
বাংলাদেশ প্রায় ৭০ বছর ধরে বেষ্টনীপন্থা অনুসরণ করেছে এবং হাজার হাজার মাইল বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে হাজার হাজার স্লুইসগেট। বাংলাদেশের ভ্রান্ত ধারার পানি উন্নয়নের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো বড়াল নদের অভিজ্ঞতা। বড়াল নদের দৃষ্টান্ত থেকে আমরা কী শিক্ষা পেলাম, বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে তা নিয়ে লিখেছেন নজরুল ইসলাম
নদী রক্ষার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, পৃথিবীর আর কোনো দেশের জন্য সম্ভবত ততটা নয়। এ রকম পরিপ্রেক্ষিতে এটা দুঃখজনক যে বাংলাদেশে নদ-নদী বিষয়ে যেন এক বৈপরীত্যমূলক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একদিকে দেশে শত শত পানি উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, অন্যদিকে নদ-নদীর পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটেছে।
বিগত দশকগুলোতে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নদ-নদী হারিয়ে গেছে। এখনো যেগুলো অবশিষ্ট আছে, তার মধ্যেও বহু নদ-নদী দূষণে-দখলে জর্জর, অগভীর, প্রায় জলশূন্য এবং মৃতপ্রায়।
২.
এই বৈপরীত্যের কারণ কী? কেন শত শত পানি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পরও বাংলাদেশের নদ-নদী আরও সুস্থ ও সবল হওয়ার পরিবর্তে মৃত বা মৃতপ্রায় হয়ে গেল?
এ প্রশ্নের উত্তর একটাই এবং তা হলো বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন প্রয়াস সঠিক পথে অগ্রসর হয়নি। বস্তুত সম্পূর্ণ বিপরীত ও ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হয়েছে।
এটা সুবিদিত যে বাংলাদেশের নদীপ্রবাহের চরম ঋতুভেদ রয়েছে। এর কারণ বৃষ্টির ঋতুভেদ। বার্ষিক মোট বৃষ্টির প্রায় ৮০ শতাংশ মাত্র ৪ মাসে সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে বর্ষার এই মাসগুলোতে নদ-নদী ফুলেফেঁপে ওঠে; কূল ছাপিয়ে প্লাবন ভূমিতে বিস্তৃত হয়, অর্থাৎ প্লাবন ঘটে। কোনো কোনো বছর এই প্লাবন অতিরিক্ত মাত্রায় পৌঁছায় এবং আমরা তাকে বন্যা বলি।
বাংলাদেশের নদ-নদীর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, যে পরিমাণ পলিবালু তাদের প্রবাহে থাকে, তা বিশ্বের আর খুব কম দেশেই দেখা যায়। এই পলিবালুর বড় অংশটি ভাসমান অবস্থায় থাকে।
বর্ষাকালে যখন নদীর পানি কূল ছাপিয়ে প্লাবন ভূমিতে বিস্তৃত হয়, তখন পলিবালু ও প্লাবন ভূমিতে বিস্তৃত ও পতিত হয়। ফলে স্বাভাবিক প্লাবন দ্বারা বাংলাদেশ দুইভাবে উপকৃত হয়।
একদিকে এর ফলে প্লাবন ভূমি নবায়িত হয়, পলিপতনে এর উচ্চতা বৃদ্ধি পায়, জমির উর্বরতা বজায় থাকে, সব জলাধারের নবায়ন ঘটে, তাতে পানি সঞ্চিত হয় এবং তা শুষ্ক মৌসুমে পানি সরবরাহ বৃদ্ধি করে।
অন্যদিকে প্লাবন ভূমিতে ছড়িয়ে পড়ার ফলে নদী খাতে কম পলিপতন ঘটে, নদীর গভীরতা বজায় থাকে এবং নদী সুস্থ থাকে।
সুতরাং বাংলাদেশে নদ-নদীর প্রতি সবচেয়ে উপযোগী নীতি হলো প্লাবন ভূমিকে নদ-নদীর প্লাবনের জন্য উন্মুক্ত রাখা, অর্থাৎ ‘উন্মুক্ত পন্থা’র অনুসরণ।
৩.
বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন প্রথম থেকেই পশ্চিমের সংস্থাগুলোর অভিভাবকত্বে অগ্রসর হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় নয় যে তারা বাংলাদেশের পানি উন্নয়নের পরিকল্পনা করে দেওয়ার জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদের ডেকে এনেছে। এই বিশেষজ্ঞরা স্বাভাবিকভাবেই নিজ দেশের অভিজ্ঞতা দিয়ে বেশি পরিচালিত হয়েছেন।
পশ্চিমের বেশির ভাগ দেশে বৃষ্টি ও নদীপ্রবাহে ঋতুভেদ স্বল্প এবং পলিবালুর পরিমাণও সামান্য। ফলে এসব দেশে নদ-নদী সারা বছর স্বীয় খাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।
সে জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদের কাছে বাংলাদেশের নদ-নদীসৃষ্ট প্লাবন আশীর্বাদের পরিবর্তে নিছক সমস্যা বলে মনে হয় এবং তাঁরা এই প্লাবন রোধ করাকেই বাংলাদেশের পানি উন্নয়নের মূল করণীয় হিসেবে গ্রহণ করেন।
এ রকম লক্ষ্যে বিদেশি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের ওপর ‘বেষ্টনীপন্থা’ আরোপ করেন, যার অধীন নদ-নদীর তীরের বরাবর বেড়িবাঁধ তথা বেষ্টনী নির্মাণ করে প্লাবন ভূমিকে নদী খাত থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়।
বাংলাদেশ প্রায় ৭০ বছর ধরে এই বেষ্টনীপন্থা অনুসরণ করেছে এবং হাজার হাজার মাইল বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে হাজার হাজার স্লুইসগেট।
এসবের সার্বিক ফলাফল—বাংলাদেশের নদীব্যবস্থার চরম অবক্ষয়। শুধু তা-ই নয়, বেষ্টনীপন্থা ডেকে এনেছে এক নতুন সমস্যা এবং সেটা হলো জলাবদ্ধতা। শহর ও গ্রাম—বাংলাদেশের সর্বত্র এখন জলাবদ্ধতা ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে।
৪.
বাংলাদেশের এই ভ্রান্ত ধারার পানি উন্নয়নের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো বড়াল নদের অভিজ্ঞতা। উত্তরবঙ্গের এই প্রসিদ্ধ নদ রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে গোটা চলনবিল এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হুরসাগর নদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বাঘাবাড়ির কাছে যমুনার সঙ্গে মিশেছে।
এই নদ একদা চলনবিলকে বিশাল প্রাকৃতিক পানি সংরক্ষণাগার হিসেবে ব্যবহার করে পদ্মা ও যমুনার পানির উচ্চতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করত এবং বন্যা প্রশমনে সহায়তা করত।
আশির দশকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বড়াল নদ-সৃষ্ট বন্যা প্রতিরোধের নামে চারঘাটে বড়ালে প্রবেশকারী পদ্মার পানির পরিমাণ হ্রাসের লক্ষ্যে একটি তিন কপাটবিশিষ্ট স্লুইসগেট স্থাপন করে।
এই স্লুইসগেটের মোট প্রস্থ ছিল আনুমানিক ১৫ ফুট, অথচ আদি (সিএস) ভূমি জরিপ অনুসারে চারঘাটে বড়ালের প্রশস্ততা ছিল প্রায় ৫০০ ফুট। কাজেই পদ্মার পানি বড়ালে প্রবেশের জন্য পাউবো নির্মিত স্লুইসগেট যে পর্যাপ্ত ছিল না, তা বলাই বাহুল্য।
তদুপরি এই স্লুইসগেটে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে এর মুখে পলিপতন ঘটতে থাকে আর ক্রমে এটি অকেজো হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত পদ্মা থেকে বড়াল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এভাবেই চারঘাটের স্লুইসগেট বড়ালের অবক্ষয় ডেকে আনে। পদ্মার প্রবাহ হারিয়ে বড়ালে সামান্যই পানি অবশিষ্ট থাকে।
বড়ালের অবক্ষয় আরও চরমে পৌঁছায়, যখন নব্বইয়ের দশকে পাউবো আটঘরিতে আরও দুটি স্লুইসগেট নির্মাণ করে। এর মধ্যে একটি ছিল মাত্র এক কপাটবিশিষ্ট ও আনুমানিক পাঁচ ফুট প্রস্থের। পাউবোর প্রকৌশলীরা আশা করেছিলেন, এই সংকীর্ণ স্লুইসগেটের মধ্য দিয়ে গোটা বড়ালে পানি প্রবাহিত হবে!
বাস্তবে বড়াল আর এই স্লুইসগেট অতিক্রম করতে পারেনি। আটঘরি থেকে বনপাড়া পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার অংশে বড়াল নদ সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়।
প্রবাহহীন বড়ালের বাকি অংশ দখল আর দূষণের সহজ শিকারে পরিণত হয়। বড়ালের বুক চিরে বহু বেড়িবাঁধ নির্মিত হয়। ফলে বড়াল একটি খণ্ড খণ্ড পুকুরের শৃঙ্খলে পরিণত হয়।
সব মিলিয়ে বড়ালের অপমৃত্যু ঘটে। বড়াল নদ অতঃপর ‘মরা বড়াল’ বলে আখ্যায়িত হয়।
৫.
কিন্তু বড়ালপারের সাধারণ মানুষ বড়ালের এই করুণ পরিণতি মেনে নিতে পারেন না। শিগগিরই তাঁরা ‘বড়াল রক্ষা আন্দোলন’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং বড়াল পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে অবতীর্ণ হন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন) তাঁদের পাশে দাঁড়ালে এই আন্দোলন আরও প্রবল হয়। বহু জনসভা, পথসভা, হাটসভা অনুষ্ঠিত হয়। লক্ষাধিক মানুষের স্বাক্ষরসহ স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। ২০১৩ সালে চারঘাট থেকে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত বড়াল নদের গোটা ২২০ কিলোমিটারব্যাপী তীরে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
সরকারের পক্ষে জনগণের এই দাবি উপেক্ষা সম্ভব হয় না এবং ২০১৫ সালে নদীবিষয়ক টাস্কফোর্স সব স্লুইসগেট ও বেড়িবাঁধ অপসারণের মাধ্যমে বড়ালকে অবমুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
২০১৬ সালে বেড়িবাঁধগুলোর স্থলে পূর্ণদৈর্ঘ্য সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং দ্রুতই তা সম্পন্ন হয়। কিন্তু পাউবোর অনীহার কারণে স্লুইসগেটগুলোর অপসারণকাজ অগ্রসর হয় না।
সরাসরিভাবে টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা সম্ভব ছিল না বলে পাউবো বরং দাবি করে যে স্লুইসগেটগুলো অপসারণের আগে এই অপসারণের সম্ভাব্য অভিঘাত সম্পর্কে সমীক্ষা করা প্রয়োজন।
টাস্কফোর্স এই দাবি মেনে নেয় এবং বড়াল অবমুক্তকরণের কাজ স্থগিত হয়ে যায়। পাউবো তার পছন্দসই এক পরামর্শক সংস্থাকে এই সমীক্ষা সম্পাদনের দায়িত্ব দেয় এবং কয়েক বছর পর এই সংস্থা সমীক্ষার প্রতিবেদন দাখিল করে।
আশ্চর্যের বিষয় নয় যে এই প্রতিবেদন পাউবোর অবস্থানকে সমর্থন করে এবং চারঘাটের স্লুইসগেট অপসারণের পরিবর্তে সেখানে আরেকটি তিন কপাটের স্লুইসগেট নির্মাণের সুপারিশ করে।
বলাবাহুল্য, পাউবোর এসব কলাকৌশল ও পদক্ষেপ বড়ালকে অবমুক্ত করা-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্তের স্পৃহার পরিপন্থী। শুধু তা-ই নয়, বড়াল-সংক্রান্ত রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট কর্তৃক ২০১৯ সালে জারি করা বড়ালকে অবমুক্ত করার নির্দেশেরও পরিষ্কার লঙ্ঘন।
সর্বোপরি, বড়ালপারের যে জনগণ দুই দশকের বেশি সময় ধরে বড়ালকে অবমুক্ত করার সংগ্রাম করে আসছিলেন, তাঁদের মতামত, ত্যাগ ও অনুভূতিকে চরম অবমাননার শামিল। ফলে স্থানীয় জনগণ বড়াল রক্ষায় পুনরায় আন্দোলনে নামেন।
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অন্তর্বর্তী সরকারে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এরপর পরিস্থিতি বদলে যায়।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বড়াল এলাকা পরিদর্শন এবং বড়ালপারের জনগণ ও বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে নিশ্চিত হন, বড়াল অবমুক্তকরণের দাবি আর উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তাঁর এই অবস্থানের ফলে পাউবো অবশেষে গত আগস্টে স্লুইসগেটের কপাটগুলো খুলে নেয়।
৬.
সামান্য এ পদক্ষেপের ফলেই বড়াল নদে নাটকীয় পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। পদ্মা নদী থেকে বড়ালে কলকল করে পানি প্রবেশ করছে এবং মৃত বড়াল নদ যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
স্থানীয় জনগণের নিকট এটা ‘মৃত নদীকে জীবিত’ করার মতো একটি অলৌকিক ঘটনা হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে এবং তা দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে এখন হাজার হাজার মানুষ চারঘাটে ভিড় করছেন।
বড়ালের এই চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে নদ-নদীর প্রতি উন্মুক্ত পন্থা কত সঠিক এবং বেষ্টনীপন্থা কত ভ্রান্ত।
৭.
বড়ালের সম্পূর্ণ অবমুক্তি এখনো বাকি। কাঠামোসমেত সম্পূর্ণ স্লুইসগেট অপসারণ করে সেখানে সিএস জরিপ অনুসারে পূর্ণপ্রস্থ সেতু নির্মাণ করতে হবে।
তদুপরি অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, পাউবোর কেউ কেউ এখনো কপাটগুলো পুনঃস্থাপনের সুযোগের অপেক্ষায় আছে! তাদের উদ্দেশে বলা দরকার যে শুধু কপাট সরানোর ফলেই বড়াল নদে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে।
এর মাধ্যমে স্থানীয় জনগণ এত উজ্জীবিত হয়েছেন, স্লুইসগেটগুলো সম্পূর্ণ অপসারণ রোধে যেকোনো প্রচেষ্টা তাঁরা যে দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করবেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সুতরাং বাংলাদেশের জন্য এবারের বিশ্ব নদী দিবসের আহ্বান খুব স্পষ্ট, ‘বড়ালের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন!’
স্লুইসগেটগুলো নদ-নদীর গলায় ফাঁস। সব স্লুইসগেট অপসারণ করুন। নদ-নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনুন!
ড. নজরুল ইসলাম, এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং জাতিসংঘের উন্নয়ন গবেষণার সাবেক প্রধান।
মতামত লেখকের নিজস্ব