Thank you for trying Sticky AMP!!

অনুমোদন না থাকায় ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কের গাউসিয়া টুইন পিক ভবনের রুফটপ রেস্তোরাঁ ভেঙে ফেলেছে রাজউক

ভাতের হোটেলের শ্রমিক গ্রেপ্তার করলে আগুন লাগা বন্ধ হবে?

সব আগুন পানিতে নেভে না। স্বজন হারিয়ে যাদের বুকে চিতার আগুন, রেস্তোরাঁয় ভাঙচুর আর পথেঘাটে গ্রেপ্তার চালিয়ে তাদের শান্ত করতে পারবেন না। তাই হঠাৎ যেসব কর্তৃপক্ষ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় রেস্তোরাঁ সিলগালা করছেন বা হাতুড়ি, গাঁইতি, শাবল দিয়ে ভাঙচুরের মহাযজ্ঞে নেমেছে, তাদের কাজে সবাই খুশিতে বাকবাকুম—বিষয়টা এমন নয়।

অনেকেই আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ভাবছেন, এই ঝোড়ো গতির অভিযান বেশি দিন চলবে না। সিলগালা করা রেস্তোরাঁর তালা খুলতে বড় অঙ্কের লেনদেন হবে। মাঝখান থেকে পথের ধারের ভাত বিক্রেতা থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁর শ্রমিকদের জেলে পচতে হবে কিছুদিন। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা এই ভাবনার সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়।

গত ২৯ ফেব্রুয়ারি গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুন লেগে ৪৬ জন নিহত হন। ঘটনার পরপর পুলিশ চা চুমুক নামের একটি খাবার দোকানের দুই মালিক আনোয়ারুল হক ও শফিকুর রহমান, কাচ্চি ভাই নামের আরেকটি খাবারের দোকানের ব্যবস্থাপক জয়নুদ্দিন জিসান ও গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের ব্যবস্থাপক মুন্সি হামিমুল আলম বিপুলকে ত্বরিত গতিতে গ্রেপ্তার করে।

Also Read: বেইলি রোড: অগ্নিকাণ্ডের কাঠামোগত ভিত্তি যেভাবে বহাল থাকে

পরদিন থেকে শুরু হয় চতুর্মুখী অভিযান—একদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স ও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ডিএমপি জানায় আজ বুধবার পর্যন্ত তারা ১১৩২ টি হোটেল-রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে ৮৭২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

তো কারা এখন গ্রেপ্তার হচ্ছেন দেখি। প্রথম আলোর সাংবাদিক বলছেন, গতকাল (মঙ্গলবার) সিএমএম আদালত এলাকায় দেখা যায়, পুলিশ যেসব ব্যক্তিকে ধরে এনেছেন, তাঁদের স্বজনেরা বেলা ১১টার পর থেকে আদালত চত্বরে ভিড় করেন। সেখানে লালন মিয়া নামের এক প্রবীণ বলেন, ৪০ বছর ধরে রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল ও রেস্তোরাঁয় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। সম্প্রতি তিনি মতিঝিলের কমলাপুর এলাকায় ভ্রাম্যমাণ ভাত বিক্রির দোকান দেন। গত সোমবার দোকান থেকে তাঁর কর্মী মোসলেমকে ধরে নিয়ে আসে পুলিশ।

রাজউকের কোন কর্মকর্তা ‘অকুপেন্সি সার্টিফিকেট’ (ভবন ব্যবহারের চূড়ান্ত অনুমোদন) দিয়েছেন? তিনি কোথায়? বেইলি রোডের এই ভবন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায়। কোন কোন কর্মকর্তা সাতটি ফ্লোরে আলাদা সাতটি রেস্তোরাঁ করার অনুমতি দিয়েছেন? নাম কী তাঁদের? তাঁরা কি নিজে থেকেই সনদ দিয়েছেন, না কারও চাপে পড়েছিলেন? তদবিরকারী কারা। তাঁদের নাম কেন মামলায় ঢুকবে না?

কী বুঝলেন? দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনা-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের দিকে যাঁরা চোখ রাখছেন, তাঁরা কী কী প্রশ্ন তুলেছেন শুনুন। গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের মালিক কে? তাঁর নাম কেন সন্দেহভাজনদের তালিকায় নেই? স্থপতি ইকবাল হাবিবের ওই ভিডিও দেখেছেন তো? তিনি বলছেন, ভবনের অনুমোদন না পেলে ভবনমালিক ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করার হুমকি দিয়েছিলেন। তারপরও সংস্থাটি তিনবার চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছে।

চিঠিটি ইস্যু করা হয়েছিল গ্রিন কোজি কটেজের ছাদের রেস্তোরাঁ অ্যাম্ব্রশিয়া রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড মিউজিক ক্যাফের মালিককে। তাঁর নাম সরদার মিজানুর রহমান। তিনি কোথায়? কেন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না?

এই ভবন পাঁচ বছর পরপর রাজউকের পরিদর্শন করে বসবাসযোগ্য কি অযোগ্য—এ সনদ দেওয়ার কথা। রাজউকের কোন কর্মকর্তা ‘অকুপেন্সি সার্টিফিকেট’ (ভবন ব্যবহারের চূড়ান্ত অনুমোদন) দিয়েছেন? তিনি কোথায়?

Also Read: সম্মিলিত গাফিলতির দায় নেবে কে

এই ভবন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায়। কোন কোন কর্মকর্তা সাতটি ফ্লোরে আলাদা সাতটি রেস্তোরাঁ করার অনুমতি দিয়েছেন? নাম কী তাঁদের? তাঁরা কি নিজে থেকেই সনদ দিয়েছেন, না কারও চাপে পড়েছিলেন? তদবিরকারী কারা। তাঁদের নাম কেন মামলায় ঢুকবে না?

ঢুকবে না। স্রষ্টা সব মানুষকে রাজার অধীন করে পাঠিয়েছেন—জনপ্রিয় এই মতের বিরুদ্ধে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজ দার্শনিক জন লক প্রথম অবস্থান নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সব মানুষ মুক্ত, সবাই সমান। বিংশ শতাব্দীতে এসে ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এ ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েল লিখলেন, সব প্রাণী সমান, কোনো কোনো প্রাণী বেশি সমান।

২০১৯ সালে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা ও বনানীর ২২ তলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পর উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি কারিগরি কমিটি গঠিত হয়েছিল। ওই কমিটি ঢাকার তিন হাজার ভবন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিটি মোটাদাগে চারটি সুপারিশ করেছিল। রাজউক তৃতীয় কোনো পক্ষকে দিয়ে ঢাকার বহুতল ভবনগুলো পরিদর্শনের উদ্যোগ নেবে, আটটি জোনের প্রতিটিতে পাঁচজন এ কাজ করবেন।

তিন হাজার ভবনের প্রতিটিই ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ভঙ্গ করেছে। তাই নিয়মিত তিন হাজার ভবনের ‘ডিটেইলড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট’ করতে হবে। এই মূল্যায়নে অগ্নিনিরাপত্তা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিষয়-আশয় দেখা হবে। একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হবে ভবনগুলোর ত্রুটি সারাতে। কোনোভাবেই ইমারত নির্মাণ বিধিমালার ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না।

পাঁচ বছর পর এসে আমরা কী দেখলাম? এফ আর টাওয়ার থেকে লাফিয়ে পড়ে মানুষ জানে বাঁচার চেষ্টা করছেন—এমন ছবি অনেকের মনে এখনো গেঁথে আছে। বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ থেকেও লাফিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হলো কাউকে কাউকে। আর শিশুসহ ৪৬ জন দম বন্ধ হয়ে মারা গেলেন। নতুন করে আওয়াজ উঠেছে, ইনফ্লুয়েন্সাররা যেন রেস্তোরাঁয় গিয়ে অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে রিভিউ দেন। বাহ! বাহ!

রেস্তোরাঁ থেকে চায়ের দোকানি, ভাতের দোকানদার—সবাই দৌড়াচ্ছেন। শুধু কর্তৃপক্ষ আছে মহানন্দে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে বছর কয়েক আগে দেশজুড়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের কথা। যুবলীগ নেতা সম্রাটসহ রাঘববোয়ালেরা ধরা পড়ছেন, আমজনতাও সমানে বাহবা দিচ্ছে। হঠাৎ দুর্নীতিবিরোধী অভিযান হয়ে গেল ক্যাসিনো-বিরোধী অভিযান। তারপর পুলিশ অলিগলিতে জুয়া খেলার অভিযোগে হাড়জিরজিরে লোকজন গ্রেপ্তার করতে শুরু করল।

সেই অভিযানের ঢেউ গিয়ে লাগল বডি ম্যাসাজ আর স্পা সেন্টারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সে সময় বলেছিলেন, আরও শতাধিক দুর্নীতিবাজের তালিকা যথাস্থানে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের তরফে আর কোনো হেলদোল দেখা গেল না।

এই যে রেস্তোরাঁ সিলগালার ধুম পড়েছে, এটাও ধারণা করি খুব দ্রুতই বন্ধ হবে। এদিক-ওদিক থেকে একটা-আধটা রেস্তোরাঁ খুলবে, তারপর সব চলবে আগের মতোই। মাঝখান থেকে কেউ কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেলে বিস্মিত হবেন না। এই দেশে ধনী বা প্রভাবশালী লোকের বিচার হয়েছে—এমন ঘটনা দুর্লভের চেয়েও দুর্লভ।

কোনো ধনকুবেরের কারণে কেউ আত্মহত্যা করুক, তাঁদের চালানো গাড়ির নিচে পড়ে কেউ মরে যাক কিংবা কারখানায় আগুন লেগে শ্রমিক প্রাণ হারাক, ধরে নিতে হবে এ তাঁর কপালের দোষ। যেহেতু ‘ভীম কারার ভিত্তি’ নাড়ার ক্ষমতা আমাদের নেই, তাই টাকা, ক্ষমতার চাপ আর দাপটে যে কোনো সময়ে মরার জন্য প্রস্তুত থাকুন। আর নইলে ধনকুবের হওয়ার ‘অ্যাম্বিশন’ নিন।

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। ই-মেইল: sabiha.alam@prothomalo.com