মতামত

সত্যিই কি পালিয়ে গেল সত্য, নাকি আমরা তাকে নির্বাসনে পাঠালাম

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষের ঘটনায় আহত আবদুল্লাহ আল মামুন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর মাথার খুলি এখনো জোড়া লাগেনি; বরং খুলে ফেলতে হয়েছে খুলির একাংশ। ব্যান্ডেজে জড়িয়ে রাখা হয়েছে পুরো মাথা। যেন ভুলে কেউ তাতে হাত না দেয়, সে জন্য ব্যান্ডেজে লেখা হয়েছে, ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না।’ কী ভয়াবহ!

কারাগারে ভয়ংকর ৯ দিন কাটানোর পর অবশেষে জামিন পান প্রতিবন্ধী সাঈদ। সম্প্রতি মিছিল করার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাঁকে। জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী সাঈদকে একসময় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। তাঁর চেহারায় স্পষ্টতই প্রতিবন্ধী হওয়ার ছাপ। জামিনের জন্য তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কার্ডও আদালতে জমা দেওয়া হয়। এমন একজন প্রতিবন্ধী মানুষকে মিছিল করার অপরাধে গ্রেপ্তার করা যায় কি? জানা নেই আমার।

সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘মঞ্চ ৭১’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠক থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান, সাংবাদিক মনজুরুল আলম পান্নাসহ ১৬ জনকে। তাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে পুলিশ।

ঢাকা মহানগর পুলিশ জানায়, আটক ব্যক্তিদের বক্তৃতা, বিবৃতি, বই, কলামের লেখা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে তাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তথ্য–প্রমাণ পাওয়া গেছে। পরদিন লতিফ সিদ্দিকী ছাড়া অন্যরা জামিনের আবেদন করলে আদালত তা নাকচ করেন। পরবর্তী সময় লতিফ সিদ্দিকীকে যখন ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়, তিনি ওকালতনামায় স্বাক্ষর করতে রাজি হননি। আদালতের প্রতি আস্থা নেই বলে তিনি উপস্থিত আইনজীবীদের জানান।

লতিফ সিদ্দিকীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ কতটুকু সত্য, জানা নেই আমার। কিন্তু সবার কাছে যা দিনের আলোর মতো সত্য ছিল তা হলো, তাঁদের ঘিরে অভিযোগকারীদের করা কর্মকাণ্ড। কিন্তু যাঁরা সবার সামনে বৈঠকের বক্তাদের গায়ে হাত তুললেন, রাষ্ট্র তাঁদের সন্ত্রাসী বলে মনে করল না।

গত বছরের আগস্ট থেকে শুরু করে অনেক অপরাধী জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তাদের সবাই তো রাজনৈতিক কারণে বন্দী ছিলেন না! অনেকে সংঘটিত অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত কিংবা সাজাপ্রাপ্ত। সরকার পরিবর্তন হলেই কি অপরাধের সংজ্ঞা কিংবা মাত্রা পরিবর্তিত হয়? তাহলে কোন মন্ত্রবলে বেরিয়ে আসছেন তাঁরা?

গত ২৯ মে চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট আয়োজিত কর্মসূচিতে এক নারীকে লাথি মেরে দেশজুড়ে সমালোচিত জামায়াতকর্মী আকাশ চৌধুরী জামিনে কয়েক দিনের মধ্যেই মুক্তি পান। অন্যদিকে গত মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রীকে হেনস্তার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সহকারী বাইন্ডার মোস্তফা আসিফকে জামিন দেন আদালত। তিনি এক নারী শিক্ষার্থীকে ‘ওড়না ঠিকভাবে না পরা’ নিয়ে কটূক্তি করেছিলেন, যা তিনি পরে স্বীকারও করেন। তাঁর বক্তব্যে অশ্রাব্য ও অশ্লীল ভাষার প্রয়োগ আমরা শুনেছি।

আমরা দেখেছি, আসিফের মুক্তির দাবিতে নিজেদের ‘তৌহিদি জনতা’ পরিচয় দেওয়া একদল বিক্ষুব্ধ জনতা শাহবাগ থানার প্রবেশপথ ঘেরাও করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। ফলাফল, গ্রেপ্তার হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই হাতে পবিত্র কোরআন, গলায় একরাশ ফুলের মালাসহ বীরের বেশে বেরিয়ে আসেন তিনি। শুধু এই দুটি ঘটনাই নয়।

সম্প্রতি অনেক ঘটনায় আমরা প্রত্যক্ষ করছি যে নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন, যেন তাঁরাই অপরাধী। অন্যদিকে প্রকৃত অপরাধীরা যে শুধু জামিনেই মুক্ত হচ্ছেন, তা নয়; বরং তাঁদের আয়োজন করে হাজত থেকে ছাড়িয়ে আনার ঘটনা ঘটছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত দেশে মোট ৩০৬টি মেয়েশিশুকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এই সংখ্যা গত বছরের মোট ধর্ষণের সংখ্যার সমান। কর্মস্থলে, গণপরিসরে নারীর উপস্থিতি কমেছে। নারীর চলাফেরা, আচরণ, পোশাক নিয়ে যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে, যেকোনো পরিস্থিতিতে আক্রমণ ও হয়রানির ঝুঁকি বেড়েছে কয়েক গুণ।

গত বছরের আগস্ট থেকে শুরু করে অনেক অপরাধী জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তাদের সবাই তো রাজনৈতিক কারণে বন্দী ছিলেন না! অনেকে সংঘটিত অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত কিংবা সাজাপ্রাপ্ত। সরকার পরিবর্তন হলেই কি অপরাধের সংজ্ঞা কিংবা মাত্রা পরিবর্তিত হয়? তাহলে কোন মন্ত্রবলে বেরিয়ে আসছেন তাঁরা?

ভালো নেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় ধ্বংসের মুখে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রোজ এত এত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে যে কোথায়, কেন, কী উদ্দেশ্যে এসব ঘটছে, তা বুঝে ওঠা দিন দিন অসম্ভব হয়ে উঠছে। তবে যা ভালোভাবে বুঝতে পারছি তা হলো, দেশ ভালো নেই, ভালো নেই আমরা।

এত আন্দোলন আর রক্তপাতের পরও আমাদের রাজনৈতিক চরিত্রের কিছুমাত্র পরিবর্তন ঘটেনি। পরিবর্তন ঘটেছে শুধুই কুশীলবদের। আমরা লক্ষ করলাম, গত জুলাই-আগস্টে এত মানুষের রক্তের বিনিময়ে যে বিজয় অর্জিত হয়েছিল, সেই বিজয়কে ঘৃণ্য কৌশলে মুখোমুখি দাঁড় করানো হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে। এ যেন রাজনীতির সেই পুরোনো খেলা। অথচ একাত্তর আর জুলাই একে অন্যের পরিপূরক হওয়ার কথা ছিল। পাকিস্তানি বৈষম্যের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই একই চেতনার বহিঃপ্রকাশ ছিল জুলাইয়ে।

পার্থক্য, একাত্তর ছিল আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। আর জুলাই ছিল সেই অস্তিত্বকে এগিয়ে নিতে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রাম। অথচ কিছু মানুষের স্বার্থের কাছে আরেকবার যেন হেরে গেলাম আমরা। ট্যাগিংয়ের রাজনীতিতে আমাদের চোখের সামনেই সত্যরা মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে।

আমরা কী তাহলে ক্রমেই মিথ্যার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছি? একটি–দুটি মিথ্যার সঙ্গে লড়াই করা যায়, কিন্তু পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাই যখন মিথ্যার কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করে, তখন ধুঁকতে থাকা সত্য হয়তো একসময় মিথ্যার কাছে হার মানে। জানি না এই অবস্থার শেষ কোথায়? স্বার্থের রাজনীতির এই চক্র থেকে কে বাঁচাবে দেশকে।

কবি আসাদ চৌধুরী তাঁর ‘সত্য ফেরারী’ কবিতায় সত্য খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে অবশেষে বলেছিলেন ‘কোথায় পালাল সত্য?’ তাঁর সেই প্রশ্নের প্রতিধ্বনি করে বলতে চাই, ‘সত্যিই কি পালিয়ে গেল সত্য, নাকি আমরা তাকে নির্বাসনে পাঠালাম?’

  • নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী

    purba_du@yahoo.com

*মতামত লেখকের নিজস্ব