলে সমাজ প্রকৃতপক্ষে সহিংসতার দিকেই ধাবিত হয়।
এভাবেই মার্কিন রাজনৈতিক তাত্ত্বিক হানা আরেন্ডট-এর ‘ব্যানালিটি অব ইভিল’ তত্ত্ব (১৯৬৩) অর্থাৎ সহিংসতা কীভাবে ধীরে ধীরে একটি সমাজে ‘স্বাভাবিক কাজ’ হয়ে ওঠে, তা কার্যকর হতে শুরু করে।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যখন নিজেকে মূলত ‘অধীনস্থ বা আজ্ঞাবাহী’ হিসেবে দেখে, তখন কাজের নৈতিকতা নয়, বরং নির্দেশ মানাটাই মুখ্য হয়ে ওঠে।
এই মব সন্ত্রাস নিয়ে গত বছর থেকেই সমাজের নানা পরিসর থেকে প্রতিবাদ করা হলেও সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করতে অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছে।
দুই শর বেশি মাজার ভাঙা, বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাউলগান ও লোকজ সংস্কৃতির ওপর হামলাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি বলে ধীরে ধীরে এই মব সন্ত্রাসীরা আশকারা পেয়েছে এবং মববাজি করাকে তাদের অধিকার হিসেবে ধরে নিয়েছে।
৫.
খেয়াল করে দেখবেন, যারা কিছুদিন ধরে বিভিন্ন জায়গায় হামলা ও লুটপাট চালাচ্ছে, তারা প্রত্যেকে নির্দিষ্টভাবে কয়েকটি শব্দ বা শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে তাদের ধ্বংসযজ্ঞকে ন্যায্যতা দেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। যেমন ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদ’, ‘ফ্যাসিস্টের দালাল’ বা ‘ভারতের দালাল’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে যেকোনো কিছু করলেই যেন তা আইনের ঊর্ধ্বে বলে ধরে নেওয়া হবে।
তাদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধমূলক কার্যক্রম তারা নৈতিকতা দিয়ে বিচার করছে না, বরং একটি নির্দিষ্ট ভাবাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে তারা তাদের ‘দায়িত্ব’ পালন করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
অপর দিকে নিরাপত্তাঝুঁকির ভয়ে সাংবাদিক ও শিল্পীদের মধ্যে যখন আত্মনিয়ন্ত্রণের (সেলফ-সেন্সরশিপ) প্রবণতা দেখা যায়, সেটিও স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশকে ব্যাহত করে।
এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক দু–একটি হামলাই আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে বলে দেখা যায়। ব্রিটিশ সমাজতাত্ত্বিক স্ট্যানলি কোহেন একে বলেন ‘সোশ্যাল প্রোডাকশন অব সাইলেন্স’ (২০০১)।
এর মূলকথা হলো, নীরবতা কেবল একটি স্বাভাবিক নিষ্ক্রিয়তা নয়, বরং সামাজিকভাবে উৎপাদিত ভয় ও অনিশ্চয়তার ফলাফল।
এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে কাউকে সরাসরি কথা বলা নিষিদ্ধ না করেও এমন ঝুঁকি পরিস্থিতি তৈরি করা হয়, যার ফলে মানুষ নিজে থেকেই চুপ থাকতে শুরু করে। যদি একজন সম্পাদক বলেন, ‘এ বিষয়টা লেখা যায়, কিন্তু ঝামেলা হতে পারে।’
এই ‘ঝামেলা’ শব্দটিই হলো সেলফ-সেন্সরশিপের প্রকাশ। বর্তমানে বাংলাদেশেও একই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজমান বলে মনে হচ্ছে, যা এত দিন ধরে শুনে আসা ‘নতুন বন্দোবস্তের’ ধারণার একেবারে বিপরীত। এই আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রবণতা কোনো ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়ার ফলাফল।
৬.
এ ছাড়া সংবাদমাধ্যম ও সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ আদতে ব্যাপক পরিসরে সহিংসতার পূর্বলক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কেননা বড় পরিসরে ঘটা সহিংসতা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়; বরং ধাপে ধাপে তা সামাজিকভাবে প্রস্তুত হয়ে থাকে।
তাই কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা টার্গেটেড কিলিংয়ের অনেক আগেই মূলত মতপ্রকাশের পরিসরকে সংকুচিত করার চেষ্টা করা হয়। এই সংকোচনের দৃশ্যমান লক্ষণ আরও পরিষ্কার হলো ১৮ ডিসেম্বরে ঘটে যাওয়া ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে।
তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও বিচার নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে; ধর্ম বা অন্য কোনো আবেগকে ব্যবহার করে কেউ যেন ‘আমরা বনাম তারা’ বয়ানের উত্থান ঘটাতে না পারে; ভিন্নমতকে যেন শত্রু বানিয়ে ধ্বংস বা হত্যাযোগ্য করার ষড়যন্ত্র করতে না পারে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, সংবাদমাধ্যম আন্দোলনের বিস্তার ঘটায় আর সংস্কৃতি প্রতিবাদের ভাষা তৈরি করে। তাই এদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।
উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মতামত লেখকের নিজস্ব